অভিজিৎ হত্যা মামলা : ৫ জঙ্গির ফাঁসির আদেশ একজনের যাবজ্জীবন

- প্রকাশের সময় : ১২:৩১:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১
- / ৭৬ বার পঠিত
ঢাকা ডেস্ক: বিজ্ঞান লেখক ও বøগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় পাঁচ আসামির মৃত্যুদন্ড ও এক আসামির যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রæয়ারী) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামিকে অপর এক ধারায় ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। আদালতের ৩২ কার্যদিবসে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
ঢাকায় একুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যা। ছবি: ফাইল ফটো
এছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘জননিরাপত্তা বিঘিœত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করে যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মতপ্রকাশ করতে না পারে- এজন্য অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন বিচারক।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ও মো. আরাফাত রহমান। আর আসামি শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। মোট ছয় আসামির মধ্যে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত প্রথম দুজন পলাতক ও বাকিরা কারাগারে। দন্ডিত আসামিদের মধ্যে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল ও মোজাম্মেল হুসাইনকে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায়ও মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন একই বিচারক। গত ১০ ফেব্রæয়ারী দীপন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারী অভিজিৎ দেশে আসেন। ওইবার একুশে বইমেলায় তার দুটি বই প্রকাশিত হয়। ২৬ ফেব্রæয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিজিৎ বইমেলায় যান। মেলা থেকে ফেরার সময় রাত সাড়ে ৮টায় টিএসসি চত্বরের সামনে স্ত্রী বন্যা আহমেদসহ হামলার শিকার হন তিনি। জঙ্গি হামলায় অভিজিতের মাথার মগজ বের হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নিলে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হামলায় চাপাতির আঘাতে বন্যার বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মর্মান্তিক এ ঘটনার পাঁচ বছর ১১ মাস ১৮ দিন পর এ রায় ঘোষণা করা হলো। রায় ঘোষণার আগে কারাগারে থাকা চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। রায় ঘোষণার পর তাদের মৃত্যু পরোয়ানা ও সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর পলাতক দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রায় উপলক্ষে মঙ্গলবার আদালত চত্বরে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হয়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বুলেট প্রæফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে আসামিদের ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়। এ সময় আসামিদের হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। তারা একে অপরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলেন। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে বিচারক রায় পাঠ শুরু করেন। ৫০ পাতার রায়ের কিছু অংশ পাঠ করেন বিচারক। রায় ঘোষণা শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর আসামিদের ট্রাইব্যুনাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় আসামিদের মধ্যে দুজন সাংবাদিকদের আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। এদিকে রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন ও মো. নজরুল ইসলাম এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। অভিজিতের পরিবারের কেউ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন না।
রায়ের পর্যবেক্ষণ: ট্রাইব্যুনালের বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন- অভিজিৎ রায় একজন বিজ্ঞান লেখক ও বøগার ছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে আক্রমণের শিকার হন। নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অর্থাৎ এ মামলার অভিযুক্ত আসামিরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মতপ্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়। অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা। যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মতপ্রকাশ না করতে পারে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জন নিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে মতামত প্রকাশ ও স্বাধীন কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত আসামিদের অভিন্ন অভিপ্রায় ছিল বিজ্ঞানমনস্ক বøগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত আসামিদের কারও ভূমিকা ছোট বড় করে দেখার সুযোগ নেই। যেহেতু অভিযুক্ত পাঁচ আসামি- চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ও মো. আরাফাত রহমান আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায় হত্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। সেজন্য ওই পাঁচ আসামির একই সাজা প্রদান করা হবে বাঞ্ছনীয়। অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশগ্রহণকারী অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মতামত প্রকাশ করতে সাহস পাবেন না। কাজেই ওই আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না। তাই ওই পাঁচ আসামির প্রত্যেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ৬(২)(অ) ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এতে একদিকে নিহতের আত্মীয়রা শান্তি পাবেন এবং মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে সাহস পাবেন। অন্যদিকে ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে ভয় পাবে এবং নিরুৎসাহিত হবে। আর আসামি শফিউর রহমান ফারাবীকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৬(২)(আ) ধারায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা সমীচীন হবে।
মামলা, তদন্ত ও বিচার: যুক্তরাষ্ট্র থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারী অভিজিৎ দেশে আসেন। ২৬ ফেব্রæয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিজিৎ বইমেলায় যান। মেলা থেকে ফেরার সময় রাত সাড়ে ৮টায় টিএসসি চত্বরের সামনে স্ত্রী বন্যা আহমেদসহ হামলার শিকার হন তিনি। পরে হাসপাতালে নিলে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় অভিজিতের বাবা ড. অজয় রায় বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারী এ মামলায় চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম এ চার্জশিট দেন। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ওই চার্জশিট আমলে নিয়ে পলাতক দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর ওই বছরের ১ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। চলতি বছরের ৪ ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য এদিন ধার্য করেন বিচারক। মামলায় মোট ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। (দৈনিক যুগান্তর)