নিউইয়র্ক ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকার আশঙ্কা : বন্যার কবলে ২০ জেলা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৪৪:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুলাই ২০২০
  • / ৮৫ বার পঠিত

মুসতাক আহমদ: মাত্র ২৪ দিনের মধ্যে তৃতীয় দফায় বন্যাকবলিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ মুহূর্তে প্লাবিত হয়েছে দেশের ২০টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এ বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, আপার মেঘনা এবং গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বন্যা একযোগে শুরু হয়েছে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলে। এ ছাড়া ঢাকার নিম্নাঞ্চলও এবার বন্যাকবলিত হতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকার চারপাশের নদ-নদী- বালু, বংশী, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গায় বেড়েছে পানিপ্রবাহ। ফলে বেশ কয়েকটি স্থানে বন্যার পানি ঢুকেছে। কমপক্ষে আগামী দু’দিন এসব নদ-নদীতে পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে যেসব জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, ফেনী, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, নওগাঁ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ। এছাড়া পাবনা, কিশোরগঞ্জ, ফেনী ও কক্সবাজার বন্যাকবলিত হতে পারে বলে- জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হওয়ায় অন্তত অর্ধকোটি মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) তথ্য অনুযায়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব জেলার ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৫২টি পরিবারের ২৮ লাখ ১২ হাজার ৩৮০ জন। আর বন্যাজনিত কারণে মারা গেছেন ২২ জন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের মধ্যে এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৫১৫ টন চাল। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে নগদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা। শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে ৪৭ হাজার ৬৭২ প্যাকেট। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ সাড়ে ২৪ লাখ ও গোখাদ্য কেনার জন্য দেয়া হয়েছে সমপরিমাণ টাকা। এছাড়া ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে ৮০ বান্ডিল।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, উপর্যুপরি দুটি বন্যায় উত্তর, পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোর বানভাসি মানুষ এমনিতেই বিপর্যস্ত। এসব বন্যার পানি না নামতেই শুরু হয়েছে তৃতীয় দফার বন্যা। নদ-নদীগুলো পানিতে টইটুম্বর। এখন উজান থেকে যে পানি নেমে আসবে সেটাই বন্যার ভয়াবহতা ও দুর্ভোগ অনেক বাড়িয়ে দেবে। এ বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
অধ্যাপক সাইফুল আরও বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিম থেকে আসা পানি তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার হয়ে প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্রে। অপরদিকে চীনের একটি অংশ, ভুটান, আসাম, অরুণাচল ও মেঘালয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রে। ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্নাংশের নাম যমুনা। পৃথিবীর বৃহত্তর নদী অববাহিকার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অন্যতম। এ নদীতে তিস্তা-ধরলা-দুধকুমারের পানি এসে যুক্ত হওয়ায় অববাহিকাভুক্ত জেলাগুলো বড় বন্যার মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, সোমবার (২০ জুলাই) সকাল থেকে মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৩৯০ মিমি. বৃষ্টি হয়েছে। শিলংয়ে হয়েছে ১৪৩ মিমি.। আর অরুণাচলের পিসিঘাটে হয়েছে ৭৪ মিমি.। এভাবে তৃতীয় দফায় বৃষ্টির যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তাতে আগামী ৪-৫ দিনে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অন্তত ৯০০ মিমি. বৃষ্টি হতে পারে।
বন্যা ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২৭ জুন প্রথমে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা শুরু হয়। এ বন্যা মধ্যাঞ্চলের জেলা চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তখন ২১টি জেলা কমবেশি আক্রান্ত হয়। সেটি না যেতেই ১১ জুলাই দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়। আর তৃতীয় দফার বন্যাটি শুরু হয়েছে সোমবার। তারা জানান, বাংলাদেশের বন্যার কারণ প্রধানত তিনটি। এগুলো হচ্ছে- ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ পূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্য, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে অতি বৃষ্টি, ওইসব রাজ্যের পাহাড়ি ঢল এবং বাংলাদেশের ভেতরে অতি বৃষ্টির পানি। তবে ভয়াবহ বন্যার ক্ষেত্রে প্রথম দুটি কারণ বড় ভূমিকা রেখে আসছে। এবারে এখন পর্যন্ত তিস্তায় বন্যা অতীতের একশ’ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। এর আগে এ নদীতে ডালিয়া পয়েন্টে পানির স্তর সর্বোচ্চ উঠেছিল ৫৩ মিটার ১২ সেমি.। আর এবার প্রথম দফার বন্যায় তা উঠেছিল ৫৩ মিটার ১৫ সেমি.। আগামী কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ও কম্পিউটার মডেল বিশ্লেষণে ব্রহ্মপুত্রেও ২৫ জুলাই নাগাদ অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডবিøউসি) বলেছে, সকাল ৯টা নাগাদ দেশের ১৮টি নদী অন্তত ২৮ স্থানে বিপদসীমার উপরে বইছে। এগুলো হচ্ছে- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, গুড়, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, সুরমা, পুরাতন সুরমা, সারিগোয়াইন ও যদুকাটা।
আবহাওয়াবীদ ড. মুহম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এমনিতেই মৌসুম সক্রিয় আছে। এছাড়া দেশের ওপর বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের বায়ুর মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। এতে বাংলাদেশ, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, ত্রিপুরা, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের আকাশে জলীয়বাষ্পের জোগান বেশি। এ জলীয়বাষ্পের ঊর্ধ্বমুখী বিকিরণের ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘমালা তৈরি হচ্ছে। এ মেঘমালা কখনও অল্প আবার কখনও ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি করছে। এ বৃষ্টি থেমে থেমে আবার কখনও মুষলধারে হয়ে থাকে।
এফএফডবিøউসি ১৯ জুলাই তৃতীয় দফার এ বন্যার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছিল। সেটি অনুযায়ী, এ বন্যা আরও ১৫ দিন স্থায়ী হতে পারে। এবার একসঙ্গে দেশের চার অঞ্চলে বন্যা হতে পারে। সারা দেশের চারটি নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা। পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রথম তিনটি অববাহিকায় তৃতীয় দফার বন্যা হতে পারে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় ২৫-২৬ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে পানির সমতল। বৃষ্টিপাত পরিস্থিতির ওপর এটা চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এ ছাড়া দেশের উত্তরের নদী তিস্তা এবং ধরলার পানির সমতল একই সময়ে দ্রæত বেড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ৩-৪ দিন স্থায়ী হতে পারে বৃষ্টিপাত। অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানির সমতল বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ধারাবাহিকভাবে ৫ দিন বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও এ সময়ে গঙ্গা-পদ্মা (রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ওপরের অংশ) বিপৎসীমা পার করার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল বৃদ্ধি পদ্মা নদীতে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। এটা জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে ২৬ জুলাইয়ের পর স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে। এছাড়া মেঘনা অববাহিকায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলেও বন্যা দেখা দিতে পারে। আর দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য জেলাগুলোর নদী হালদা, সাংগু ও মাতামুহুরি নদীর পানিও বেড়ে যেতে পারে।
সারা দেশের চিত্র: মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তৃতীয় দফা বন্যায় নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, মাঠ-ঘাট আবারও একাকার হয়ে পড়ায় গবাদি পশুসহ সর্বক্ষেত্রেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। সুনাগঞ্জের ছাতকের সঙ্গে জেলা সদরসহ দেশের সব অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা বা জেলা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে বহু রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মৎস্য খামার। অধিকাংশ টিউবওয়েল পানিতে নিমজ্জিত হওয়াসহ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের দেখা দিয়েছে বানভাসি এলাকায়। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন মানুষ। বন্যাকবলিতদের জন্য চাল, শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে অনেক মানুষ গেলেও করোনার ভয়ে মানুষ বাড়িতে অবস্থান করছেন। বয়স্ক ও শিশুদের নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বন্যার পানিতে ডুবে স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার আউশ ফসল ও আমন বীজতলাসহ শাকসবজি পানির নিচে রয়েছে।
নাটোর: আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত থাকায় নাটোর সিংড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারের অনেকে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে প্রায় ৩০টি পরিবার। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সিংড়া-কলম সড়কের বলিয়াবাড়ী এলাকার রাস্তা। যে কোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে এ রাস্তাটি। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, শেরকোল এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার: সুরমা, সীমান্ত নদী যাদুকাটা, চলতি ও রক্তি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তৃতীয় দফা প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জের হাওর জনপদ। ছাতকে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। মঙ্গলবার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ): সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি ৮ সেমি. কমে বিপদসীমার ৬৮ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ ও লৌহজং: মুন্সীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ভাগ্যাকূল পয়েন্টে মঙ্গলবার পদ্মার পানি বিপদসীমার ৭০ সেমি. এবং মাওয়া পয়েন্টে ৬২ সেমি.র উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিগত কয়েক দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মাসংলগ্ন জেলার ৩টি উপজেলা টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং ও শ্রীনগরের ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ডুবে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। পানিবন্দি রয়েছেন ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজারের অধিক মানুষ।
কুড়িগ্রাম, চিলমারী ও রাজারহাট: কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রধান নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখনও বিপদসীমার উপর। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ব্যাপক নদী ভাঙন। ঘূর্ণি¯্রােতের কবলে পড়ে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ বুড়িরহাট স্পারটির ৫০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর): দেওয়ানগঞ্জে যমুনার পানি কমলেও বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যার পানি আটকে পড়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ৩টায় দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনায় ১০ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপদসীমার ৭৬ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ): হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। খোয়াই, করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হু হু করে বাড়ছে পানি। উজানে বৃষ্টির কারণেই মূলত খোয়াই নদীর পানি বাড়ছে। করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানিতে সাটিয়াজুরী ও পাইকপাড়া, শানখলা, আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের অনেক গ্রামের নিচু বাড়িঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে।
গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে কমলেও তিস্তা এবং করতোয়া নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সোমবার বিকাল ৩টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৯ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেমি. এবং ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ১০ সেমি. কমে এখন বিপদসীমার ৪০ সেমি. উপর দিয়ে বইছে। অপরদিকে করতোয়া নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ২৫ সেমি. এবং তিস্তার পানি এ সময় ১২ সেমি. বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফরিদপুর: ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের আজমপুর ও চরডাঙ্গা গ্রামে মধুমতি নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনিই ভাঙছে নদীর পাড়। বাড়ি-ঘর হারিয়ে তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করছেন।
নবাবগঞ্জ (ঢাকা): ঢাকার দোহার উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না। দেখা দিয়ে দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ফলে এসব এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খ্যাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া অতি জরুরি হয়ে উঠেছে। নেত্রকোনা, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, মাদারীপুরের শিবচর, মানিকগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে ।
উপরের ছবিটি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাওর তীরবর্তী জনপদের মঙ্গলবারের দৃশ্যপট। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকার আশঙ্কা : বন্যার কবলে ২০ জেলা

প্রকাশের সময় : ১১:৪৪:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুলাই ২০২০

মুসতাক আহমদ: মাত্র ২৪ দিনের মধ্যে তৃতীয় দফায় বন্যাকবলিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ মুহূর্তে প্লাবিত হয়েছে দেশের ২০টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এ বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, আপার মেঘনা এবং গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বন্যা একযোগে শুরু হয়েছে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলে। এ ছাড়া ঢাকার নিম্নাঞ্চলও এবার বন্যাকবলিত হতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকার চারপাশের নদ-নদী- বালু, বংশী, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গায় বেড়েছে পানিপ্রবাহ। ফলে বেশ কয়েকটি স্থানে বন্যার পানি ঢুকেছে। কমপক্ষে আগামী দু’দিন এসব নদ-নদীতে পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে যেসব জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, ফেনী, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, নওগাঁ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ। এছাড়া পাবনা, কিশোরগঞ্জ, ফেনী ও কক্সবাজার বন্যাকবলিত হতে পারে বলে- জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হওয়ায় অন্তত অর্ধকোটি মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) তথ্য অনুযায়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব জেলার ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৫২টি পরিবারের ২৮ লাখ ১২ হাজার ৩৮০ জন। আর বন্যাজনিত কারণে মারা গেছেন ২২ জন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের মধ্যে এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৫১৫ টন চাল। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে নগদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা। শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে ৪৭ হাজার ৬৭২ প্যাকেট। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ সাড়ে ২৪ লাখ ও গোখাদ্য কেনার জন্য দেয়া হয়েছে সমপরিমাণ টাকা। এছাড়া ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে ৮০ বান্ডিল।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, উপর্যুপরি দুটি বন্যায় উত্তর, পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোর বানভাসি মানুষ এমনিতেই বিপর্যস্ত। এসব বন্যার পানি না নামতেই শুরু হয়েছে তৃতীয় দফার বন্যা। নদ-নদীগুলো পানিতে টইটুম্বর। এখন উজান থেকে যে পানি নেমে আসবে সেটাই বন্যার ভয়াবহতা ও দুর্ভোগ অনেক বাড়িয়ে দেবে। এ বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
অধ্যাপক সাইফুল আরও বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিম থেকে আসা পানি তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার হয়ে প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্রে। অপরদিকে চীনের একটি অংশ, ভুটান, আসাম, অরুণাচল ও মেঘালয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রে। ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্নাংশের নাম যমুনা। পৃথিবীর বৃহত্তর নদী অববাহিকার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অন্যতম। এ নদীতে তিস্তা-ধরলা-দুধকুমারের পানি এসে যুক্ত হওয়ায় অববাহিকাভুক্ত জেলাগুলো বড় বন্যার মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, সোমবার (২০ জুলাই) সকাল থেকে মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৩৯০ মিমি. বৃষ্টি হয়েছে। শিলংয়ে হয়েছে ১৪৩ মিমি.। আর অরুণাচলের পিসিঘাটে হয়েছে ৭৪ মিমি.। এভাবে তৃতীয় দফায় বৃষ্টির যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তাতে আগামী ৪-৫ দিনে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অন্তত ৯০০ মিমি. বৃষ্টি হতে পারে।
বন্যা ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২৭ জুন প্রথমে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা শুরু হয়। এ বন্যা মধ্যাঞ্চলের জেলা চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তখন ২১টি জেলা কমবেশি আক্রান্ত হয়। সেটি না যেতেই ১১ জুলাই দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়। আর তৃতীয় দফার বন্যাটি শুরু হয়েছে সোমবার। তারা জানান, বাংলাদেশের বন্যার কারণ প্রধানত তিনটি। এগুলো হচ্ছে- ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ পূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্য, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে অতি বৃষ্টি, ওইসব রাজ্যের পাহাড়ি ঢল এবং বাংলাদেশের ভেতরে অতি বৃষ্টির পানি। তবে ভয়াবহ বন্যার ক্ষেত্রে প্রথম দুটি কারণ বড় ভূমিকা রেখে আসছে। এবারে এখন পর্যন্ত তিস্তায় বন্যা অতীতের একশ’ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। এর আগে এ নদীতে ডালিয়া পয়েন্টে পানির স্তর সর্বোচ্চ উঠেছিল ৫৩ মিটার ১২ সেমি.। আর এবার প্রথম দফার বন্যায় তা উঠেছিল ৫৩ মিটার ১৫ সেমি.। আগামী কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ও কম্পিউটার মডেল বিশ্লেষণে ব্রহ্মপুত্রেও ২৫ জুলাই নাগাদ অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডবিøউসি) বলেছে, সকাল ৯টা নাগাদ দেশের ১৮টি নদী অন্তত ২৮ স্থানে বিপদসীমার উপরে বইছে। এগুলো হচ্ছে- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, গুড়, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, সুরমা, পুরাতন সুরমা, সারিগোয়াইন ও যদুকাটা।
আবহাওয়াবীদ ড. মুহম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এমনিতেই মৌসুম সক্রিয় আছে। এছাড়া দেশের ওপর বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের বায়ুর মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। এতে বাংলাদেশ, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, ত্রিপুরা, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের আকাশে জলীয়বাষ্পের জোগান বেশি। এ জলীয়বাষ্পের ঊর্ধ্বমুখী বিকিরণের ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘমালা তৈরি হচ্ছে। এ মেঘমালা কখনও অল্প আবার কখনও ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি করছে। এ বৃষ্টি থেমে থেমে আবার কখনও মুষলধারে হয়ে থাকে।
এফএফডবিøউসি ১৯ জুলাই তৃতীয় দফার এ বন্যার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছিল। সেটি অনুযায়ী, এ বন্যা আরও ১৫ দিন স্থায়ী হতে পারে। এবার একসঙ্গে দেশের চার অঞ্চলে বন্যা হতে পারে। সারা দেশের চারটি নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা। পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রথম তিনটি অববাহিকায় তৃতীয় দফার বন্যা হতে পারে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় ২৫-২৬ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে পানির সমতল। বৃষ্টিপাত পরিস্থিতির ওপর এটা চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এ ছাড়া দেশের উত্তরের নদী তিস্তা এবং ধরলার পানির সমতল একই সময়ে দ্রæত বেড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ৩-৪ দিন স্থায়ী হতে পারে বৃষ্টিপাত। অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানির সমতল বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ধারাবাহিকভাবে ৫ দিন বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও এ সময়ে গঙ্গা-পদ্মা (রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ওপরের অংশ) বিপৎসীমা পার করার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল বৃদ্ধি পদ্মা নদীতে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। এটা জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে ২৬ জুলাইয়ের পর স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে। এছাড়া মেঘনা অববাহিকায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলেও বন্যা দেখা দিতে পারে। আর দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য জেলাগুলোর নদী হালদা, সাংগু ও মাতামুহুরি নদীর পানিও বেড়ে যেতে পারে।
সারা দেশের চিত্র: মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তৃতীয় দফা বন্যায় নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, মাঠ-ঘাট আবারও একাকার হয়ে পড়ায় গবাদি পশুসহ সর্বক্ষেত্রেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। সুনাগঞ্জের ছাতকের সঙ্গে জেলা সদরসহ দেশের সব অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা বা জেলা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে বহু রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মৎস্য খামার। অধিকাংশ টিউবওয়েল পানিতে নিমজ্জিত হওয়াসহ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের দেখা দিয়েছে বানভাসি এলাকায়। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন মানুষ। বন্যাকবলিতদের জন্য চাল, শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে অনেক মানুষ গেলেও করোনার ভয়ে মানুষ বাড়িতে অবস্থান করছেন। বয়স্ক ও শিশুদের নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বন্যার পানিতে ডুবে স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার আউশ ফসল ও আমন বীজতলাসহ শাকসবজি পানির নিচে রয়েছে।
নাটোর: আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত থাকায় নাটোর সিংড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারের অনেকে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে প্রায় ৩০টি পরিবার। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সিংড়া-কলম সড়কের বলিয়াবাড়ী এলাকার রাস্তা। যে কোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে এ রাস্তাটি। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, শেরকোল এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার: সুরমা, সীমান্ত নদী যাদুকাটা, চলতি ও রক্তি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তৃতীয় দফা প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জের হাওর জনপদ। ছাতকে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। মঙ্গলবার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ): সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি ৮ সেমি. কমে বিপদসীমার ৬৮ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ ও লৌহজং: মুন্সীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ভাগ্যাকূল পয়েন্টে মঙ্গলবার পদ্মার পানি বিপদসীমার ৭০ সেমি. এবং মাওয়া পয়েন্টে ৬২ সেমি.র উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিগত কয়েক দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মাসংলগ্ন জেলার ৩টি উপজেলা টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং ও শ্রীনগরের ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ডুবে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। পানিবন্দি রয়েছেন ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজারের অধিক মানুষ।
কুড়িগ্রাম, চিলমারী ও রাজারহাট: কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রধান নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখনও বিপদসীমার উপর। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ব্যাপক নদী ভাঙন। ঘূর্ণি¯্রােতের কবলে পড়ে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ বুড়িরহাট স্পারটির ৫০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর): দেওয়ানগঞ্জে যমুনার পানি কমলেও বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যার পানি আটকে পড়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ৩টায় দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনায় ১০ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপদসীমার ৭৬ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ): হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। খোয়াই, করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হু হু করে বাড়ছে পানি। উজানে বৃষ্টির কারণেই মূলত খোয়াই নদীর পানি বাড়ছে। করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানিতে সাটিয়াজুরী ও পাইকপাড়া, শানখলা, আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের অনেক গ্রামের নিচু বাড়িঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে।
গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে কমলেও তিস্তা এবং করতোয়া নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সোমবার বিকাল ৩টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৯ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেমি. এবং ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ১০ সেমি. কমে এখন বিপদসীমার ৪০ সেমি. উপর দিয়ে বইছে। অপরদিকে করতোয়া নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ২৫ সেমি. এবং তিস্তার পানি এ সময় ১২ সেমি. বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফরিদপুর: ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের আজমপুর ও চরডাঙ্গা গ্রামে মধুমতি নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনিই ভাঙছে নদীর পাড়। বাড়ি-ঘর হারিয়ে তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করছেন।
নবাবগঞ্জ (ঢাকা): ঢাকার দোহার উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না। দেখা দিয়ে দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ফলে এসব এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খ্যাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া অতি জরুরি হয়ে উঠেছে। নেত্রকোনা, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, মাদারীপুরের শিবচর, মানিকগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে ।
উপরের ছবিটি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাওর তীরবর্তী জনপদের মঙ্গলবারের দৃশ্যপট। (দৈনিক যুগান্তর)