এল নিনোর প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে বাড়বে খরা-বন্যা-দাবানল
- প্রকাশের সময় : ১১:০৩:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
- / ১২৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বপরিমন্ডলের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক বিরূপ আবহাওয়ার আবর্তে পড়েছে বাংলাদেশ। দিনে দিনে চরম ভাবাপন্ন এবং উষ্ণতা থেকে অতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বায়ুমণ্ডল। জুনের শুরুতে এসে দেশের গড় তাপমাত্রা যেমন থাকার কথা ছিল তেমন থাকেনি এবার। ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর এই সময়ে গড় তাপমাত্রা থাকে ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে কিন্তু এখন তা রয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে গত দুই দিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বস্তির বৃষ্টি নামলেও তাপদাহ বিদায় নেয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম খালিজ টাইমস ও গাল্ফ নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকছে। তাতে সবচেয়ে বেশি ভুগছে গরিব মানুষ। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বজলুর রশীদ জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত দীর্ঘ তাপপ্রবাহ আমরা আর দেখিনি। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করে বলেছে, শিগগিরই গরম কমছে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে এদেশে আরও ঘন ঘন, তীব্র ও দীর্ঘতর তাপপ্রবাহে অবদান রাখছে জলবায়ু পরিবর্তন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে অনেকে চিকিৎসার শরণাপন্ন হচ্ছেন। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন আমরা অনেক রোগী পাচ্ছি, যাদের অধিকাংশই হিট স্ট্রোকে ভুগছেন। এছাড়া তাপমাত্রাজনিত অন্যান্য সমস্যাও আছে। এদিকে এজেন্সি ফ্রান্স প্রেস ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি পৃথক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন ফিরে আসছে ভয়ংকর এল নিনো। এল নিনোর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরমভাবাপন্ন এই আবহাওয়ার জন্য ২০২৪ সাল হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এল নিনো বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এল নিনোর প্রভাব বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই দেখা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দেবে খরা, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে এবং ভারত, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের বর্ষা দুর্বল হয়ে বৃষ্টিপাত অনেক কমে যাবে। গত কয়েক মাস ধরেই গবেষকেরা বুঝতে পারছিলেন, প্রশান্ত মহাসাগরে একটি এল নিনোর উদ্ভব হতে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়াবিদ অ্যাডাম স্কাইফ বলেন, এটি এখন ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, তীব্রতর হতে হতে এ বছরের শেষ দিকে এই এল নিনো চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে। স্কাইফের মতে, চলমান এল নিনোর প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রায় সম্ভবত নতুন রেকর্ড গড়তে চলেছে ২০২৪ সাল। বিশ্বে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া মূলত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। গরম, ঠাণ্ডা বা নিরপেক্ষ। এল নিনো নামক গরম পর্যায়টি প্রতি দুই থেকে সাত বছর অন্তর ঘটে এবং দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল থেকে উষ্ণ জল সমুদ্রপৃষ্ঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ুমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তাপ ঠেলে দেয়। সাধারণত যে বছর এল নিনো শুরু হয়, তার পরের বছরটিতে তীব্র গরম অনুভূত হয়। এর আগে ২০১৫ সালে এল নিনো হয়েছিল বলে ২০১৬ সালে বিশ্বে রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রা দেখা গিয়েছিল। তখন বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছিল। ফলে সরকার সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গড়ে ২ থেকে ৭ বছর পর পর এল নিনো পরিস্থিতি হয়। এল নিনো কখন শুরু হবে তা জানার জন্য আবহাওয়া সংস্থাগুলো বিভিন্ন মানদন্ড ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের মানদণ্ড অনুযায়ী এল নিনো শুরুর আগে অন্তত এক মাস সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরম থাকবে। বায়ুমণ্ডলেও এই তাপের প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। এর মধ্যে গত মে মাসেই এল নিনো শুরুর আগের সব শর্ত পূরণ হতে দেখা গেছে।
এ অবস্থায় ইউএস ন্যাশনাল ওশান অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) এক বিবৃতিতে বলেছে, এল নিনো অবস্থা বিরাজ করছে। গবেষকেরা বিশ্বাস করেন, চলমান এল নিনো এ বছরের শেষ নাগাদ মাঝারি শক্তি অতিক্রম করার ৮৪ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁরা বলছেন, একটি সুপার এল নিনোতে রূপ নিয়ে এবার তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যেতে পারে। স্প্যানিশ শব্দ ‘এল নিনো’র অর্থ হলো ‘লিটল বয়’ বা ‘ছোট ছেলে’। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকে, তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। আর এর বিপরীত অবস্থার নাম ‘লা নিনা’, যার অর্থ ‘লিটল গার্ল’ বা ‘ছোট মেয়ে’। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়। এনওএ এর জলবায়ুবিজ্ঞানী মিশেল এল হুরু বলেন, এল নিনো কতটা শক্তিশালী, তার ভিত্তিতে পরিবেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। যেমন বিশ্বজুড়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টি কিংবা খরার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব পিটারি টালাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, এল নিনোর সঙ্গে মানবিক কারণে পরিবর্তিত জলবায়ু বিশ্বের তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেটির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। যদিও বৈশ্বিক তাপমাত্রা হয়ত ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে না। কিন্তু এ শঙ্কা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
আরোও পড়ুন । মিশন প্রত্যাশীরা উৎকণ্ঠায়
২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা মাত্র ১০ শতাংশ। সেটি বেড়ে এখন ৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা মূলত অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘকালীন আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ৫ বছরের যে কোনো একটি বছর পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম হবে যা ২০১৬ সালের রেকর্ড ভেঙে দেবে। ওই বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা সাধারণের তুলনায় ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। বিজ্ঞানীরা জানান, মূলত অজ্ঞাত কারণে সমুদ্রের পানি গরম হয়ে যাওয়া ও উপকূলীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াই আবহাওয়ার বিচিত্র দশা-এল নিনোর প্রভাব। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, নীলাভ স্রোতরাশি শীতল নয়, বরং সাগরের এই পানি ফুটছে টগবগ করে। প্রকৃতির এই বিচিত্র দশার নাম ‘এল নিনো’। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম খেয়াল করেন এই উষ্ণ সমুদ্রজল। এরপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পৃথিবীতে প্রায়ই ফিরে আসে এল নিনো দশা। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
বেলী/হককথা