অপেক্ষায় বঙ্গভবন
- প্রকাশের সময় : ১১:১০:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৩
- / ৪১ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : হাতে গোনা কয়েকটি দিন। তারপরই বঙ্গভবনের বাসিন্দা হয়ে আসছেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন। দেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী ২৪ এপ্রিল সকালে শপথ নেয়ার কথা তাঁর। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন ২১তম প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। নতুনের হাতে পুরাতনের সমর্পণ। এটিই দুনিয়ার রীতি। অমোঘ রীতির বৃত্তে ঘূর্ণায়মান মানুষের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এটি কখনও হতে পারে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, প্রলয়মুখর, নাটকীয়তায় ভরপুর। হতে পারে বর্ণিল, বর্ণাঢ্য, ঐতিহাসিক ও মধুময়তায় উত্তাল। কোন্ সময়টি কেমন ছিলো- সেটির মূল্যায়ন কিংবা বিচারের ভার অবশ্য ইতিহাসের।
১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রেসিডেন্ট পদটিকে অনেকটা অলঙ্কারিক পদে পরিণত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তাঁর হাতে রাখা হয়েছে বেশ কিছু ক্ষমতা। তিনি বাংলাদেশের আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের সকল শাখার আনুষ্ঠানিক প্রধান। সংবিধানের ৫৬ (২) ধারা অনুসারে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীদেরকে নিয়োগ দেন। শর্ত হচ্ছে যে, তাদের সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ-সদস্যগণের মধ্য হতে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ এমপি নির্বাচিত হবার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনীত হতে পারবেন। সংবিধানের ৯৫ ধারা অনুসারে প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেন। সংবিধানের ১১৮ ধারা অনুসারে প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেন।
সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ-িত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শনের বিশেষ অধিকার প্রেসিডেন্টের রয়েছে। একই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেয়া যে কোনো মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যেকোনো দ- মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রয়েছে প্রেসিডেন্টের। তাঁর রয়েছে বেশ কিছু আইনি ক্ষমতা। যেমন সংবিধানের ৮০ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে কোনো বিল গৃহিত হলে সম্মতির জন্য তা প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করতে হবে। প্রেসিডেন্টের কাছে কোনো বিল পেশ করার পর পনেরো দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতিদান করবেন কিংবা অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তার কোনো বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার কিংবা প্রেসিডেন্ট নির্দেশিত কোনো সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জ্ঞাপন করে একটি বার্তাসহ প্রেসিডেন্ট বিলটি সংসদে ফেরত দিতে পারবেন (প্রেসিডেন্ট তা করতে অসমর্থ হলে উক্ত মেয়াদের অবসানের পর প্রেসিডেন্ট বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে)। প্রেসিডেন্ট যদি বিলটি অনুরূপভাবে সংসদে ফেরত পাঠান, তাহলে সংসদ প্রেসিডেন্টের বার্তাসহ তা পুনর্বিবেচনা করবে; এবং সংশোধনীসহ বা সংশোধনী ব্যতিরেকে সংসদ পুনরায় বিলটি গ্রহণ করলে সম্মতির জন্য তা প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপিত হবে। অনুরূপ উপস্থাপনের ৭ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বিলটিতে সম্মতিদান করবেন। প্রেসিডেন্ট তা করতে অসমর্থ হলে উক্ত মেয়াদের অবসানের পর প্রেসিডেন্ট বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে। সংসদে গৃহিত বিলটিতে প্রেসিডেন্ট সম্মতিদান করলে বা তিনি সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হলে তা আইনে পরিণত হবে এবং সংসদের আইন বলে অভিহিত হবে। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর প্রেসিডেন্ট। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এর ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট এই পদে অধিষ্ঠিত। প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও অফিস ঢাকায় অবস্থিত বঙ্গভবন হচ্ছে প্রেসিডেন্টের প্রধান বাসভবন। এছাড়া নাটোর জেলায় উত্তরা গণভবন নামে প্রেসিডেন্টের আরেকটি বাসভবন রয়েছে।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ : প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদের স্পিকারের পদ থেকে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন মো. আবদুল হামিদ। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের ৫ বছরের মাথায় জাতীয় সংসদের এমপিদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি এ পদে আসীন হন। মো. জিল্লুর রহমান ইন্তেকালের পর ওই বছর ২২ মার্চ মো. আবদুল হামিদ পূর্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। সে থেকে তিনি দুই মেয়াদে টানা ১০ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্ম মেয়াদে দেশে ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪-২০১৮) অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকালে দলের প্রতি আনুগত্য ছিলো অটুট। রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য করতে পারেননি নিজেকে। দু’টি নির্বাচনের আগে যখন রাজনৈতিক সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা বিনির্মাণে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালনে ছিলেন কুণ্ঠিত। সরকার এবং রাষ্ট্রের পৃথক সত্ত্বার পরিচয় তাঁর আচরণে ছিলো অনুপস্থিত। ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রাণবন্ত, উদার, মিশুক ও সদালাপী। সংসদে এবং সংদের বাইরে ভাষণে, বক্তৃতায় তার রয়েছে সরল সম্ভাষণ। লিখিত বক্তব্যের বাইরে সরস বাক্যালাপে তিনি অতুলনীয়। তবে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রেসিডেন্টের বিশেষ অধিকার প্রয়োগে পূর্বসুরীদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ।
একেএম সাহেদ আলী হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামী ছিলেন ফরিদপুর সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির। ২০১৪ সালে তার মৃত্যুদ- কার্যকরের আগের দিন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মৃত্যুদ- স্থগিত করেন। মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে তার সাজা হ্রাস করে ১৪ বছর কারাদ- দেয়া হয়। ২০১৭ সালে আসলাম ফকির কারামুক্ত হন। পরে তিনি আবারও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফ্রিডম পার্টির নেতা মোস্তফা হত্যা মামলায় ২০০৪ সালে ঢাকার একটি আদালত তোফায়েল আহমেদ জোসেফকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। ২০১৮ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ তাকে ক্ষমা ঘোষণা করেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত জোসেফ কারামুক্তির পর দেশ ছেড়েছেন বলে জানা জানা যায়।
দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে সরকারপ্রধান সাধারণ মানুষকে কৃচ্ছ্রতা সাধনসহ সাশ্রয়ী জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে দেখা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে কৃচ্ছ্রতাবোধের প্রতিফলন প্রসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের মাঝে চোখে পড়েনি। রুটিন স্বাস্থ্যপরীক্ষায় তিনি ছুটে গেছেন বিদেশে। সর্বশেষ তীব্র রিজার্ভ ও ডলার সঙ্কটের মাঝে স্বাস্থ্যপরীক্ষায় তিনি উড়ে যান সিঙ্গাপুর। সঙ্গে নেন পরিবারের ১৩ সদস্যসহ ৫৫ জনের লটবহর। ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ সফরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আখ্যায়িত করা হয় প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সর্বশেষ ‘প্রমোদ বিহার‘ হিসেবে। মাউন্ট এলিজাবেথে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তিনি জাতীয় সংসদের ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে বক্তৃতা করেন। বলা হয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদে এটি ছিলো তার শেষ বক্তব্য। বিদায়ী এ প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ বলেন, আসুন, সবাই সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- থেকে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে বিপন্নকারী যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জাতীয় সংসদকে গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের এমপিদের হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে গঠনমূলক, কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ দেন। তাঁর এ বিদায়ী বক্তব্য সচেতন নাগরিক সমাজকে নাড়া দেয়। কিন্তু এমন এক সময় তিনি এ বক্তব্য দিলেন, যখন তাঁর ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ নেই। অনেকের মতে, এ বক্তব্য তাঁর দশ বছরের দায়িত্বকালিন ভূমিকার ঠিক বিপরীত। গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা। কিন্তু এ প্রশ্নে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের কার্যকর ভূমিকা ছিলো অনুপস্থিত। প্রতিটি মুহূর্তে দলীয় আনুগত্যকেই উচ্চকিত করেছেন তিনি। তথাপি অভিজ্ঞতালব্ধ কর্মজীবনের শেষ মুহূর্তের এই আত্মোপলব্ধি হয়তো নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো পথ দেখাবে।
নতুনের প্রতি প্রত্যাশা : প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এমন এক সময় দায়িত্ব নিচ্ছেন যাকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। দেড় দশকের প্রায় গণতন্ত্রহীনতার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকল্পেই হয়তো ঢেলে দিতে হবে তার অধিকাংশ মনোযোগ। দায়িত্ব হাতে নিয়েই তাঁকে পড়তে হবে চ্যালেঞ্জের মুখে। রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছেন, ২২তম প্রেসিডেন্টের সামনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আবহ প্রতিষ্ঠা করা। কাজটি অবশ্যই কঠিন। কেন না, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ যেমন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রশ্নে অটল, তেমনটি রাজপথের বিরোধীদল বিএনপিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না আসার বিষয়ে অবিচল। এই প্রশ্নে দেশের রাজনীতি ক্রমে সংঘাতমুখর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল। উন্নয়ন অংশীদার, দাতা সংস্থা ও দেশগুলোও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে স্পষ্ট করছে নিজেদের অবস্থান। বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, দীর্ঘ ভোটাধিকার বঞ্চিত তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাক্সক্ষা, উন্নয়ন অংশীদার ও দাতা সংস্থাগুলোর প্রত্যাশা, আঞ্চলিক স্বার্থ, ভূ-রাজনীতি-সব যেন মিলিত হয়েছে এক বিন্দুতে। এসব বিচারে ২২তম প্রেসিডেন্টের ভূমিকা অলঙ্কারিক থাকার সুযোগ নেই। সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় নয়া প্রেসিডেন্টের প্রাসঙ্গিকতা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য গত দেড় দশকের প্রেসিডেন্টগণের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
মাজার জেয়ারত, মন্ত্রিপরিষদের শপথ পড়ানোর বাইরে প্রেসিডেন্টের অনেক কিছু করার আছে। এমনটি অবশ্য নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনও মনে করেন। দ্ব্যর্থহীনভাবে তিনি নিজেই দিয়েছেন এমন ইঙ্গিত। সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল তিনি ‘অনেক কিছু করা’র প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার কথা বলে। তিনি বলেছেন, একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার যা কিছু করার তাই করব। তার লেখা ‘এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন…সবাই মুখে মুখে বলছে নির্বাচন খুব ক্রুশিয়াল হবে। কিন্তু আমি মনে করি কোনো ক্রুশিয়াল নয়। দেশে একটি সংবিধান রয়েছে। তাই কারও মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন যে, দেশের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা প্রয়োগ করে সংবিধানের আলোকে একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। আগামী দিনের কঠিন সময় মোকাবেলার সাহস আর দৃঢ়তা নিয়েই মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে হচ্ছে। বিগত দুই দশকে যে ক’জন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ পদ অলঙ্কৃত করেছেন এবং বঙ্গভবনে যাতায়াত আছে-তারা মনে করেন, মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তাদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট প্রেসিডেন্ট।
তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাস বলছে, প্রবল বিরুদ্ধ স্রোতে স্বকীয়তা উড্ডীন রাখার মানসিক শক্তি তাঁর রয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে ওঠা, কারাবরণ এবং পরবর্তী পেশাগত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। দেশ প্রেমেও তিনি পরীক্ষীত। মানুষ তাই প্রত্যাশা করে, জাতির সঙ্কটে, সন্ধিক্ষণে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতবিহ্বল তিনি হবে না। অবশ্য দলীয় লোক-জন মনে করেন, রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে তিনি ভাঙবেন না, মচকাবেনও না। স্বাধীন দেশের সৃষ্টি, বৈরী সময়ে দলে অবদান রাখা এই ব্যক্তিটিকে দল দীর্ঘদিন কিছু না দিলেও রুষ্ঠ ছিলেন না দলের প্রতি। আলোচনার বাইরে থেকে হঠাৎ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে হতচকিত হতে দেখা যায়নি। বরং তার অভিব্যাক্তিতে ঠিকরে পড়েছে শোকরানা। অবিচল আস্থাও লক্ষ্য করা গেছে মহান আল্লাহর প্রতি। তাঁর ভাষায়, ‘যা কিছু হয়েছে সবই আল্লাহর ইচ্ছা’য়। কে ই বা জানে, রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে তাঁকে দিয়ে মহৎ কিছু ঘটানোর লক্ষ্যে মহান আল্লাহই হয়তো তাঁকে বাংলাদেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাব্যস্ত করে রেখেছেন! মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনও হয়তো এ সময়টির জন্য নিভৃতে নির্মাণ করেছেন নিজেকে ! একজন সাহাবুদ্দিনের গড়ে ওঠা : ১৯৬৬ সাল। অত্র ভূÑখ-ের মুক্তির সনদ ছয় দফা নিয়ে আলোচনা তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গেলেন পাবনায়। তখনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিশোর মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের প্রথম সাক্ষাৎ। আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ সাহাবুদ্দিনকে ‘তুই’ সম্বোধন করলেন। বললেন, ‘মাঠে আয়’! সেই যে রাজনীতির মাঠে আসা, আর ঘরে ফেরা হয়নি তার। পরবর্তী ৬ দশকে ছাত্ররাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষে বাংলাদেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া।
১৯৪৯ সালে পাবনা নগরীর জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) তার জন্ম। শৈশব কেটেছে পাবনায়ই। নগরীর পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন ক্লাস ফোরে। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি । এ সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে থাকা মো. সাহাবুদ্দিন মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। ছাত্রলীগে সম্পৃক্ততার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বে আসেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ওই বছর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের পর পাবনা শহরে প্রতিবাদে ঝলসে ওঠেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। প্রতিবাদ করার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কারামুক্তির পর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
আইনজীবী হলেও পেশাগত জীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে মুন্সেফ হিসেবে (সহকারি জজ) যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি। বিচারাঙ্গনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এরমধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদও অলঙ্কৃত করেছেন। বিচারক পদে থেকেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারক জীবনের ইতি টেনে ফিরে যান আইন পেশায়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থাকা কালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) নিয়োগ দেন। এ সময় তিনি দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ৫ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৬ সালে তিনি অবসরে যান। পরে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এ দু’টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। কর্মমুখর মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন একদিকে যেমন কঠোর ব্যক্তিসত্ত্বা ধারণ করেন, তেমনি সদালাপী, বন্ধুবৎসল, উদার মনোবৃত্তির বাহক। স্ত্রী রেবেকা সুলতানা, ছেলে ব্যাংকার ও চিত্রনায়ক আরশাদ আদনান (রনি) এবং এক নাতি নিয়ে তার সংসার। বাস করেন গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৪ এপ্রিল ১১টায় দেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব
সুমি/হককথা