নিউইয়র্ক ১০:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আজ বিশ্ব জলাভূমি দিবস : জলাধার ভরাটের দৌড়ে এগিয়ে সরকারি সংস্থা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:১২:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • / ৪৭ বার পঠিত

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য রাজধানীর হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করে চলছে উন্নয়নকাজ। বৃহস্পতিবার তোলা – মাহবুব হোসেন নবীন
জাহিদুর রহমান, ঢাকা: : সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যাতে জলাধারের অবাধ প্রবাহে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে বারবার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনকানুন, সরকারপ্রধানের নির্দেশনা- কেউই কানে তুলছে না। ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসার কথা যাদের, উল্টো তারাই নির্মূল করছে জলাভূমি। অনুসন্ধান বলছে, জলাশয় দখলের দৌড়ে এগিয়ে আছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। আইনের তেমন কার্যকারিতা না থাকায় দখলকান্ডে পিছিয়ে নেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিও। দখলদার চেনা গেলেও জলাভূমি থেকে তাদের তাড়ানোর তাড়া নেই কোনো সরকারি সংস্থার। কোনো কোনো সময় জলাশয় উদ্ধারের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ আদালতে গেলে দখলদার পাল্টা মামলা ঠুকে থামিয়ে দেয় উচ্ছেদ প্রক্রিয়া। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে ধুঁকছে জলাধার; ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়।
পরিসংখ্যানও দিচ্ছে জলাশয়শূন্য হওয়ার প্রমাণ। ২৮ বছরের মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাধারের পরিমাণ কমে তা এখন দাঁড়িয়েছে ৭ ভাগের ১ ভাগে। ১৯৯৫ সালে ঢাকার সাড়ে ২০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ছিল জলাশয়ের পরিধি। ২০২৩ সালে এসে তা ৩ শতাংশেরও নিচে এসে ঠেকেছে। হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমে ৪০০ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ পটভূমিতে আজ শুক্রবার (২ ফেব্রæয়ারী) পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছরের ২ ফেব্রæয়ারী আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন), ইউনেস্কোসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দিবসটি ঘিরে বাংলাদেশেও নানা আয়োজন করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
ঢাকায় জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি সংস্থার। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে জলাভূমি রক্ষার বিষয়টি দেখে হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি অফিস। তবে জলাশয় রক্ষায় বাতচিৎ নেই সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের। উল্টো কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের জলাভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণে বেসরকারি ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ‘তাল দিচ্ছেন’ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
খোদ রাজধানীতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঁচটি জলাধার ভরাটের সত্যতা মিলেছে। ঢাকার গৈদারটেক ও কল্যাণপুরে ১১৭ একর জায়গা প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপে (২০২২-৩৫) চিহ্নিত। ওই এলাকার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য এ জায়গা প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে বীজ আলু উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘সেন্ট্রাল টিস্যু কালচার অ্যান্ড সিড হেলথ ল্যাবরেটরি’ নির্মাণের জন্য ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়ের প্রায় ১২ একর জমি ভরাট করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এ ব্যাপারে রাজউক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ওই জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে গত মার্চে বিএডিসিকে চিঠি দেয়। দুই সংস্থার চিঠি উড়িয়ে দিয়ে কোনো অনুমোদন ছাড়াই স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে বিএডিসি। চিঠি দিয়েও এ প্রক্রিয়া ঠেকাতে না পেরে উচ্চ আদালতে যায় উত্তর সিটি করপোরেশন। বিএডিসির এ কান্ডে মাটি ভরাট রোধ ও জলাশয় হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে গত বছর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) একটি রিট করে। প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। এর আগে সেখানকার চারটি প্লটে (গৈদারটেক ও কল্যাণপুর) প্রায় ১২ একর জলাশয় ভরাট কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে আমীর চানসহ মিরপুরের স্থানীয় দুই বাসিন্দা একটি রিট করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুন হাইকোর্ট রুলসহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন। আলাদা রুলের ওপর একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৮ জানুয়ারী জলাশয় ভরাট কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। জলাশয়ের ভরাট করা অংশ তিন মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ও জলাশয় হিসেবে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিএডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিএডিসি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করবে বলে জানিয়েছে।
আগারগাঁওয়ে পুকুর ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভবন নির্মাণ হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় একসময় ১০টি ছোট-বড় জলাশয় ছিল। নগর উন্নয়ন ও সরকারি বহুতল ভবন করতে গিয়ে সাতটি পুকুর এরই মধ্যে ‘নাই’ হয়ে গেছে।
কুড়িলে রেলওয়ের জলাধার ভরাট করে অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দেওয়া হয়েছে মিলেনিয়াম হোল্ডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। পরে স্থানীয়রা বাগড়া দিলে তা বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া কয়েকশ পুকুর ও জলাধারের মধ্যে টিকে থাকা হাতিরঝিলের কারওয়ান বাজার অংশ ভরাট করছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে এ অংশের ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশন পর্যন্ত ভরাট করা হয়েছে। তবে কাজ শেষে মাটি সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রাজধানী ঢাকার আশকোনায় বিশাল আয়তনের জলাশয় ভরাট করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। জলাশয়টি ডিএনসিসির দক্ষিণখান মৌজায় অবস্থিত। ডিএনসিসির কাউন্সিলর, পরিবেশবিদ ও এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য এর চেয়ে বড় জলাশয় নেই। এটি ভরাটের ফলে বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখানসহ আশপাশের এলাকায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হবে। বিমানবন্দরেও জলাবদ্ধতার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাসাবো, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও, রামচন্দ্রপুর, কাটাসুর, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ী, রূপনগর, বাউনিয়াবাদসহ ১০টি খাল সরকারি সংস্থার দখলের মুখে পড়েছে। এসব খাল দখল করে কেউ তৈরি করেছে সড়ক, কেউবা বানিয়েছে ব্রিজ; আবার কেউ নিজেদের ইচ্ছামতো বহুতল ভবনও নির্মাণ করেছে। খালে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করায় তা উচ্ছেদ করা কঠিন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড, যা একসময় নাসিরাবাদ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে এটিকে কৃষি ও জলাধার সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরেজমিন নাসিরাবাদ, দাশেরকান্দি ও কায়েতপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো অঞ্চলই মূলত জলাভূমি। এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটি কংক্রিটের সড়ক। যোগাযোগের জন্য দীর্ঘকাল মাটির সড়ক ব্যবহার করে আসছিল এলাকাবাসী। সম্প্রতি সড়কটি কংক্রিটের প্রলেপ দিয়েছে ডিএসসিসি। সড়ক নির্মাণের পর থেকেই পুরো এলাকার জলাভূমি একে একে ভরাট হতে শুরু করে। ড্যাপের প্রতিবেদনেও ওই এলাকা ভরাটের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরে জলাধার ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাসপাতাল রোডে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টার (নিপোর্ট) ১৯ জানুয়ারি থেকে পুকুর ভরাটের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ দিলেও থামেনি ভরাটের কাজ।
পুকুর-দিঘি-জলাশয়ের জন্য ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম। জমির চাহিদা বাড়াসহ নানা কারণে এসব জলাশয় ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে স্থাপনা। বেসরকারি একটি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে ২৪ হাজারের মতো পুকুর-দিঘি ভরাট হয়েছে চট্টগ্রামে।
গত ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশে।
মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ২০১৮ সালে রাজধানীতে পুকুর ছিল ১০০টি, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯টি। গত পাঁচ বছরে ঢাকায় পুকুর কমেছে ৭১টি।
বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর তৈরি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চারগুণ বেড়ে ১০৩২ থেকে ৩৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) নির্বাহী বোর্ডের সদস্য পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ও জলাধার রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। জলাশয় ভরাটের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকল্পের নাম প্রায়ই শোনা যায়। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জলাশয় ভরাট করাটা অন্যায়, অন্যায্য ও অবৈধ। সরকারি সংস্থাগুলো যখন মহাপরিকল্পনা ও বিদ্যমান আইন না মেনে জলাশয় ভরাটে উদ্যোগী হয়, তখন অন্য দখলদার নিবৃত্ত করতে গিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, চিহ্নিত জলাধার সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি। চারটি জলকেন্দ্রিক পার্ক তৈরির জন্য এরই মধ্যে প্রকল্প নিয়েছে রাজউক। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১৫-২০টি জলাধারভিত্তিক পার্কের কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী। জলাশয় ভরাট আর দখল করলেও পার্ক তৈরির কাজ শুরু হলে সেগুলো দখলমুক্ত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানায় থাকা জলাশয় রাজউক অধিগ্রহণ করবে। (দৈনিক সমকাল)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আজ বিশ্ব জলাভূমি দিবস : জলাধার ভরাটের দৌড়ে এগিয়ে সরকারি সংস্থা

প্রকাশের সময় : ১১:১২:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য রাজধানীর হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করে চলছে উন্নয়নকাজ। বৃহস্পতিবার তোলা – মাহবুব হোসেন নবীন
জাহিদুর রহমান, ঢাকা: : সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যাতে জলাধারের অবাধ প্রবাহে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে বারবার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনকানুন, সরকারপ্রধানের নির্দেশনা- কেউই কানে তুলছে না। ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসার কথা যাদের, উল্টো তারাই নির্মূল করছে জলাভূমি। অনুসন্ধান বলছে, জলাশয় দখলের দৌড়ে এগিয়ে আছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। আইনের তেমন কার্যকারিতা না থাকায় দখলকান্ডে পিছিয়ে নেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিও। দখলদার চেনা গেলেও জলাভূমি থেকে তাদের তাড়ানোর তাড়া নেই কোনো সরকারি সংস্থার। কোনো কোনো সময় জলাশয় উদ্ধারের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ আদালতে গেলে দখলদার পাল্টা মামলা ঠুকে থামিয়ে দেয় উচ্ছেদ প্রক্রিয়া। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে ধুঁকছে জলাধার; ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়।
পরিসংখ্যানও দিচ্ছে জলাশয়শূন্য হওয়ার প্রমাণ। ২৮ বছরের মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাধারের পরিমাণ কমে তা এখন দাঁড়িয়েছে ৭ ভাগের ১ ভাগে। ১৯৯৫ সালে ঢাকার সাড়ে ২০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ছিল জলাশয়ের পরিধি। ২০২৩ সালে এসে তা ৩ শতাংশেরও নিচে এসে ঠেকেছে। হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমে ৪০০ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ পটভূমিতে আজ শুক্রবার (২ ফেব্রæয়ারী) পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছরের ২ ফেব্রæয়ারী আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন), ইউনেস্কোসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দিবসটি ঘিরে বাংলাদেশেও নানা আয়োজন করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
ঢাকায় জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি সংস্থার। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে জলাভূমি রক্ষার বিষয়টি দেখে হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি অফিস। তবে জলাশয় রক্ষায় বাতচিৎ নেই সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের। উল্টো কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের জলাভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণে বেসরকারি ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ‘তাল দিচ্ছেন’ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
খোদ রাজধানীতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঁচটি জলাধার ভরাটের সত্যতা মিলেছে। ঢাকার গৈদারটেক ও কল্যাণপুরে ১১৭ একর জায়গা প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপে (২০২২-৩৫) চিহ্নিত। ওই এলাকার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য এ জায়গা প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে বীজ আলু উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘সেন্ট্রাল টিস্যু কালচার অ্যান্ড সিড হেলথ ল্যাবরেটরি’ নির্মাণের জন্য ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়ের প্রায় ১২ একর জমি ভরাট করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এ ব্যাপারে রাজউক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ওই জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে গত মার্চে বিএডিসিকে চিঠি দেয়। দুই সংস্থার চিঠি উড়িয়ে দিয়ে কোনো অনুমোদন ছাড়াই স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে বিএডিসি। চিঠি দিয়েও এ প্রক্রিয়া ঠেকাতে না পেরে উচ্চ আদালতে যায় উত্তর সিটি করপোরেশন। বিএডিসির এ কান্ডে মাটি ভরাট রোধ ও জলাশয় হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে গত বছর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) একটি রিট করে। প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। এর আগে সেখানকার চারটি প্লটে (গৈদারটেক ও কল্যাণপুর) প্রায় ১২ একর জলাশয় ভরাট কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে আমীর চানসহ মিরপুরের স্থানীয় দুই বাসিন্দা একটি রিট করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুন হাইকোর্ট রুলসহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন। আলাদা রুলের ওপর একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৮ জানুয়ারী জলাশয় ভরাট কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। জলাশয়ের ভরাট করা অংশ তিন মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ও জলাশয় হিসেবে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিএডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিএডিসি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করবে বলে জানিয়েছে।
আগারগাঁওয়ে পুকুর ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভবন নির্মাণ হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় একসময় ১০টি ছোট-বড় জলাশয় ছিল। নগর উন্নয়ন ও সরকারি বহুতল ভবন করতে গিয়ে সাতটি পুকুর এরই মধ্যে ‘নাই’ হয়ে গেছে।
কুড়িলে রেলওয়ের জলাধার ভরাট করে অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দেওয়া হয়েছে মিলেনিয়াম হোল্ডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। পরে স্থানীয়রা বাগড়া দিলে তা বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া কয়েকশ পুকুর ও জলাধারের মধ্যে টিকে থাকা হাতিরঝিলের কারওয়ান বাজার অংশ ভরাট করছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে এ অংশের ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশন পর্যন্ত ভরাট করা হয়েছে। তবে কাজ শেষে মাটি সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রাজধানী ঢাকার আশকোনায় বিশাল আয়তনের জলাশয় ভরাট করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। জলাশয়টি ডিএনসিসির দক্ষিণখান মৌজায় অবস্থিত। ডিএনসিসির কাউন্সিলর, পরিবেশবিদ ও এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য এর চেয়ে বড় জলাশয় নেই। এটি ভরাটের ফলে বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখানসহ আশপাশের এলাকায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হবে। বিমানবন্দরেও জলাবদ্ধতার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাসাবো, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও, রামচন্দ্রপুর, কাটাসুর, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ী, রূপনগর, বাউনিয়াবাদসহ ১০টি খাল সরকারি সংস্থার দখলের মুখে পড়েছে। এসব খাল দখল করে কেউ তৈরি করেছে সড়ক, কেউবা বানিয়েছে ব্রিজ; আবার কেউ নিজেদের ইচ্ছামতো বহুতল ভবনও নির্মাণ করেছে। খালে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করায় তা উচ্ছেদ করা কঠিন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড, যা একসময় নাসিরাবাদ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে এটিকে কৃষি ও জলাধার সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরেজমিন নাসিরাবাদ, দাশেরকান্দি ও কায়েতপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো অঞ্চলই মূলত জলাভূমি। এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটি কংক্রিটের সড়ক। যোগাযোগের জন্য দীর্ঘকাল মাটির সড়ক ব্যবহার করে আসছিল এলাকাবাসী। সম্প্রতি সড়কটি কংক্রিটের প্রলেপ দিয়েছে ডিএসসিসি। সড়ক নির্মাণের পর থেকেই পুরো এলাকার জলাভূমি একে একে ভরাট হতে শুরু করে। ড্যাপের প্রতিবেদনেও ওই এলাকা ভরাটের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরে জলাধার ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাসপাতাল রোডে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টার (নিপোর্ট) ১৯ জানুয়ারি থেকে পুকুর ভরাটের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ দিলেও থামেনি ভরাটের কাজ।
পুকুর-দিঘি-জলাশয়ের জন্য ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম। জমির চাহিদা বাড়াসহ নানা কারণে এসব জলাশয় ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে স্থাপনা। বেসরকারি একটি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে ২৪ হাজারের মতো পুকুর-দিঘি ভরাট হয়েছে চট্টগ্রামে।
গত ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশে।
মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ২০১৮ সালে রাজধানীতে পুকুর ছিল ১০০টি, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯টি। গত পাঁচ বছরে ঢাকায় পুকুর কমেছে ৭১টি।
বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর তৈরি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চারগুণ বেড়ে ১০৩২ থেকে ৩৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) নির্বাহী বোর্ডের সদস্য পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ও জলাধার রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। জলাশয় ভরাটের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকল্পের নাম প্রায়ই শোনা যায়। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জলাশয় ভরাট করাটা অন্যায়, অন্যায্য ও অবৈধ। সরকারি সংস্থাগুলো যখন মহাপরিকল্পনা ও বিদ্যমান আইন না মেনে জলাশয় ভরাটে উদ্যোগী হয়, তখন অন্য দখলদার নিবৃত্ত করতে গিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, চিহ্নিত জলাধার সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি। চারটি জলকেন্দ্রিক পার্ক তৈরির জন্য এরই মধ্যে প্রকল্প নিয়েছে রাজউক। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১৫-২০টি জলাধারভিত্তিক পার্কের কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী। জলাশয় ভরাট আর দখল করলেও পার্ক তৈরির কাজ শুরু হলে সেগুলো দখলমুক্ত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানায় থাকা জলাশয় রাজউক অধিগ্রহণ করবে। (দৈনিক সমকাল)