অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান
- প্রকাশের সময় : ০১:৫২:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
- / ৭৭ বার পঠিত
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: অদৃশ্য শক্তির প্রভাববলয়ে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে ঢাকা ওয়াসার বহুল সমালোচিত, দুর্নীতির আইকন খ্যাত সাবেক এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী এই দুর্নীতিবাজ এখনো গ্রেফতার না হওয়ায় অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিরপরাধ লোকদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেলেও তাকসিমের ক্ষেত্রে সেটির সিকি ভাগও দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তিনি দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, দুর্নীতির বরপুত্র তাকসিম এ খানের স্বেচ্ছাচারিতার কুফল হিসেবে বিদেশী ঋণের ভারে ডুবতে বসেছে সংস্থাটি। প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের ভার এখন ওয়াসার ঘাড়ে। সূত্র মতে, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে। টানা ১৫ বছর এমডি পদে থেকে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে নিজের তহবিলের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন এবং এই দীর্ঘ সময়ে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বারবার তদন্তের নামে মূলত নাটক মঞ্চস্থ করেছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সেও পালিয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তাকসিম এ খানের দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কিছুদিন আগে বলেন, স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিকভাবে উত্থাপিত হলেও প্রতিকারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
অন্তর্র্বর্তী সরকার আসার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় জনমনে নানা সন্দেহ সংশয় দেখা দিয়েছে। তাকে কোনো মহল আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে কি-না এটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দেশ ছাড়ার শুরুর দিকে প্রকৌশলী তাকসিম টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন দেখে পদত্যাগ করেন। গত ১৫ আগস্ট অনলাইনে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন তাকসিম। তাতে অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন। গণঅভ্যুত্থানের পর এই সময়ের মধ্যে তিনি রাজধানী ঢাকাতেই ছিলেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে তার অবস্থান কোথায় সেটি জানা না গেলেও তিনি যে দেশেই আছেন সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঢাকার দৈনিক সংগ্রাম এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরের অংশবিশেষ
সূত্র মতে, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়তে থাকে তার। এর মধ্যে তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে সর্বমহলে নানা অভিযোগ উঠে। কিন্তু তাকে সরানো যায়নি। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সপ্তমবারের মতো ওই পদে আরো তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি।
তাকসিমের আমলে ঢাকা ওয়াসায় বৈদেশিক ঋণের টাকায় কয়েকটি বড় প্রকল্প নেয়া হয়। এর ফলে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং বাস্তবায়নের পর তা চালু করতে না পারার মতো কারণে সংস্থাটির ব্যয় বেড়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, যদি দ্রæত কাজ করে প্রকল্পগুলোকে ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত তবে ওয়াসার সেবায় পরিবর্তন সম্ভব ছিল। যা কাজ হয়েছে তাতে পানি ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ সালের তুলনায় সেবার মান বেড়েছে। যদিও সঙ্গে সঙ্গে পানির দামও বেড়েছে ১৪ বার। তবে এখনো পানি ঘাটতি প্রায় ৪০ কোটি লিটার।
জানা যায়, তাকসিম এ খান, তার স্ত্রী ও সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শহরে তার ১৪টি বাড়ি কিনে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বলেও প্রচার রয়েছে। চাকরিজীবনে গুলশান-২-এর ৫৫ নম্বর সড়কে সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। থাকতেন নয়াপল্টনে শ্বশুরবাড়িতে। মাসিক বেতন ছিল ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে একলাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয় পৌনে দুই লাখ টাকা। তথ্য মতে, তাকসিম খানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট রয়েছে।
তাকসিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে। এর পরও তাকে দীর্ঘদিন একই পদে রাখা হয়। গত ১৫ বছরে ওয়াসায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় ছিলেন তাকসিম খান। ওয়াসা আইন ১৯৯৬ অনুযায়ী, বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ওয়াসা পরিচালিত হওয়ার কথা। তবে তাকসিম অনেক ক্ষেত্রে বোর্ডকে এড়িয়ে কাজ করেছেন। এ নিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার বিরোধও দেখা দেয়। তবে তাকসিমের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সদস্যরা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়ন, পানি ও পয়োবিলের টাকা থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি করা হয়েছে। এতে করে প্রকল্পগুলো রুগ্ন হয়ে পড়েছে, যেখানে এখন শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে সংস্থাকে।
জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না তাকসিম এ খানের। তবু ২০০৯ সালে তৎকালীন ওয়াসা বোর্ড তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে এমডি পদে বসানো হয়। সেই থেকে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিমের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়। এরপর ওয়াসায় শুরু হয় তাকসিম আমল। গত ১৫ বছরে তার বিরুদ্ধে ছয় হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পলায়নকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে শত দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও তাকসিম এই পদে দাপটের সঙ্গে ছিলেন।
জানা গেছে, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে বলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার অজুহাতে বড় বড় প্রকল্প নেন তাকসিম। এরপর বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। পানির চাহিদা মেটানোর কথা উল্লেখ করে ২০১৯ সালের জুনে ‘পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প’ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের সময় জানানো হয়, এই পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে। খরচ করা হয় তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ফল না এলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ঋণ করতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়োবিলের তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তাকসিমচক্র। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। শোধনাগারের প্লান্ট চালু রাখতে হাতিরঝিলের ময়লা পানি সেখানে নিয়ে শোধন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা, ২০২৭ সালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮২৫ কোটি টাকা।
পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পেও হয়েছে দুর্নীতি। মূল সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নি¤œমানের পানি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। হিসাব মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। সমবায় আইন অমান্য করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি থেকে ৬২১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এ ছাড়া সমিতির মালপত্র বিক্রি করা হয়েছে। এর আনুমানিক মূল্যও প্রায় শতকোটি টাকা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা লোপাটের প্রতিবেদন এসেছে। কিন্তু তাকসিম এ খানের ছত্রচ্ছায়ায় এই দুর্নীতি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সে সময়।
গত ২২ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আস-সামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। নিষেধাজ্ঞার আদেশে বলা হয়, তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করছে। দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাকসিম এ খান দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। তাকসিম এ খান বিদেশে পালিয়ে গেলে অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত বা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাবেক ওয়াসা এমডির দুর্নীতির বিষয়ে বর্তমান ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমান বলেন, সাবেক এমডির বিরুদ্ধে আমরাও অনেক অভিযোগ শুনেছি। এখনো শুনছি। এ বিষয়ে দুদক থেকে যে তথ্য চাওয়া হচ্ছে তা আমরা দ্রæত দিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ওয়াসায় যারাই দুর্নীতির সাথে জড়িত, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের ১৭ মে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে চিঠি লিখেছিলাম। মন্ত্রণালয় তার তদন্ত না করে উপরন্তু চার দিনের মাথায় আমাকে সরিয়ে দেয়। দুর্নীতির টাকার জোরে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসায় প্রকৌশলী তাকসিমের সময়ে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা খুবই পরিষ্কার। পদ্মা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে সঠিক তদন্ত করলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। (দৈনিক সংগ্রাম)