৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীসহ বাংলাদেশে ছোট-বড় নদী প্রায় ৬০০টি: ৫৪ নদীর উৎস ভারত : তারপরও পানির জন্য হাহাকার

- প্রকাশের সময় : ১০:০৯:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ ২০১৫
- / ১৩৯২ বার পঠিত
ঢাকা: ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে দেশের গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্পের ভবিষ্যত। ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহতা থেকে দেশের ২৩টি নদীকে বাঁচাতে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ভারতের কথামতো বাংলাদেশ বর্ষার পানি আটকাতে রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও এখন নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারছে না আপত্তি তোলায়। ভারত সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ নির্মাণ করে পানি আটকিয়ে রাখলে এর উল্টো স্রোত (ব্যাক ওয়াটার) ভারতীয় অংশে প্রবেশ করবে। এতে ভারতীয় অংশে নদী ভাঙ্গন তীব্র হবে এবং অকাল বন্যা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের এই আপত্তি নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারছে না।
ভারতের এমন আপত্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে, গঙ্গা ব্যারাজের ব্যাক ওয়াটার সর্বোচ্চ পাকশী ভেড়ামারা পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্ত তা কোনোভাবেই ভারতীয় অংশে প্রবেশ করবে না। এরপরও দিল্লির অনুমতি মেলেনি। ফলে স্বপ্নের গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের ভবিষ্যত এখন অন্ধকার। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশের অন্যান্য নদ-নদীর ক্ষেত্রেও। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রক্ষপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা, ইছামতি, গড়াই, ফেনী, মহুরি, তিস্তা, করতোয়া, সুমেশ্বরী, ধরলা, দুধকুমার, মাতামুহুরি, কপোতাক্ষ, মহানন্দাসহ দেশের সকল নদী শুকিয়ে গেছে। তিস্তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, এই নদীতে এখন পানি পাওয়া যাচ্ছে ৩শ’ কিউসেকেরও নিচে। অথচ গত বছরও এই সময়ে তিস্তায় ৮শ’ থেকে ১ হাজার কিউসেক পানি পাওয়া গেছে। পানির এই দুরাবস্থায় গোটা দেশ আজ পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে। এতে করে নদী অববাহিকার মানুষগুলোকে এখন মাটির নিচের পানির ওপর নির্ভর করে সেচ কাজ চালাতে হচ্ছে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে দেশের বনাঞ্চল ধ্বস হচ্ছে, আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে পানি দূষণ। পানির জন্য দেশজুড়ে যখন এই হাহাকার; ঠিক এমন একটি সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ২২ মার্চ পালিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক পানি দিবস’।
গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প: এই প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ। রিপোর্টও পেশ হয়েছে। এরকম জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিতে আশ্বাসও দিয়েছে মালয়েশিয়া ও চীন সরকার। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে শুরু করা যাচ্ছে না বিকল্প ‘গঙ্গা ব্যারেজ’ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এই ব্যারাজের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। ব্যারেজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের আদলে। ব্যারাজ থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল রিজার্ভার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে ২৯শ’ মিলিয়ন মিটার কিউব। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা গেছে, ব্যারাজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ছাড়া হবে। এর ফলে গঙ্গানির্ভর ২৩ টি নদী শুষ্ক মৌসুমে ফিরে পাবে নাব্য। সেইসাথে গঙ্গা অববাহিকার ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি সরাসরি সেচের আওতায় চলে আসবে। এই ব্যারাজ নির্মাণ হলে আয় হবে প্রতি বছর ৭ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদে এই আয় আরও বৃদ্ধি পাবে। ব্যারাজের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২১শ’ মিটার। এর গেট থাকবে ৯৬টি। ফিস পাশ থাকবে ২টি এবং নেভিগেশন লক থাকবে ১টি। এছাড়াও থাকবে একটি পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখান থেকে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এই ব্যারাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে ১২ মাসই পানির প্রবাহ কন্ট্রোল করা যাবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসবে। দেশ রক্ষা পাবে মরুময়তা ও লবণাক্তের কবল থেকে। পরিবেশে ফিরে আসবে ভারসাম্য। ব্যারাজটি নির্মাণ হলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যায় কিনা-এটিও খুঁজে দেখা হবে। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে এই ব্যারাজ নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কপোতাক্ষ নদে ইটভাটা: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত দুগ্ধ ¯্রােতরূপী কপোতাক্ষ নদ আজ মরা খাল। অস্তিত্ব সংকটে পড়া এ নদের বুক জুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর। পানি নেই, ¯্রােত নেই। নদের বুকে আবাদ হচ্ছে ইরি-বোরোর। চাষ করা হচ্ছে মাছের। অনেকে ইটভাটা. বাড়ি-ঘর করছেন ভরাট হওয়া নদের বুকে। অবৈধ দখলে প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রভাবশালীরা। অথচ এক সময় এ নদের ভরা যৌবন ছিল। ছিল উত্তাল তরঙ্গ। বুক চিরে চলাচল করত বড় বড় নৌকা, লঞ্চ, কার্গো, জাহাজ। কালের আবর্তে নতুন প্রজন্মের কাছে এই নদ এখন শুধুই স্মৃতি।
এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ভালো হওয়ায় ব্রিটিশ আমলেই গড়ে ওঠে খুলনার পাইকগাছা, কপিলমুনি, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেঠুয়া, মাগুরা, পাটকেলঘাটাসহ কয়েকটি বাণিজ্য কেন্দ্র। নদী পথে কম খরচে সহজে পণ্য পরিবহনের সুবিধা থাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি গড়ে ওঠে ছোট ছোট কুটিরশিল্প, কল-কারখানা। এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কপোতাক্ষকে ব্যবসায়িক নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করতেন। নদীপথে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেকাংশে তাদের সাশ্রয় হতো। কিন্তু নাব্য সংকটের কারণে এসব শিল্প কারখানা, বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো ধ্বংসের পথে। কাগজ-কলমে কপোতাক্ষ নদ থাকলেও বাস্তবে একটি ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করতে পারে না এই নদ দিয়ে। দ’ুধারে অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় সংকুচিত হয়ে গেছে নদ। তার উপর দিয়ে অনেকে সাইকেল, ভ্যান, চালিয়ে যাচ্ছেন। পলি জমে নদের পানি শূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে।
নাব্য সঙ্কটে যমুনা: ভয়াবহ নাব্য সঙ্কটের কবলে যমুনা নদী। চারিদিকে শুধু ধু ধু বালুরচর। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল থেকে শুরু করে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত শুধু চর আর চর। শুস্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই (১ জানুয়ারী থেকে ৩১ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম) যমুনার পানির সমতল (লেভেল) স্মরণকালের সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে গেছে। নদীর পানি এভাবে কমে যাওয়ায় শঙ্কিত পানি বিশেষজ্ঞরা। আর পরিবেশবিদরা বলছেন, যমুনার বুকে যে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাতে ভয়াবহ মরুকরণের কবলে পড়বে বাংলাদেশ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যেসব এলাকায় গেল বছরও লোলিফট পাম্প ব্যবহার করে সেচ কাজ চালানো হতো; এই শুষ্ক মৌসুমে তাও সম্ভব হচ্ছে না। মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে। এতে করে অগভীর নলকূপেও এখন ঠিকমত পানি উঠছে না। সেচের এই অসহায়ত্ব নিয়ে শঙ্কিত কৃষি মন্ত্রনালয়। উদ্বিগ্ন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও। এমন পরিস্থিতিতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কাটা সরকারের বুকে বিঁধছে দারুণভাবে। ইরি-বোরো মৌসুমে যমুনা নদী অববাহিকার মানুষ ক্ষেতে ঠিকমত পানি দিতে না পারার যে যন্ত্রণা-তা শুধু কৃষকেই ভোগাবে না; দেশে খাদ্য সঙ্কটও প্রকট করবে-এমনটা আঁচ করছে সরকারও। এই নদীর নাব্য রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও; তা এখনো সমীক্ষা পর্যায়েই রয়ে গেছে। কোনো সুফল মেলেনি। বরং টাঙ্গাইলের নলীনে আড়াই কিলোমিটার এবং সিরাজগঞ্জে ২০ কিলোমিটার নদী খনন নিয়ে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যমুনা নদীর নাব্য রক্ষায় উজান থেকে যেসব নদীর মাধ্যমে পানি আসে-তার সবগুলো পথ দিয়েই পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারত একরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্রে ভয়াবহ নাব্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে যমুনা নদী। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পানির লেভেল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। জামালপুরে শুষ্ক মৌসুমে যমুনায় সর্বনিম্ন পানির রেকর্ড লেভেল মার্চে থাকে ১৩ দশমিক ৪ মিটার। আর এবার মধ্য মার্চে পানির লেভেল সর্বনিম্ন রেকর্ডেরও নিচে নেমে গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার বলেন, যমুনা নদীর পানির লেভেল এভাবে কমতে থাকলে পদ্মা নদীর মতো এই নদীর পানিতেও লবণাক্ততা দেখা দেবে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। একইসাথে মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাবে আশঙ্কাজনকভাবে। তিনি বলেন, যমুনা নদীতে এবার যেভাবে চর জেগে উঠেছে এবং পানির লেভেল যেহারে নামছে-তাতে করে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে।
তিস্তা এখন মরা খাল: চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তিস্তা নদী অববাহিকার মানুষগুলো। প্রত্যাশা একটাই ‘কখন বৃষ্টি হবে’। তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় এ বছর চরম দুরাবস্থার কবলে পড়েছে তিস্তা সেচ প্রকল্প। একসময়কার খর¯্রােতা তিস্তা এখন ‘মরা খাল’। পানির অভাবে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর ইরি-বোরো চাষের জমি এখন ৪ হাজার হেক্টরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই পরিমাণ জমিতেও সেচ দেয়া হচ্ছে রেশনিং পদ্ধতিতে। তিস্তা ব্যারাজের সকল গেট বন্ধ করে যে যৎসামান্য পানি জমছে-তাই প্রধান খালে প্রবেশ করানো হচ্ছে। ধানে ফুল আসার পর পর্যাপ্ত পানি পেতে বৃষ্টিই শেষ ভরসা। ওই সময় বৃষ্টি না হলে চিঁটায় (ধানের মধ্যে চাল থাকবে না) ভরে যাবে খেতের ফসল। তিস্তায় বর্তমানে ৩শ’ কিউসেকের নিচে পানি পাওয়া যাচ্ছে। তিস্তার ইতিহাসে এত কম পানি আর কখনোই পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তিস্তার পানিবণ্টন প্রসঙ্গে বলেছেন, কোনো সময়সীমা বেঁধে নয়; শিগগিরই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। তিনি আরো বলেন, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া কথা ও সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের আলোকেই এমনটি বলা যায়। তবে ওই চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ ঠিক কি পরিমাণ পানি পাবে এখনই তা বলা যাচ্ছে না।
পানি সম্পদমন্ত্রীর এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে মমতা ব্যানার্জি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক করেছেন। ভারতীয় মিডিয়া থেকে যেটুকু জানা গেছে-তাতে বাংলাদেশের জন্য আশার কিছু নেই। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কার্যত তাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ তিনি ঢাকায় তিস্তার পানিবন্টনের ব্যাপারে এদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছিলেন। সেই আশার গুড়ে এখন বালি।
এদিকে, পানির জন্য এখন তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় চলছে হাহাকার। রেশনিং পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে পানি। যেটুকু পানি পাওয়া যাচ্ছে ওই পানি সপ্তাহের প্রথম ৩ দিন দেয়া হচ্ছে মূল খালের ১ নম্বর রেগুলেটর সংলগ্ন জমিতে। পরের ২ দিন দেয়া হচ্ছে ২ নম্বর রেগুলেটর সংলগ্ন জমিতে এবং সপ্তাহের শেষ দু’দিন দেয়া হচ্ছে ৩ নম্বর রেগুলেটর সংলগ্ন জমিতে। এভাবেই মাত্র ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। গত বছরও সেচ দেয়া হয়েছিল ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ওই সময় তিস্তায় পানি পাওয়া গেছে গড়ে ১ হাজার কিউসেক।
ফলে তিস্তা সেচ প্রকল্পের সিংহভাগ জমিতে এবার সেচ দেয়া হচ্ছে ডিপটিউবওয়েল স্থাপন করে। এতে করে একর প্রতি সেচ ব্যয় দাঁড়াবে ৮ হাজার টাকারও বেশি। অথচ প্রতি বছর এই পরিমান সেচ দিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দিতে হতো মাত্র ৩২০ টাকা। এব্যাপারে স্থানীয় কৃষক আবদুল বাসেত বলেন, এবার বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, তার অনেক জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, এত বিপুল অর্থ খরচ করে তার পক্ষে আবাদ করা সম্ভব নয়।
ফেনী নদীর পানি নিচ্ছে ভারত: ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার জোরপূর্বক পানি তুলে নিচ্ছে। এই নদী থেকে কি পরিমাণ পানি ভারত তুলে নিচ্ছে-এর কোনো সঠিক তথ্যউপাত্ত সরকারের কাছে নেই। এ নিয়ে সরকারের ঊর্ধŸতন কর্মকর্তাদের কেউ কোনো কথাও বলছেন না। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মহুরি। তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে ভারত প্রত্যাহার করায় এই শুষ্ক মৌসুমে চরম বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে দেশের প্রধান সেচনির্ভর প্রকল্প তিস্তা। আর দ্বিতীয় বৃহত্তম জিকে সেচ প্রকল্পটিও হুমকির মুখে পড়ে পদ্মার পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায়। গঙ্গার পানি নিয়ে ভারতের সাথে ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি থাকার পরও সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি না পাওয়ায় জিকে প্রকল্পের এমন বেহাল দশা হয়েছে। এর প্রভাবে শুকিয়ে গেছে পদ্মাসহ সংশ্লিষ্ট অববাহিকা নির্ভর সকল শাখা নদী।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের মাঝামাঝি কালিদাস-পাহালিয়া, মুহুরী ও ফেনী নদীর মিলিত অববাহিকায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এই মুহুরী সেচ প্রকল্পের অবস্থান। ফেনী জেলার ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার আংশিক নিয়ে অত্র প্রকল্প এলকা বিস্তৃত। প্রকল্পের গ্রস এলাকা ৪০ হাজার ৮০ হেক্টর। আর চাষযোগ্য এলাকা ২৭ হাজার ১২৫ হেক্টর ও সেচযোগ্য এলাকা ২৩ হাজার ৭৬ হেক্টর। প্রতিবছরই পানির অভাবে এখানে ইরি-বোরো চাষের জমি কমছে। যার অন্যতম কারণ সেচ সুবিধার অভাব। ২০১১ সালে মহুরি প্রকল্পে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এই সুবিধা আরো কমেছে। চলতি বছর সর্বোচ্চ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দিতে পারবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পদ্মায় ধু ধু বালুচর: ফারাক্কার ভয়াবহ প্রভাবে পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে। চারদিকে শুধু ধু ধু বালুরচর। চরম হুমকির মুখে এই নদীর পানি নির্ভর গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প এটি। দেশের প্রধান সেচ প্রকল্প তিস্তার পর জিকে প্রকল্পের এই দুরাবস্থায় দেশের খাদ্য উৎপাদনে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে বৃষ্টিই পারে অসহায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটাতে। সেজন্য তিস্তা অববাহিকার কৃষকের মতো জিকে প্রকল্প এলাকার মানুষও প্রার্থনা করছে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ বলে।
অন্যদিকে, চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে ভারতকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে পানি কম পাওয়ার ব্যাপারে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়। এই চিঠির কথা স্বীকার করেছেন যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন। এব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আমরা পানি কম পাচ্ছি। আমরা চিঠি দিয়ে বলেছি, পানির প্রবাহ বাড়াতে। তার মতে, চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়ার কারণেই পদ্মায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে, চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়ায় পদ্মা নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। পদ্মায় পানি না থাকায় জিকে সেচ প্রকল্পের জন্য যেখানে পানি প্রয়োজন ৪ হাজার কিউসেক; সেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ২ হাজার ৫শ’ কিউসেক। গত দু’দিন ধরে পাম্পে ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে একটি পাম্প বন্ধ রাখা হয়েছে। আর দুটি পাম্প পর্যায়ক্রমে চালু রেখে পানি উঠানো হচ্ছে পদ্মার প্রধান সংযোগ খাল থেকে। ফলে পানি আরো কমে ২ হাজার কিউসেকের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো চাষ নিয়ে জিকে প্রকল্প এলাকার কৃষকের ভোগান্তি চরমে পৌঁছবে।
জিকে প্রকল্প এলাকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি এতটাই কমে গেছে যে, পদ্মার সংযোগ খালের উৎসমুখ থেকে ৮শ’ মিটার চর কেটে পানি আনতে হয়েছে। তাও এই পানি ঠিকভাবে পাম্পের গোড়ায় আসছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক কর্মকর্তা জানান, সংযোগ খালের উৎসমুখে পদ্মার পানির উচ্চতা ৪ দশমিক ৫ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। যা এ যাবতকালের সর্বনিম্ন রেকর্ড। অথচ গত বছরও এই সময়ে পদ্মায় পানির লেভেল ছিল প্রায় ৮ মিটার। এই অবস্থায় জিকে প্রকল্প টিকিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে এই কর্মকর্তা জানান।
পদ্মায় পানি কমে যাওয়ার কারণে জিকে প্রকল্পে কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আবদুর রব বলেছেন, এই প্রকল্পটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। দেশের খাদ্য উৎপাদনে এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই প্রকল্প এলাকার কৃষকরা যাতে আরো বেশি ধান উৎপাদন করতে পারে-এজন্য নানামুখী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রকল্প এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়ানো। এই পানির প্রবাহ কীভাবে বাড়ানো যায় এ নিয়ে একটি সমীক্ষা চলছে।
বিশ্বপানি দিবস: বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হলেও দেশের সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বাস করছেন। কারণ ১৬ কোটি মানুষের দেশটিতে ৯৭ ভাগ মানুষের পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হলেও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে না পারার কারণে এবং মৌসুম ভেদে পানি সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘিœত হচ্ছে, শিল্পোন্নয়ন ও কৃষি কাজও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় সারা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিবছর দেশেও পালিত হয়েছে ‘বিশ্বপানি দিবস’ (২২ মার্চ)। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘পানি এবং টেকসই উন্নয়ন’।
হু জানিয়েছে, বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর পানির উৎস ভারত থেকে বয়ে আসা অভিন্ন নদীর পানি। কিন্তু দেশটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ এবং পানি প্রাপ্যতা ভয়াবহভাবে কমেছে। মানুষের পানি প্রাপ্যতা এবং অপ্রাপ্যতাও ঋতুভেদে ওঠানামা করে। বর্ষায় পানির ঢল থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। এর প্রধান কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের কোনো নদীতেই বর্ষার পানি ধারণের ব্যবস্থা নেই। ফলে গ্রীষ্মে পানিপ্রবাহ কমে আসায় সমুদ্রের পানি উঠে আসছে উজানে। এতে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপরদিকে, পানির চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে বিশ্বে যে ১৫টি দেশ সবচেয়ে বেশি ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তাদের মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইরানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান চাহিদার চাপে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে গিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে বাধ্য হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। অন্যদিকে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হওয়ায় ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার সেভাবে বাড়ছে না। এ অবস্থায় মানুষের চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। পানির অভাবে চোখের সামনে দেশজুড়ে জালের মতো বিছিয়ে থাকা সব নদী একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। যা দেশকে স্থায়ী মরুকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি অপরিকল্পিত নদীশাসন, বাঁধ নির্মাণ, বড় নদীগুলোর সাথে ছোট শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি কারণেও দেশের নদীগুলো হুমকির মুখোমুখি।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। অনেকের মতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় নদী রয়েছে প্রায় ৬০০টি। এর মধ্যে ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক। যার ৫৪টিই এসেছে ভারত থেকে নেমে। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্য হারিয়েছে।(দৈনিক ইনকিলাব)