কিশোর-তরুণদের বাইকপ্রেম, অভিভাবকরা নিরুপায়?
- প্রকাশের সময় : ০৮:২১:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ অক্টোবর ২০২২
- / ৬০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ৭ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের নতুনহাট এলাকায় বাসের ধাক্কায় তিন কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। নিহতরা হলেন, যশোর সদর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে আসিফ (১৯), বাজেদুর্গাপুর গ্রামের নাজির আলীর ছেলে আরমান (১৯) ও আলমগীর হোসেনের ছেলে সালমান (১৯)। গত তিন দিনে মাদারীপুর, যশোর, ঝিনাইদহ থেকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একের পর এক শিক্ষার্থী মৃত্যুর খবর আসে। অনেক অভিভাবক সন্তানের চাওয়া মেটাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না।
এ বছর জানুয়ারিতে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় রাগ করে গলায় ফাঁস দিয়ে হাসান আলী (১৫) নামে এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করে। তার বাবা দরিদ্র মানুষ; মৎস্য আড়তে কাজ করে চালান সংসার। হাসান আলী তার বাবার কাছে থেকে মোটরসাইকেল চায়। দরিদ্র বাবার পক্ষে তা সম্ভব না হওয়ায় অভিমান করে সেদিনই দিবাগত রাতে হাসান আলী গলায় ফাঁস নেয়। কোনও কোনও বাবা-মা এই পরিস্থিতি এড়াতে বাহনটি কিনে দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতেও প্রাণে বাঁচাতে পারছেন না সন্তানকে।
সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সড়কে নিহতদের ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। এ জন্য ট্রাফিক বিভাগের নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অভিভাবকদের নিরুপায় ভাব ও অসচেতনতাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকছে না। গত ঈদের ছুটির সময় সড়কে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৪৮ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। এসব দুর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাইকচালক ছিলেন বেপরোয়া। একটি মোটরসাইকেলে চালকের বাইরে সর্বোচ্চ একজন আরোহী তোলার নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। চালক ও আরোহীদের বেশিরভাগেরই হেলমেট ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে লাইসেন্সও ছিল না চালকের।
মোটরসাইকেলে নিহত সন্তানের জিদের কথা উল্লেখ করে মফস্বল শহরের এক মা বলেন, আমি চাইনি তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে। সে বারবার বলেছে মোটরসাইকেল কিনে না দিলে পড়ালেখা করবে না। তার কোচিং করতে যাওয়ার জন্য এটা জরুরি। অনেক বুঝিয়েও যখন পারিনি তখন কিনে দেওয়া হয়েছে। এখন আমার কোল খালি করে সে চলে গেছে। আমি পারিনি, আর কোনও মা যেন অন্যায় আবদার না রাখে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেল অহরহ চলে। অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনও প্রশিক্ষণ থাকে না। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না।
সড়ক নিরাপত্তা আইনের বাস্তবায়নে প্রশাসনের গাফিলতির কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে কিনা প্রশ্নে রোড সেফটির নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় টগবগে যুবকরা প্রাণ দিচ্ছে। এর পেছনে আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে যুবকরা। বাইক কোম্পানিগুলোও তাদের বিজ্ঞাপনে গতির প্রতিযোগিতা সামনে আনছে। সব মিলিয়ে গতির সঙ্গে ছুটে চলা তেজি যুবকরা অসময়ে সড়কে নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বাইক কোম্পানিগুলোকে বেপরোয়া গতির বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সন্তানদের আবদারে তাদের হাতে বাইক তুলে দিচ্ছে ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এই বাইক নিয়ে তারা সড়কে উঠলেই বেপরোয়া গতিতে ছুটছে। আইন-নিয়ম জানে না, জানলেও মানছে না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে, প্রাণ যাচ্ছে তাদের। জীবন শুরু করার আগেই ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় স্বপ্নগুলো। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে যুবকদের হাতে বাইক তুলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।
মনোরোগ বিশ্লেষক তাজুল ইসলাম মনে করেন, বয়ঃসন্ধিকালে নানারকম বিষয়ে ভালো লাগা তৈরি হয়। সেসবে যদি নিষেধাজ্ঞা আসে তাহলে হুট করে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে সন্তানেরা। তাই বলে যা তার জন্য ক্ষতিকর সেটিকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, সন্তানকে বোঝানোর দায়িত্ব তাদের। মোটরসাইকেল চালানো শেখা, যথাযথ উপায়ে লাইসেন্স নেওয়ার পরেই কেবল বাহনটি ব্যবহার করা যায়— এটা বুঝিয়ে তার হাতে সময় মতো বাহনটি তুলে দেওয়ার কাজটি প্রথমত অভিভাবকদেরই। সূএ : বাংলা ট্রিবিউন
হককথা/এমউএ