ইডেনে কোটি টাকার ‘সিট বাণিজ্য’
- প্রকাশের সময় : ০৭:২৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ৩৬ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী ইডেন মহিলা কলেজের হলে কোটি টাকার সিট বাণিজ্য করে আসছেন একশ্রেণির নেত্রীরা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনের একশ্রেণির নেত্রীরা এই সিট বাণিজ্যে জড়িত।
৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিদ্যাপিঠ ইডেন মহিলা কলেজ। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর আবাসনের জন্য আছে মাত্র ছয়টি ছাত্রীনিবাস। সিট আছে ৩ হাজার ৩১০টি। হলে থাকছেন অন্তত ১২ হাজার শিক্ষার্থী। একেক কক্ষে ১২ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত থাকছেন। গাদাগাদি করে অনেকটা কষ্টের মধ্যেই পড়াশোনা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এই সংকট কাজে লাগিয়ে সিট বাণিজ্য করছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেত্রীরা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একই কায়দায় সিট বাণিজ্য করেছেন ছাত্রদলের একশ্রেণির নেত্রীরা। বর্তমানে কলেজটির ছয়টি আবাসিক হলের বেশির ভাগ কক্ষই নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা। আসনসংখ্যার বাইরে ও ভেতরে সব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগেরই ছাত্রলীগ নেত্রীদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়। আসনসংখ্যার বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বছরে এককালীন ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় নেত্রীদের। বৈধ সিটসংখ্যার বাইরে প্রতিজন থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিলেও ৯ হাজার শিক্ষার্থী থেকে বছরে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়। এই টাকা বাণিজ্য করতে হলের অনেক কক্ষকে পলিটিক্যাল রুম বানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা।
শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে আসন কম থাকার এই সুযোগ নেন নেত্রীরা। আবার অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও অর্থের বিনিময়ে এসব রাজনৈতিক কক্ষে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া সাধারণ ছাত্রীরা দলীয় কোনো মিছিল-মিটিংয়ে না যেতে চাইলে তাদের করা হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। জোর করে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেওয়া, প্রতিবাদ করলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেত্রীর বিরুদ্ধে। তাদের নির্যাতনের কারণে নিজ সংগঠনের নেত্রীরাও অতিষ্ঠ। কিন্তু হলে থাকতে হলে এসব মেনে নিতে হয়। এমনকি কিছু কিছু আসনে বহিরাগত ছাত্রী ও কর্মজীবীদের থাকার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে নেত্রীদের এই সিট বাণিজ্যে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে কলেজ প্রশাসন। তাদের কাছে পাওয়া যায় দায়সারা বক্তব্য। এ কারণে প্রতি বছরই ইডেন মহিলা কলেজে কোনো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। একের পর এক ঘটনা, আলোচনা-সমালোচনা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের।
এদিকে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ডামাডোলে ভঙ্গ দিলেন ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা। রবিবার আন্দোলনের পর ১৬ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। একই সঙ্গে স্থগিত রাখে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি। সোমবার সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলন করে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন বহিষ্কৃতরা। ঘোষণার এক ঘণ্টা পর নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানান।
রবিবার ক্যাম্পাস থেকে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানাকে বের করে দেওয়ার পর রাতে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ইডেন মহিলা কলেজ শাখার সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হলো। সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোনালি আক্তার, সুস্মিতা বাড়ৈ, জেবুন্নাহার শিলা, কল্পনা বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস, আফরোজা রশ্মি, মারজানা উর্মি, সানজিদা পারভীন চৌধুরী, এস এম মিলি, সাদিয়া জাহান সাথী, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফাতেমা খানম বিন্তি ও সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী এবং কর্মী রাফিয়া নীলা, নোশিন শার্মিলী, জান্নাতুল লিমা, সূচনা আক্তারকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হলো। পরদিন বহিষ্কার হওয়া ১৬ নেত্রীর মধ্যে ১২ জন অনশনের ঘোষণা দেন। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনশনের জন্য প্রবেশ করেন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ১২ জন নেত্রী। এ সময় গেটে গার্ডদের সঙ্গে কয়েক দফা ধাক্কাধাক্কি হয় নেত্রীদের। পরে তারা ভেতরে ঢোকেন। ভেতরে এক ঘণ্টা বৈঠকের পর দুপুর দেড়টার দিকে ইডেনের নেত্রীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসেন।
এ সময় সাংবাদিকেরা অনশনের বিষয়ে জানতে চাইলে অনশন প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই সহসভাপতি সোনালী আক্তার ও জান্নাতুল ফেরদৌস। জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য আব্দুল আওয়াল শামীম অনশনস্থলে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তিনি বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে কথা বলে জানান, বাহাউদ্দিন নাছিম বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। বাহাউদ্দিন নাছিমের আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা অনশন প্রত্যাহার করি।
জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, ঘটনার দিন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তার মেয়েদের দিয়ে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। এর প্রতিবাদে আমার সহযোদ্ধারা যখন বিচারের দাবি করে, তখন তাদের অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগের ঘটনা এবং গতকালের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুরো ঘটনার মধ্যে যারা জড়িত আছে, ইতিমধ্যে কলেজ প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা তাদের মতো করে জানাবে। তাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তারা (ইডেন ছাত্রলীগের একাংশ) সংবাদমাধ্যমে যে ধরনের অভিযোগ করেছে, তার একটি প্রমাণও দেখাতে পারেনি। রবিবার রাতের ঘটনা শিক্ষকদের সামনে ঘটেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, ভিডিও ফুটেজও দেখেছি। তারপর আর তদন্ত করার দরকার নেই। বহিষ্কারের ক্ষেত্রে সেন্ট্রালের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি সরাসরি যুক্ত হয়েছেন, আমরা বহিষ্কার করেছি।’
সোমবার বেলা ১১টার দিকে ইডেন কলেজ গেটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ১৬ জন নেতাকর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বহিষ্কৃত নেত্রীরা। তা না হলে তারা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালনের হুমকি দেন। এদিকে বহিষ্কারের বিষয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজে ছাত্রলীগের নেত্রী রিতু আক্তার, তানজিনা, জ্যোতিসহ আরও অনেকেই ছিলেন, তাদের কেন বহিষ্কার করা হলো না? আমাদের কেন বহিষ্কার করা হলো? সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পছন্দ করেন না বলেই আমাদের বহিষ্কার করেছেন। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এ কাজ করা হয়েছে।’ সূএ : দৈনিক ইত্তেফাক
হককথা/এমউএ