নিউইয়র্ক ০৬:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

‘অনেক সূর্যের আশায়’ মান্না

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৫৬:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ৬৫ বার পঠিত

এনাম আবেদীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর পর দুইবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মতো সৌভাগ্যবান ছাত্রনেতা একমাত্র মাহমদুর রহমান মান্না। এর আগে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তাঁর ওই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি। পরে আওয়ামী লীগের মতো দলের তিনি ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই মান্না এখন আছেন আর্থিক সংকটে। তবে এতে হতাশ নন তিনি। ৫২ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এমপি বা মন্ত্রী হতে না পারার কারণেও নিজেকে ব্যর্থ ভাবেন না তিনি।
মান্না ঢাকা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং ২০১৮ সালে বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনে মান্নার প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান মান্না আমার বন্ধু। আমরা একই সময়ে রাজনীতি করেছি। রাজনীতির পাশাপাশি তার সঙ্গে আমার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’
ওবায়দুল কাদের

একজন কলামিস্ট মান্না সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকার সময় ‘অনেক সূর্যের আশা’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মান্না। সেই অনেক সূর্যের আশা মেটাতে গিয়ে তিনি নিজে নক্ষত্র হয়ে রাজনীতির কক্ষপথে ছুটে বেড়িয়েছেন। কখনো সমাজতন্ত্র, কখনো পুঁজিতন্ত্র, কখনো মুজিববিরোধী, কখনো মুজিবপন্থী, কখনো রাজাকারবিরোধী, কখনো রাজাকারের জোটের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যের শিকা ছিঁড়তে ছিঁড়তেও ছেঁড়েনি। না পেরেছেন মন্ত্রী হতে, না পেরেছেন এমপি হতে। এমনকি ঢাকার মেয়র হওয়ার আশাও তাঁর পূরণ হয়নি। এখন তিনি কক্ষচ্যুত নক্ষত্র।”
অবশ্য মান্না ‘কক্ষচ্যুত নক্ষত্র’ কি না, এ নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ আছে। আর ভাগ্যের শিকা না ছেঁড়া প্রসঙ্গে মান্না বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ জীবনে একাধিকবার পেয়েও গ্রহণ করিনি। ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমল থেকে পর পর তিনটি সরকার আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন একটি আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ ছিলাম, যার সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি বেমানান ছিল বলে মনে করেছি।’ তিনি বলেন, ‘পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু শিকা না থাকলেও শিকা ছেঁড়ে- এমন তো আওয়ামী লীগে হচ্ছে!’
‘আমি মনে করেছি আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে অন্যায় করছে। ফলে তাদের সঙ্গে থাকিনি। ভাগ্যের শিকা ছিঁড়লেও সেটি হয়তো নিচে পড়ে গেছে। আমার মাথা পর্যন্ত আসেনি। কারণ আমি তো সরে গেছি। আমি মোটেও হতাশ নই’ যোগ করেন মান্না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসা ও আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মান্না না পারছেন দল চালাতে, না পারছেন নিজে ঠিকমতো চলতে। করোনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তোপখানা রোডে তাঁর অফিস ভাড়াও বাকি পড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতেও হতাশ নন মান্না। তিনি বলেন, ‘অনেকেই এমপি-মন্ত্রী আছেন বা ছিলেন। হয়তো তাঁদের টাকা-পয়সা আছে। সামাজিক সম্মান ও ভালোবাসার দিক দিয়ে তাঁরা আমার অনেক পেছনে আছেন বলে মনে করি।’
মাহমদুর রহমান মান্না

আর্থিক সংকটের কথা স্বীকার করে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মান্না বলেন, ‘আমি ব্যবসা করতাম। কিন্তু সরকারের রোষানলে পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। গত ১২ বছরে কর্তৃত্ববাদী সরকার না থাকলে সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্তত ব্যবসা করে খেতে পারতাম।’ তিনি বলেন, ‘নতুন করে ব্যবসা গড়ে তুলতে পারিনি। একটি কোল্ড স্টোরেজ ছিল, এখনো আছে। সেখানে পার্টনার আওয়ামী লীগের একজন নেতা। কিন্তু ওই জায়গা থেকে একরকম বঞ্চিতই বলা যায়।’ ‘ওখান থেকে প্রাপ্য আদায় করতে গেলে আমার যে প্রশাসনিক সাপোর্টটা লাগবে, সেটা আমি পাব না। একটি সিএনজি স্টেশন আছে। হাইকোর্টে জয়লাভ করেও আজ পর্যন্ত সংযোগ পাইনি’ অভিযোগ করেন মান্না।
কথায় কথায় তিনি আরো বলেন, ‘আগে লেখালেখি ও টক শো থেকে কিছু আয় ছিল। সরকারের অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ লেখাও ছাপে না, টক শোতেও ডাকে না।’
গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। বিএনপি নির্ভর ওই জোট গঠনে মান্না গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন মান্না সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘আমার সঙ্গে আছেন, ভালো মানুষ এই আরকি!’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্টও অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে মান্না তাঁর নিজের দল নিয়ে বেশ তৎপর রয়েছেন। নাগরিক ঐক্য গঠনের আগে মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরুও হয়েছিল ছাত্রলীগ দিয়ে। তবে তিনি সব সময়ই জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবের অনুসারী ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি ছাত্রলীগের একটি প্যানেল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। পরে জাসদ গঠিত হলে রোমাঞ্চের নেশায় অন্য অনেক তরুণের সঙ্গে মান্নাও চলে যান ওই দলে। ছাত্ররাজনীতিতে মান্নার প্রতিভা দেখে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন জাসদ নেতা আ স ম রব তাঁক ঢাকায় কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। ওই বছরই মাত্র ২২ বছর বয়সে মান্না জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জেএসডির সভাপতি আ স ম রব বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের মধ্যে মান্নাও একজন। শুধু রাজনীতির কারণে তিনি নির্যাতনের শিকার ও কারাবরণ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘৫০ বছর ধরে মান্না নিজেকে নিরন্তর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রেখেছেন। কোনো অবস্থায়ই গণমানুষের স্বার্থ তিনি পরিত্যাগ করেননি।’
১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ ও ১৯৮০ সালে বাসদ ছাত্রলীগ থেকে পর পর দুই মেয়াদে ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন মান্না। দুইবারই তাঁর সঙ্গে জিএস নির্বাচিত হন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক এমপি আখতারুজ্জামান।
বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের মতে, ‘বাম রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তন এবং বিপ্লব করা। এমপি হওয়া কারো লক্ষ্য হতে পারে না। তা ছাড়া মান্না ভাইর প্রাপ্তি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখনো অটুট আছে। তবে এটি ঠিক যে ডাকসুতে ‘মান্না-আখতার পরিষদ’ তখন ছাত্রসমাজের দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।’
নব্বইয়ের দশকে মান্না বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। এরপর একসময়ের জাসদ নেতা মির্জা সুলতান রাজার নেতৃত্বে জনতা মুক্তি পার্টি গঠিত হলে মান্না তাতে যোগ দেন। ওই দল ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে বিলুপ্ত হলে মান্নাও ওই দলে যোগ দেন। বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে মান্না তখন জানান, ‘শেখ হাসিনাই আমাকে ডেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলেছিলেন। সে সময় আমার মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগই ভালো দল।’
এরপর মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তবে এক-এগারোর সময় ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে তাঁর নামও আলোচনায় উঠে আসে। এ কারণে ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে তিনি বাদ পড়েন। দলবিযুক্ত মান্নাকে এরপর বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও টক শোতে নাগরিক সমাজের হয়ে অংশ নিতে দেখা যায়। ২০১২ সালে তিনি ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল হিসেবে দলটি এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে। খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ব্যাপারে মান্না সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তবে প্রস্তাব পাওয়ার পরও দল পরিবর্তন করে সরাসরি বিএনপিতে যোগদান করতে রাজি হননি মান্না। ২০১৯ সালের মে মাসে মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়ন দিয়ে মান্নাকে বিএনপিতে নেওয়ার প্রকাশ দেখান তারেক রহমান। তবে মান্না বলেন, ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আছি। কিন্তু আদর্শিক ঐক্য না হলে দলবদলের প্রশ্নই ওঠে না।’
বিএনপি জোটে যাওয়ার আগে নিউইয়র্কে অবস্থান করা দলটির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিফোন আলাপের অডিও ক্লিপ প্রকাশ হলে ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারী মান্না গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে ওই বছরের ৫ মার্চ ও ২৪ ফেব্রæয়ারী গুলশান থানায় পৃথক মামলা হয়। ২২ মাস কারাভোগের পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি মুক্তি পান।
আশির দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটিই অপছন্দের দল ছিল মান্নার। ওই সময় জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নেওয়ার প্রশ্নে জাসদের একাংশের তীব্র আপত্তি ছিল। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই উপদলের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি একটি নতুন ¯েøাগান উদ্ভাবন করেন : ‘রুখো বাকশাল হটাও জিয়া/টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।’
জাসদ থেকে মান্নার পরবর্তী দল বাসদ-এর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান মনে করেন, ‘মান্না একজন সুবক্তা, ভালো সংগঠক এবং একসময় তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও সমাজতন্ত্রের মূল অঙ্গীকার তিনি ধরে রাখতে পারেননি।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

‘অনেক সূর্যের আশায়’ মান্না

প্রকাশের সময় : ০৬:৫৬:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ ডিসেম্বর ২০২০

এনাম আবেদীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর পর দুইবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মতো সৌভাগ্যবান ছাত্রনেতা একমাত্র মাহমদুর রহমান মান্না। এর আগে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তাঁর ওই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি। পরে আওয়ামী লীগের মতো দলের তিনি ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই মান্না এখন আছেন আর্থিক সংকটে। তবে এতে হতাশ নন তিনি। ৫২ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এমপি বা মন্ত্রী হতে না পারার কারণেও নিজেকে ব্যর্থ ভাবেন না তিনি।
মান্না ঢাকা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং ২০১৮ সালে বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনে মান্নার প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান মান্না আমার বন্ধু। আমরা একই সময়ে রাজনীতি করেছি। রাজনীতির পাশাপাশি তার সঙ্গে আমার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’
ওবায়দুল কাদের

একজন কলামিস্ট মান্না সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকার সময় ‘অনেক সূর্যের আশা’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মান্না। সেই অনেক সূর্যের আশা মেটাতে গিয়ে তিনি নিজে নক্ষত্র হয়ে রাজনীতির কক্ষপথে ছুটে বেড়িয়েছেন। কখনো সমাজতন্ত্র, কখনো পুঁজিতন্ত্র, কখনো মুজিববিরোধী, কখনো মুজিবপন্থী, কখনো রাজাকারবিরোধী, কখনো রাজাকারের জোটের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যের শিকা ছিঁড়তে ছিঁড়তেও ছেঁড়েনি। না পেরেছেন মন্ত্রী হতে, না পেরেছেন এমপি হতে। এমনকি ঢাকার মেয়র হওয়ার আশাও তাঁর পূরণ হয়নি। এখন তিনি কক্ষচ্যুত নক্ষত্র।”
অবশ্য মান্না ‘কক্ষচ্যুত নক্ষত্র’ কি না, এ নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ আছে। আর ভাগ্যের শিকা না ছেঁড়া প্রসঙ্গে মান্না বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ জীবনে একাধিকবার পেয়েও গ্রহণ করিনি। ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমল থেকে পর পর তিনটি সরকার আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন একটি আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ ছিলাম, যার সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি বেমানান ছিল বলে মনে করেছি।’ তিনি বলেন, ‘পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু শিকা না থাকলেও শিকা ছেঁড়ে- এমন তো আওয়ামী লীগে হচ্ছে!’
‘আমি মনে করেছি আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে অন্যায় করছে। ফলে তাদের সঙ্গে থাকিনি। ভাগ্যের শিকা ছিঁড়লেও সেটি হয়তো নিচে পড়ে গেছে। আমার মাথা পর্যন্ত আসেনি। কারণ আমি তো সরে গেছি। আমি মোটেও হতাশ নই’ যোগ করেন মান্না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসা ও আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মান্না না পারছেন দল চালাতে, না পারছেন নিজে ঠিকমতো চলতে। করোনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তোপখানা রোডে তাঁর অফিস ভাড়াও বাকি পড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতেও হতাশ নন মান্না। তিনি বলেন, ‘অনেকেই এমপি-মন্ত্রী আছেন বা ছিলেন। হয়তো তাঁদের টাকা-পয়সা আছে। সামাজিক সম্মান ও ভালোবাসার দিক দিয়ে তাঁরা আমার অনেক পেছনে আছেন বলে মনে করি।’
মাহমদুর রহমান মান্না

আর্থিক সংকটের কথা স্বীকার করে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মান্না বলেন, ‘আমি ব্যবসা করতাম। কিন্তু সরকারের রোষানলে পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। গত ১২ বছরে কর্তৃত্ববাদী সরকার না থাকলে সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্তত ব্যবসা করে খেতে পারতাম।’ তিনি বলেন, ‘নতুন করে ব্যবসা গড়ে তুলতে পারিনি। একটি কোল্ড স্টোরেজ ছিল, এখনো আছে। সেখানে পার্টনার আওয়ামী লীগের একজন নেতা। কিন্তু ওই জায়গা থেকে একরকম বঞ্চিতই বলা যায়।’ ‘ওখান থেকে প্রাপ্য আদায় করতে গেলে আমার যে প্রশাসনিক সাপোর্টটা লাগবে, সেটা আমি পাব না। একটি সিএনজি স্টেশন আছে। হাইকোর্টে জয়লাভ করেও আজ পর্যন্ত সংযোগ পাইনি’ অভিযোগ করেন মান্না।
কথায় কথায় তিনি আরো বলেন, ‘আগে লেখালেখি ও টক শো থেকে কিছু আয় ছিল। সরকারের অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ লেখাও ছাপে না, টক শোতেও ডাকে না।’
গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। বিএনপি নির্ভর ওই জোট গঠনে মান্না গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন মান্না সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘আমার সঙ্গে আছেন, ভালো মানুষ এই আরকি!’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্টও অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে মান্না তাঁর নিজের দল নিয়ে বেশ তৎপর রয়েছেন। নাগরিক ঐক্য গঠনের আগে মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরুও হয়েছিল ছাত্রলীগ দিয়ে। তবে তিনি সব সময়ই জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবের অনুসারী ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি ছাত্রলীগের একটি প্যানেল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। পরে জাসদ গঠিত হলে রোমাঞ্চের নেশায় অন্য অনেক তরুণের সঙ্গে মান্নাও চলে যান ওই দলে। ছাত্ররাজনীতিতে মান্নার প্রতিভা দেখে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন জাসদ নেতা আ স ম রব তাঁক ঢাকায় কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। ওই বছরই মাত্র ২২ বছর বয়সে মান্না জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জেএসডির সভাপতি আ স ম রব বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের মধ্যে মান্নাও একজন। শুধু রাজনীতির কারণে তিনি নির্যাতনের শিকার ও কারাবরণ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘৫০ বছর ধরে মান্না নিজেকে নিরন্তর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রেখেছেন। কোনো অবস্থায়ই গণমানুষের স্বার্থ তিনি পরিত্যাগ করেননি।’
১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ ও ১৯৮০ সালে বাসদ ছাত্রলীগ থেকে পর পর দুই মেয়াদে ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন মান্না। দুইবারই তাঁর সঙ্গে জিএস নির্বাচিত হন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক এমপি আখতারুজ্জামান।
বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের মতে, ‘বাম রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তন এবং বিপ্লব করা। এমপি হওয়া কারো লক্ষ্য হতে পারে না। তা ছাড়া মান্না ভাইর প্রাপ্তি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখনো অটুট আছে। তবে এটি ঠিক যে ডাকসুতে ‘মান্না-আখতার পরিষদ’ তখন ছাত্রসমাজের দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।’
নব্বইয়ের দশকে মান্না বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। এরপর একসময়ের জাসদ নেতা মির্জা সুলতান রাজার নেতৃত্বে জনতা মুক্তি পার্টি গঠিত হলে মান্না তাতে যোগ দেন। ওই দল ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে বিলুপ্ত হলে মান্নাও ওই দলে যোগ দেন। বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে মান্না তখন জানান, ‘শেখ হাসিনাই আমাকে ডেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলেছিলেন। সে সময় আমার মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগই ভালো দল।’
এরপর মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তবে এক-এগারোর সময় ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে তাঁর নামও আলোচনায় উঠে আসে। এ কারণে ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে তিনি বাদ পড়েন। দলবিযুক্ত মান্নাকে এরপর বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও টক শোতে নাগরিক সমাজের হয়ে অংশ নিতে দেখা যায়। ২০১২ সালে তিনি ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল হিসেবে দলটি এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে। খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ব্যাপারে মান্না সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তবে প্রস্তাব পাওয়ার পরও দল পরিবর্তন করে সরাসরি বিএনপিতে যোগদান করতে রাজি হননি মান্না। ২০১৯ সালের মে মাসে মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়ন দিয়ে মান্নাকে বিএনপিতে নেওয়ার প্রকাশ দেখান তারেক রহমান। তবে মান্না বলেন, ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আছি। কিন্তু আদর্শিক ঐক্য না হলে দলবদলের প্রশ্নই ওঠে না।’
বিএনপি জোটে যাওয়ার আগে নিউইয়র্কে অবস্থান করা দলটির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিফোন আলাপের অডিও ক্লিপ প্রকাশ হলে ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারী মান্না গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে ওই বছরের ৫ মার্চ ও ২৪ ফেব্রæয়ারী গুলশান থানায় পৃথক মামলা হয়। ২২ মাস কারাভোগের পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি মুক্তি পান।
আশির দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটিই অপছন্দের দল ছিল মান্নার। ওই সময় জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নেওয়ার প্রশ্নে জাসদের একাংশের তীব্র আপত্তি ছিল। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই উপদলের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি একটি নতুন ¯েøাগান উদ্ভাবন করেন : ‘রুখো বাকশাল হটাও জিয়া/টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।’
জাসদ থেকে মান্নার পরবর্তী দল বাসদ-এর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান মনে করেন, ‘মান্না একজন সুবক্তা, ভালো সংগঠক এবং একসময় তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও সমাজতন্ত্রের মূল অঙ্গীকার তিনি ধরে রাখতে পারেননি।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ)