আফগান হেরোইনের বাংলায় দাপট, আসছে জাহাজ-নৌকায়

- প্রকাশের সময় : ১১:৩৭:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ৭০ বার পঠিত
বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেরোইন উৎপাদক দেশ আফগানিস্তান। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশটিতে এ মাদকের উৎপাদন বহু গুণ বেড়ে গেছে। আফগানিস্তানে উৎপাদিত হেরোইন ইরানের নৌকায় করে ভারত-পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। রুট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীকে। বলা হচ্ছে, দেশে আসা হেরোইনের ৯০ শতাংশই ঢুকছে এ দুই জেলা দিয়ে। সেখান থেকে কয়েকবার হাত বদল করে ধাপে ধাপে পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে মাদক ব্যবসার সঙ্গে অন্তত ৮১২ জন জড়িত। তারা ১৮টি সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করে। এসব সিন্ডিকেটের জেলায় জেলায় এক বা একাধিক করে প্রতিনিধি রয়েছে। তাদেরই একজন সম্প্রতি র্যাবের হাতে দুই নারী সদস্যসহ গ্রেপ্তার হওয়া শাকিবুর রহমান। র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, শাকিবুরের মতো আরও ৩০ থেকে ৩৫ প্রতিনিধি রয়েছে। যাদের প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১২ জন করে রয়েছে নারী সদস্য। মূলত সেবকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজগুলো এ নারীরা করে থাকে।
রাজশাহী বিভাগের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সিন্ডিকেটগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, একজন অন্যজনের নামে মুখ খুলতে চায় না। যে কারণে জব্দ হওয়া কোনো চালানের হোতা পর্যন্ত সহজে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আর র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, এ সিন্ডিকেট থেকে তথ্য নিয়ে হেরোইন চক্রের রুট পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে চক্রের আরও সদস্যদের ধরার অভিযানও চলছে।
শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান-ভারত হয়ে হেরোইন দেশে ঢুকছে যেভাবে
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় ইউএনওডিসির তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তান থেকে হেরোইন মূলত আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের পথ ধরে পাচার হয়। অধিকাংশ সময়ই ইরানের জাহাজে কনটেইনার বা নৌকা ব্যবহার করা হয়। মাদকগুলো যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, সে জন্য ওয়াটারপ্রুফ মোড়কে খুব ভালোভাবে প্যাকিং করা হয়। বড় বড় প্যাকেটের ওপর আলাদা চিহ্ন করে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতের নাম উল্লেখ থাকে। সেখানে অবশ্য বাংলাদেশের নামে কোনো প্যাকেট থাকে না। শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান হয়ে শেষ চালান আসে ভারতে। মূলত ভারতের চালান থেকেই খুচরা বিক্রেতারা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পার করে।
র্যাব ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মাদক ঢোকে ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ এলাকা দিয়ে। এক সিন্ডিকেট মুর্শিদাবাদ ব্যবহার করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানা এলাকার পদ্মার চর, সুলতানগঞ্জ, কোদালকাটি, চর আশারিয়াদহ, মানিকের চরে চালান পৌঁছে দেয়। অন্য সিন্ডিকেট মালদহ দিয়ে চাঁপাইয়ের সদর থানার চরবাগডাঙ্গা, সুন্দরপুর, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন ব্যবহার করে হেরোইন আনছে। আন্তঃদেশীয় এ কারবারিরা দেশের ভেতরে এসব জায়গায় বসে ১৫ থেকে ২০ কেজির বস্তাগুলো ভেঙে ২ থেকে ৩ কেজির প্যাকেট তৈরির পর পদ্মা পার করে শহরে পাঠাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট, কানসাট, আজমতপুর, চাকপাড়া, কামালপুর, শিয়ালমারা, ভাটিয়া বিল, তেলকুপি, রঘুনাথপুর, ওয়াহেদপুর, জহুরপুর টেক ও ফতেহপুর সীমান্ত দিয়ে ঢুকে মাদক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, একাধিক চালান অনুসরণ করে তারা জানতে পেরেছেন, মাদকগুলো শহরে এসে পিটিআই মোড়, আরামবাগ, ঝাপাইপাড়া মোড়ে অন্তত ৪ থেকে ৫টি ভাড়া বাসাতে রাখা হয়। সেখানে ১০০ গ্রামের ছোট ছোট প্যাকেট করা হয়। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে ধাপে ধাপে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দেয় কারবারিরা।
গত ৩ জানুয়ারি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার তিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, চালানগুলো এভাবে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পার হতো। সেখান থেকে সেবকদের কাছে পৌঁছাতে কাজ করত ওই নারীরা। পরিবহনের জন্য তাদের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ দিত।
কারা চালাচ্ছেন এ মাদক সিন্ডিকেট
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানা এলাকা যেন মাদকের শিল্প গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীগুলো বলছে, সেখানে অনেকেই মাদকের সঙ্গে জড়িত। কোনো না কোনো ভাবে তারা এসব চালান পার করতে সহযোগিতা করেন। কেউ তথ্য দিয়ে, কেউ হাত বদল করে, কেউ সরাসরি যুক্ত থেকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুধু গোদাগাড়ীতেই হেরোইন ব্যবসায়ী রয়েছেন অনন্ত ৪০০ জন। হেরোইনের প্রধান দুই প্রবেশদ্বার একটি চরবাগডাঙ্গা হলে অন্যটি এ গোদাগাড়ী। অন্যদিকে র্যাব-পুলিশ ও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের হোরাইন কারবারি তালিকায় নতুন নতুন গডফাদারদের তথ্য পেয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।
ধরা পড়ছে কারবারি উদ্ধার হচ্ছে মাদক
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্র বলছে, গত এক বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে হোরাইন সিন্ডিকেটের ছোট-বড় ৫৮৫ জনের বেশি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কয়েক কেজি হেরোইন। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরই তারা ৪ কেজি ৮০০ গ্রাম হোরাইন জব্দ করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ উদ্ধার করেছে ৪ কেজি ৫৯০ গ্রাম, বিজিবি উদ্ধার করেছে ৪ কেজির মতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ২০২১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবি, র্যাব মিলে উদ্ধার করে ৫৪ কেজি, ১৮৯ গ্রাম। টাকার হিসাবে যা ৫৬ কোটি টাকার ওপরে। সারা দেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থার অভিযানে ২০২১ সালে হেরোইন উদ্ধার হয়েছে ৪৪১ কেজি, ২০২০ সালে ২১০ কেজি, ২০১৯ সালে ৩২৩ কেজি, ২০১৮ সালে ৪৫১ কেজি। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে তার মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। ৯০ শতাংশ চলছে অবাধে।
কেজিতে লাভ ৭৩ লাখ টাকা, হুন্ডিতে যাচ্ছে টাকা
সম্প্রতি আফ্রিকায় হেরোইন আসক্তির প্রভাব সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে বাড়তে শুরু করেছে। তবে গুণগত মানের দিক থেকে আফগান হেরোইনের চাহিদা এখনো বেশি। তাই দামও আকাশছোঁয়া। অভিযান পরিচালনাকারী চাঁপাইয়ের গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কারবারিরা সীমান্তের চরে এসে হেরোইন ভাগ করে নেন। তখন প্রতি কেজিতে তাদের ভাগে পড়ে ২৭ লাখ টাকা। পরে সেগুলো ১০০ গ্রামের প্যাকেট করে বিক্রি করে। সেখানে কেজিতে মোট দাম নেয় ১ কোটি টাকা। মাদকের দাম হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পার করা হয়। তার আগে মধ্যস্থতাকারী এক ব্যক্তির কাছে সেই টাকা জমা থাকে। চালান হাতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ধরা পড়লে সেটি ভারতীয় কারবারির ক্ষতি হিসেবে ধরা হয়। আর হাতে পৌঁছানোর পর পুলিশ ধরলে সেটি দেশের ব্যবসায়ীর ক্ষতি। সূত্রঃ কালবেলা