নিউইয়র্ক ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইন্তেকাল

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১২:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০১৯
  • / ৩১২ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: টানা ১০দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। রোববার (১৪ জুলাই) সকাল পৌনে ৮টায় তার মৃত্যুর ঘোষণা দেন সিএমএইচ-এর চিকিৎসকরা। এরশাদের রাজনৈতিক ও প্রেসসচিব এবং জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সুনীল শুভ রায়ও খবরটি নিশ্চিত করেছেন। আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান বলেন, রোববার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে এইচ এম এরশাদ মারা যান।

৯০ বছর বয়সী এরশাদ মাইডোলিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন, রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতায়ও ভুগছিলেন তিনি; সেই সাথে তার ফুসফুসে দেখা দিয়েছিল সংক্রমণ, কিডনিও কাজ করছিল না। ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি শনিবার বলেছিলেন, এরশাদের কোনো অঙ্গ আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। ‘প্রতিদিন ডাকলে চোখে মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ তা করেননি। আসলে তার বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে যে উন্নতি হওয়ার কথা তা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় আশির দশকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আট বছর দেশ শাসন করে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আগের সরকারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বপালনকারী এরশাদ বর্তমান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে ছিলেন।
এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে সিএমএইচে ছুটে যান। তার সঙ্গে ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদও (শাদ এরশাদ) ছিলেন। এরশাদের আরেক ছেলে এরিক এরশাদ রয়েছেন বারিধারায় তার বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্কে। এরিকের মা বিদিশার সঙ্গে প্রায় দেশ দশক আগে এরশাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
এরশাদের জানাজা ও দাফনের বিষয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি। দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, লাশ বারিধারার বাস ভবনে প্রথমে নেওয়া হবে, পরে নেওয়া হবে বনানীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।
গত কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এরশাদ। গত বছরের শেষ ভাগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব একটা দেখা যায়নি তাকে। এই সময়ে নিজের সম্পত্তি ট্রাস্টে দিয়ে যান তিনি। অসুস্থতার কারণে ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও বসিয়ে যান এরশাদ; যা নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশনের সমর্থকরা রুষ্ট ছিলেন বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
গত ২২ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হলে রাখা হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে।
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলসহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক অনেক ধারা সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত এরশাদ। ৯০ এর গণআন্দোলনের সময় তাকে নিয়েই ‘বিশ্ব বেহায়া’ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি, রাজনীতিতে একের পর এক ‘ডিগবাজি’ দিয়েও আলোচিত ছিলেন তিনি। তবে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের কাছে এরশাদ ছিলেন নায়কসম; তারা ‘পল্লীবন্ধু’ হিসেবেই ডাকতেন তাকে।
এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। অবিভক্ত ভারতে শিশুকাল কুচবিহারে কাটে তার। ভারত ভাগের পর তার পরিবার চলে আসে রংপুরে; পেয়ারা ডাকনামে পরিচিত এরশাদের পড়াশোনার শুরু রংপুরেই।
১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। তার ভাষ্য, তিনি বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে অনেকে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর মামা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়ার (বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী) সুপারিশে এরশাদকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফেরত নেয়া হয় বলে সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি; তখন তার পদমর্যাদা ছিল কর্নেল।
১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ অগাস্ট ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। ওই ঘটনার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে করা হয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান, মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে। পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদকে জিয়ার এই পদোন্নতি দেয়া তখন ভালো চোখে দেখেননি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের অব্যবহিত পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরশাদ। স্বৈরাচারবিরোধী প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। তাঁকে কারাবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের আমলে তিনি জামিনে মুক্ত হন।
২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। এরপর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সাংসদ হন। তিনি চলতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইন্তেকাল

প্রকাশের সময় : ০৮:১২:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০১৯

হককথা ডেস্ক: টানা ১০দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। রোববার (১৪ জুলাই) সকাল পৌনে ৮টায় তার মৃত্যুর ঘোষণা দেন সিএমএইচ-এর চিকিৎসকরা। এরশাদের রাজনৈতিক ও প্রেসসচিব এবং জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সুনীল শুভ রায়ও খবরটি নিশ্চিত করেছেন। আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান বলেন, রোববার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে এইচ এম এরশাদ মারা যান।

৯০ বছর বয়সী এরশাদ মাইডোলিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন, রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতায়ও ভুগছিলেন তিনি; সেই সাথে তার ফুসফুসে দেখা দিয়েছিল সংক্রমণ, কিডনিও কাজ করছিল না। ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি শনিবার বলেছিলেন, এরশাদের কোনো অঙ্গ আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। ‘প্রতিদিন ডাকলে চোখে মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ তা করেননি। আসলে তার বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে যে উন্নতি হওয়ার কথা তা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় আশির দশকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আট বছর দেশ শাসন করে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আগের সরকারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বপালনকারী এরশাদ বর্তমান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে ছিলেন।
এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে সিএমএইচে ছুটে যান। তার সঙ্গে ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদও (শাদ এরশাদ) ছিলেন। এরশাদের আরেক ছেলে এরিক এরশাদ রয়েছেন বারিধারায় তার বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্কে। এরিকের মা বিদিশার সঙ্গে প্রায় দেশ দশক আগে এরশাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
এরশাদের জানাজা ও দাফনের বিষয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি। দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, লাশ বারিধারার বাস ভবনে প্রথমে নেওয়া হবে, পরে নেওয়া হবে বনানীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।
গত কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এরশাদ। গত বছরের শেষ ভাগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব একটা দেখা যায়নি তাকে। এই সময়ে নিজের সম্পত্তি ট্রাস্টে দিয়ে যান তিনি। অসুস্থতার কারণে ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও বসিয়ে যান এরশাদ; যা নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশনের সমর্থকরা রুষ্ট ছিলেন বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
গত ২২ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হলে রাখা হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে।
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলসহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক অনেক ধারা সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত এরশাদ। ৯০ এর গণআন্দোলনের সময় তাকে নিয়েই ‘বিশ্ব বেহায়া’ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি, রাজনীতিতে একের পর এক ‘ডিগবাজি’ দিয়েও আলোচিত ছিলেন তিনি। তবে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের কাছে এরশাদ ছিলেন নায়কসম; তারা ‘পল্লীবন্ধু’ হিসেবেই ডাকতেন তাকে।
এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। অবিভক্ত ভারতে শিশুকাল কুচবিহারে কাটে তার। ভারত ভাগের পর তার পরিবার চলে আসে রংপুরে; পেয়ারা ডাকনামে পরিচিত এরশাদের পড়াশোনার শুরু রংপুরেই।
১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। তার ভাষ্য, তিনি বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে অনেকে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর মামা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়ার (বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী) সুপারিশে এরশাদকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফেরত নেয়া হয় বলে সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি; তখন তার পদমর্যাদা ছিল কর্নেল।
১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ অগাস্ট ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। ওই ঘটনার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে করা হয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান, মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে। পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদকে জিয়ার এই পদোন্নতি দেয়া তখন ভালো চোখে দেখেননি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের অব্যবহিত পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরশাদ। স্বৈরাচারবিরোধী প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। তাঁকে কারাবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের আমলে তিনি জামিনে মুক্ত হন।
২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। এরপর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সাংসদ হন। তিনি চলতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।