‘সোনালী কাবিন’ খ্যাত কবি আল মাহমুদ আর নেই
- প্রকাশের সময় : ০৬:৪১:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
- / ৮৯২ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, ‘সোনালী কাবিন’ খ্যাত আল মাহমুদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারী) রাত ১১টা ৫ মিনিটে ঢাকায় ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ৮২ বছর বয়সী আল মাহমুদ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত শনিবার (৯ ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যার পর তাকে এ হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রথমে সিসিইউ পরে আইসিইউতে রেখে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। শুক্রবার রাত ১০টায় আল মাহমুদকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। কবি আল মাহমুদের মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আল মাহমুদ ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কবি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্য রচনা করেও তিনি খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছেন। ৫০-এর দশকের তার সমসাময়িক কবি-বন্ধুরা যখন একে একে মৃত্যুবরণ করছেন তখন কবি আল মাহমুদ বার্ধক্যজনিত নানান অসুখে থেকেছেন গৃহবন্দী। মাঝে মধ্যে গিয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। দীর্ঘদিন ধরে চোখে ভালো দেখতেন না, কানেও কম শুনতেন। তবু বিশেষ সংখ্যার জন্য তিনি অন্যের সহযোগিতা নিয়ে মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন।
আল মাহমুদ, জন্ম : ১১ জুলাই ১৯৩৬ মৃত্যু : ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।
আল মাহমুদ ২১ বছর বয়স পর্যন্ত ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরে এবং কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত জগতপুর গ্রামের সাধনা হাই স্কুলে, পরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। সে সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করেন।
আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক-ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন যিনি তিনি কবি আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন তিনি।
আল মাহমুদ শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, যিনি বখতিয়ারের ঘোড়ায় চড়ে লোক-লোকান্তর খোঁজেন, কালের কলস থেকে সোনালী কাবিন বের করে পাখির কাছে ফুলের কাছে নিয়ে গেছেন সাহিত্য পাঠকদের। কবি আল মাহমুদ প্রায় ৬০ বছর ধরে আলোড়িত ও আন্দোলিত করেছেন বিপুল পাঠকশ্রেণিকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাংলাভাষী পাঠক রয়েছে সেখানেই উচ্চারিত হয় তাঁর কবিখ্যাতি। শুধু কবিতা নয়, রচনা করেছেন কালজয়ী নানা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধও।
১৮ বছর বয়সে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ, কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তিনি সুপরিচিত হন।
তার কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল।
১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকা আসেন। তখন ১৮ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। তখন তিনি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৫ সাল আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে আল মাহমুদ সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) প্রথমেই তাঁকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে স্থান করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। কবিতার মতো গল্প ও উপন্যাসেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার ত্রিশ দশকীয় ভাবধারায় ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করে আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোয় অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন পুলক সৃষ্টি করেন।
১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধের পরে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখায় মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’-এর জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।