নিউইয়র্ক ১২:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আজীবন যিনি সংগ্রামী স্বপ্নদর্শী স্বজন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৫২:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জুলাই ২০২০
  • / ৪৮ বার পঠিত

সাইফুল আলম: গভীর বেদনাহত হৃদয়ে জানাচ্ছি দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা, যমুনা গ্রæপের চেয়ারম্যান, আমাদের অভিভাবক, দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব নুরুল ইসলাম সোমবার (১৩ জুলাই) বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। মহান ¯্রষ্টার কাছে আমরা তার আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করি।
আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ আমরা মহান ¯্রষ্টার কাছ থেকে এসেছি এবং ফিরে যাব তার কাছেই- এ কথাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে রেখেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে। আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং মৃত্যুবরণ করি- এর মধ্যবর্তী যে সময়, সেই সময়টায় আমাদের কৃত্য, কর্ম এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের উত্তীর্ণ হতে হয় মহান ¯্রষ্টার পরীক্ষায়। যমুনা গ্রæপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বিদায়ে দেশ হারাল একজন দেশ প্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন স্বপ্নদর্শী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পপতি আর এক নিরহংকারী পরোপকারী ব্যক্তিত্বকে। আজীবন যিনি ছিলেন সংগ্রামী।
২.
একটি বিদেশি প্রবাদ আছে- ‘কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের চেয়ে হালকা, আর কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের চেয়ে ভারি।’ আজ তার মৃত্যুতে কিছু লিখতে গিয়ে আমার এই প্রবাদটির কথা মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে- আমার নিজের একটা অংশকে যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুই দশকেরও বেশি। সে সম্পর্ক আস্থার, বিশ্বাসের। বিশ্বাস করে তিনি কারও হাত ধরলে সেই হাত কখনও ছেড়ে দিতেন না। সেই যে দুই দশক আগে ২০০০ সালে দৈনিক যুগান্তর বের করার স্বপ্ন নিয়ে আমার মতো একজন তরুণের হাত ধরেছিলেন, সেই হাত তিনি ছেড়ে দেননি। গত ২০ বছরে তার অনেক সুসময়-দুঃসময়ে আমি পাশে থাকার কারণে তার মৃত্যুকে আমার কাছে ভীষণ ভারি বলে বোধ হচ্ছে।
৩.
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাতৃভূমির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তেমনই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দেশমাতৃকার অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য গভীর দেশপ্রেম নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। তিনি যেমন দেশকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন জন্মদাত্রী জননীকে। দুই মায়ের প্রতিই তার ছিল অপরিসীম ভালোবাসা। ¯্রষ্টা তাকে মায়ের প্রতি সেই ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছেন অকুণ্ঠ হস্তে। তিনি যে শিল্পই গড়ে তুলতে চেয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। একে একে গড়ে তুলেছেন প্রায় ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যাদের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। তাই তার মৃত্যু আমাদের কাছে ভারি বোধ হওয়াই স্বাভাবিক।
৪.
আমি তার মতো সাদামাটা অনাড়ম্বর ও সাহসী মানুষ খুব কমই দেখেছি। দেখতে দেখতে সংকট-দুঃসময়-সুসময়ের অনুভবে তার সঙ্গে জীবনের দুটি দশক কীভাবে কেটে গেল, তা ভাবতেও বিস্ময় লাগছে। যেন এই সেদিনের কথা, আমার যেন বলতে ইচ্ছে করছে- ‘পথ হাঁটা তো এখনও শেষ হয়নি আমাদের- প্রিয় চেয়ারম্যান!’
৫.
তার সাহস, তার অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অনেক সময় আমরা উদ্বিগ্ন হতাম, হতাম বিব্রতও। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো অস্বস্তি বা সংশয় ছিল না। এটাই ছিল তার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। ছিলেন আপসহীন। ছিলেন কর্মযোগী, কাজের প্রতি পূর্ণ নিবেদিত।
যুগান্তর যখন যমুনা ফিউচার পার্ক কমপ্লেক্সে নতুন ভবনে এলো, তখন পাঁচতারা হোটেলটির নিচের ফ্লোরগুলোর জন্য কাজ চলছিল। সে সময় প্রতিদিন দুপুরে রৌদ্রের ভেতর শুধু একটি টি-শার্ট পরে একা একা তিনি এর চারপাশ দিয়ে একটা চক্কর দিয়ে যেতেন। সঙ্গে আর কোনো লোক নেই, সম্পূর্ণ একা- যারা তার নাম শুনেছেন, দেখেননি কখনও, তারা কেউ বিশ্বাসও করতে পারতেন না যে তিনিই ৪১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। এই ক’দিন আগেও সুস্থ থাকতে তিনি একা একা যখন হেঁটে যেতেন তার স্বপ্নের রূপায়ণ ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’-এর ফ্লোরে, কেউ ভাবতেও পারত না তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই শপিং মলটির মালিক।
৬.
শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, এই অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনবোধ শুধু তার নিজের অলঙ্কার নয়, এটা তার গোটা পরিবারের সদস্যদেরও গুণ। তার ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়েছে; কিন্তু কাউকেই বিদেশের মোহ কিংবা বিলাসী জীবন পেয়ে বসেনি। তারা সবাই বাবার মতো সাদাসিধে জীবনেই অভ্যস্ত। তার সহধর্মিণী দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক, সাবেক মহিলাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বর্তমান সংসদেরও মাননীয় সদস্য। তিনিও অতিসাধারণ জীবনে অভ্যস্ত। যখন এমপি হননি, মন্ত্রী হননি, তখনও যেমন মানবসেবায় এলাকার মানুষের কল্যাণকর্মে ছিলেন উদার হস্ত। যখন মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন, তখনও সবার জন্য তার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত। পরিবারের প্রতিটি সদস্য কাজের প্রতি অকুণ্ঠ, যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন।
৭.
তার জীবন নিরন্তর সংগ্রামের জীবন, সাহসের জীবন। কখনও তিনি সাহস হারাননি কোনো পরিস্থিতিতেই- তার দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দৈনিক যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশন। দৈনিক যুগান্তরকে গত ২০ বছর বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে- কিন্তু নুরুল ইসলাম পিছু হটেননি এক পাও। একই ব্যাপার ঘটেছে যমুনা টেলিভিশন নিয়ে। দীর্ঘ ১২ বছর আইনি লড়াই চালিয়ে সম্প্রচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন যমুনা টেলিভিশনের। মাথা নোয়াননি, আপস করেননি। অথচ এই বারো বছরে প্রায় বারোটি টেলিভিশন বাজারে এসেছে। বছরের পর বছর যমুনা টেলিভিশনের কর্মীদের বসিয়ে বেতন দিয়েছেন যার নজির নেই এ দেশে- তবুও পিছু হটেননি নীতির প্রশ্নে।
৮.
তার কথা লিখতে গিয়ে মনে আসছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র সেই বয়সী মৎস্যশিকারির কথা, যিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে জয়ী হন- যার জীবনোপলব্ধি- ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত নয়।’ তিনিও একা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো, যাকে বলে কর্মনিষ্ঠা- তার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো তারই সাক্ষী।
৯.
তার প্রয়াণে দেশ হারাল এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুগভীর দেশপ্রেমিক এক শিল্পপতি, দেশের প্রশ্নে আমৃত্যু আপসহীন সংগ্রামী এক সন্তানকে। তার পরিবার এবং স্বজনরা হারালেন একজন সাদাসিধে নিরহংকার মানুষকে। তার গড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা হারাল একজন নির্ভরতার প্রতীক অভিভাবককে।
১০.
একটি ঘটনার কথা বলি- আমাদের এক অনুজ সহকর্মী তার মায়ের মৃত্যুতে মিলাদে অংশ নিতে গিয়ে শোকাহত চেয়ারম্যানকে দেখে আবেগে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উদ্যত হলে তিনি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সহকর্মীকে বুকে জড়িয়ে ধরে- ‘আরে, করেন কী? করেন কী? আপনার স্থান এইখানে।’ বলে বেঁধেছিলেন দৃঢ় আলিঙ্গনে- এই হচ্ছেন শিল্পপতি নুরুল ইসলাম- তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তার বুকের আলিঙ্গনে, স্পন্দনে বাঁধা থাকতেন। তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা হারাল এমন এক মহৎপ্রাণ অভিভাবককে।
১১.
যাকে বলে, ‘সেল্ফ মেড ম্যান’ তিনি তার অনন্য উদাহরণ। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শর একটা কথা আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘জীবন হচ্ছে নিজেকে সৃষ্টি করা।’ তিনি সেই জীবনকে সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে, অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। আর এই জীবন গড়ার পথে তার আপসহীন নীতি, সাহসী মনোবল এবং সংগ্রামী- দৃঢ় হাতে হাল ধরে থাকার অনমনীয় মানসিকতা ছিল অন্যতম গুণ। জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথে যা তাকে জুগিয়েছে ¯্রষ্টার আশীর্বাদ।
১২.
একদিন আমরা কেউই থাকব না। ¯্রষ্টা বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমিই জীবন দান করি। আমিই মৃত্যু ঘটাই। আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে।’ [আল কোরআন। সূরা কাফ, আয়াত ৪৩] এটাই আমাদের অনিবার্য নিয়তি। কেউ আগে, কেউ পরে। আজ আমাদের মাঝে তিনি নেই কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থার সহযাত্রী হিসেবে এখনও তিনি আমাদের হাতটি ধরে আছেন, বেঁধে আছেন বুকের বন্ধনে- আমার কাছে এমনটাই মনে হচ্ছে। মহান আল্লাহতায়ালা স্বপ্নদর্শী সংগ্রামী মানুষটিকে বেহেশত নসিব করুন এই কামনা করি। (দৈনিক যুগান্তর)
লেখক: দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাব-এর সভাপতি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আজীবন যিনি সংগ্রামী স্বপ্নদর্শী স্বজন

প্রকাশের সময় : ০৬:৫২:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জুলাই ২০২০

সাইফুল আলম: গভীর বেদনাহত হৃদয়ে জানাচ্ছি দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা, যমুনা গ্রæপের চেয়ারম্যান, আমাদের অভিভাবক, দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব নুরুল ইসলাম সোমবার (১৩ জুলাই) বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। মহান ¯্রষ্টার কাছে আমরা তার আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করি।
আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ আমরা মহান ¯্রষ্টার কাছ থেকে এসেছি এবং ফিরে যাব তার কাছেই- এ কথাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে রেখেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে। আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং মৃত্যুবরণ করি- এর মধ্যবর্তী যে সময়, সেই সময়টায় আমাদের কৃত্য, কর্ম এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের উত্তীর্ণ হতে হয় মহান ¯্রষ্টার পরীক্ষায়। যমুনা গ্রæপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বিদায়ে দেশ হারাল একজন দেশ প্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন স্বপ্নদর্শী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পপতি আর এক নিরহংকারী পরোপকারী ব্যক্তিত্বকে। আজীবন যিনি ছিলেন সংগ্রামী।
২.
একটি বিদেশি প্রবাদ আছে- ‘কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের চেয়ে হালকা, আর কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের চেয়ে ভারি।’ আজ তার মৃত্যুতে কিছু লিখতে গিয়ে আমার এই প্রবাদটির কথা মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে- আমার নিজের একটা অংশকে যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুই দশকেরও বেশি। সে সম্পর্ক আস্থার, বিশ্বাসের। বিশ্বাস করে তিনি কারও হাত ধরলে সেই হাত কখনও ছেড়ে দিতেন না। সেই যে দুই দশক আগে ২০০০ সালে দৈনিক যুগান্তর বের করার স্বপ্ন নিয়ে আমার মতো একজন তরুণের হাত ধরেছিলেন, সেই হাত তিনি ছেড়ে দেননি। গত ২০ বছরে তার অনেক সুসময়-দুঃসময়ে আমি পাশে থাকার কারণে তার মৃত্যুকে আমার কাছে ভীষণ ভারি বলে বোধ হচ্ছে।
৩.
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাতৃভূমির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তেমনই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দেশমাতৃকার অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য গভীর দেশপ্রেম নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। তিনি যেমন দেশকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন জন্মদাত্রী জননীকে। দুই মায়ের প্রতিই তার ছিল অপরিসীম ভালোবাসা। ¯্রষ্টা তাকে মায়ের প্রতি সেই ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছেন অকুণ্ঠ হস্তে। তিনি যে শিল্পই গড়ে তুলতে চেয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। একে একে গড়ে তুলেছেন প্রায় ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যাদের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। তাই তার মৃত্যু আমাদের কাছে ভারি বোধ হওয়াই স্বাভাবিক।
৪.
আমি তার মতো সাদামাটা অনাড়ম্বর ও সাহসী মানুষ খুব কমই দেখেছি। দেখতে দেখতে সংকট-দুঃসময়-সুসময়ের অনুভবে তার সঙ্গে জীবনের দুটি দশক কীভাবে কেটে গেল, তা ভাবতেও বিস্ময় লাগছে। যেন এই সেদিনের কথা, আমার যেন বলতে ইচ্ছে করছে- ‘পথ হাঁটা তো এখনও শেষ হয়নি আমাদের- প্রিয় চেয়ারম্যান!’
৫.
তার সাহস, তার অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অনেক সময় আমরা উদ্বিগ্ন হতাম, হতাম বিব্রতও। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো অস্বস্তি বা সংশয় ছিল না। এটাই ছিল তার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। ছিলেন আপসহীন। ছিলেন কর্মযোগী, কাজের প্রতি পূর্ণ নিবেদিত।
যুগান্তর যখন যমুনা ফিউচার পার্ক কমপ্লেক্সে নতুন ভবনে এলো, তখন পাঁচতারা হোটেলটির নিচের ফ্লোরগুলোর জন্য কাজ চলছিল। সে সময় প্রতিদিন দুপুরে রৌদ্রের ভেতর শুধু একটি টি-শার্ট পরে একা একা তিনি এর চারপাশ দিয়ে একটা চক্কর দিয়ে যেতেন। সঙ্গে আর কোনো লোক নেই, সম্পূর্ণ একা- যারা তার নাম শুনেছেন, দেখেননি কখনও, তারা কেউ বিশ্বাসও করতে পারতেন না যে তিনিই ৪১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। এই ক’দিন আগেও সুস্থ থাকতে তিনি একা একা যখন হেঁটে যেতেন তার স্বপ্নের রূপায়ণ ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’-এর ফ্লোরে, কেউ ভাবতেও পারত না তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই শপিং মলটির মালিক।
৬.
শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, এই অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনবোধ শুধু তার নিজের অলঙ্কার নয়, এটা তার গোটা পরিবারের সদস্যদেরও গুণ। তার ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়েছে; কিন্তু কাউকেই বিদেশের মোহ কিংবা বিলাসী জীবন পেয়ে বসেনি। তারা সবাই বাবার মতো সাদাসিধে জীবনেই অভ্যস্ত। তার সহধর্মিণী দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক, সাবেক মহিলাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বর্তমান সংসদেরও মাননীয় সদস্য। তিনিও অতিসাধারণ জীবনে অভ্যস্ত। যখন এমপি হননি, মন্ত্রী হননি, তখনও যেমন মানবসেবায় এলাকার মানুষের কল্যাণকর্মে ছিলেন উদার হস্ত। যখন মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন, তখনও সবার জন্য তার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত। পরিবারের প্রতিটি সদস্য কাজের প্রতি অকুণ্ঠ, যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন।
৭.
তার জীবন নিরন্তর সংগ্রামের জীবন, সাহসের জীবন। কখনও তিনি সাহস হারাননি কোনো পরিস্থিতিতেই- তার দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দৈনিক যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশন। দৈনিক যুগান্তরকে গত ২০ বছর বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে- কিন্তু নুরুল ইসলাম পিছু হটেননি এক পাও। একই ব্যাপার ঘটেছে যমুনা টেলিভিশন নিয়ে। দীর্ঘ ১২ বছর আইনি লড়াই চালিয়ে সম্প্রচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন যমুনা টেলিভিশনের। মাথা নোয়াননি, আপস করেননি। অথচ এই বারো বছরে প্রায় বারোটি টেলিভিশন বাজারে এসেছে। বছরের পর বছর যমুনা টেলিভিশনের কর্মীদের বসিয়ে বেতন দিয়েছেন যার নজির নেই এ দেশে- তবুও পিছু হটেননি নীতির প্রশ্নে।
৮.
তার কথা লিখতে গিয়ে মনে আসছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র সেই বয়সী মৎস্যশিকারির কথা, যিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে জয়ী হন- যার জীবনোপলব্ধি- ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত নয়।’ তিনিও একা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো, যাকে বলে কর্মনিষ্ঠা- তার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো তারই সাক্ষী।
৯.
তার প্রয়াণে দেশ হারাল এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুগভীর দেশপ্রেমিক এক শিল্পপতি, দেশের প্রশ্নে আমৃত্যু আপসহীন সংগ্রামী এক সন্তানকে। তার পরিবার এবং স্বজনরা হারালেন একজন সাদাসিধে নিরহংকার মানুষকে। তার গড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা হারাল একজন নির্ভরতার প্রতীক অভিভাবককে।
১০.
একটি ঘটনার কথা বলি- আমাদের এক অনুজ সহকর্মী তার মায়ের মৃত্যুতে মিলাদে অংশ নিতে গিয়ে শোকাহত চেয়ারম্যানকে দেখে আবেগে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উদ্যত হলে তিনি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সহকর্মীকে বুকে জড়িয়ে ধরে- ‘আরে, করেন কী? করেন কী? আপনার স্থান এইখানে।’ বলে বেঁধেছিলেন দৃঢ় আলিঙ্গনে- এই হচ্ছেন শিল্পপতি নুরুল ইসলাম- তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তার বুকের আলিঙ্গনে, স্পন্দনে বাঁধা থাকতেন। তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা হারাল এমন এক মহৎপ্রাণ অভিভাবককে।
১১.
যাকে বলে, ‘সেল্ফ মেড ম্যান’ তিনি তার অনন্য উদাহরণ। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শর একটা কথা আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘জীবন হচ্ছে নিজেকে সৃষ্টি করা।’ তিনি সেই জীবনকে সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে, অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। আর এই জীবন গড়ার পথে তার আপসহীন নীতি, সাহসী মনোবল এবং সংগ্রামী- দৃঢ় হাতে হাল ধরে থাকার অনমনীয় মানসিকতা ছিল অন্যতম গুণ। জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথে যা তাকে জুগিয়েছে ¯্রষ্টার আশীর্বাদ।
১২.
একদিন আমরা কেউই থাকব না। ¯্রষ্টা বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমিই জীবন দান করি। আমিই মৃত্যু ঘটাই। আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে।’ [আল কোরআন। সূরা কাফ, আয়াত ৪৩] এটাই আমাদের অনিবার্য নিয়তি। কেউ আগে, কেউ পরে। আজ আমাদের মাঝে তিনি নেই কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থার সহযাত্রী হিসেবে এখনও তিনি আমাদের হাতটি ধরে আছেন, বেঁধে আছেন বুকের বন্ধনে- আমার কাছে এমনটাই মনে হচ্ছে। মহান আল্লাহতায়ালা স্বপ্নদর্শী সংগ্রামী মানুষটিকে বেহেশত নসিব করুন এই কামনা করি। (দৈনিক যুগান্তর)
লেখক: দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাব-এর সভাপতি।