সাত যুক্তিতে মিন্নির জামিন হাইকোর্টে
- প্রকাশের সময় : ০৪:৫২:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০১৯
- / ২১৬ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফের স্ত্রী কারাবন্দি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না এবং নিজের পিতার জিম্মায় থাকবেন- এই শর্তে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে রায় দিয়েছেন আদালত। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললে জামিন বাতিল করা হবে বলে আদেশে বলা হয়েছে। আদালত সাতটি যুক্তি উল্লেখ করে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করেন।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার (২৯ আগষ্ট) এক রায়ে এ আদেশ দেন। মিন্নির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে এ রায় দেন আদালত। জামিন প্রশ্নে রুলের ওপর বুধবার (২৮ আগষ্ট) শুনানি সম্পন্ন হয়। এরপর বৃহস্পতিবার আদালত জামিন মঞ্জুর করে রায় দেন। আদালত বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ অংশসহ সংক্ষিপ্ত রায় দিচ্ছি। বিস্তারিত পরে দেওয়া হবে।’ এরপর আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করেন ও পরে জামিন মঞ্জুরের আদেশ দেন। এদিকে মিন্নির জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে বলে জানানো হয়েছে।
যে ৭ কারণে জামিন মঞ্জুর: আদালত জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেওয়ার আগে কী কারণে জামিন দেওয়া হচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেন। আদালত বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয় বিবেচনা করেছি তা হলো- মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে মিন্নির নাম না থাকা, গ্রেপ্তারের পর থেকে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে স্থানীয় পুলিশ লাইনে আটক রাখা, তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া, আদালতে রিমান্ড শুনানির সময় আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার আগেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য, তদন্তকারী কর্মকর্তার মতে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। সুতরাং আসামি কর্তৃক তদন্ত প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ না থাকায় সর্বোপরি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যতিক্রম অর্থাৎ আসামি একজন নারী হওয়ায় বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাঁকে জামিন দেওয়া ন্যায়সংগত মনে করছি এবং জারি করা রুলটি যথাযথ ঘোষণা করা হলো।’
বরগুনার এসপি’র সংবাদ সম্মেলন নিয়ে আদালতের অসন্তোষ: আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকাবস্থায় বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার জনাব মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের সম্মুখীন হন। মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন তা শুধু অযাচিত, অনাকাঙ্খিতই নয়, বরং ন্যায়, নীতি, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। আদালত বলেন, পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যাই হোক না কেন, কোনো পুলিশ সুপারের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তিনি তাঁর দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যা দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। উচ্চপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত এবং কাম্য নয়। ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে আরো সতর্কতা ও পেশাদারির পরিচয় দেবেন আদালতের এটাই কাম্য। আদালত বলেন, যেহেতু মামলাটির তদন্তকাজ এখনো চলমান। তাই এই মুহূর্তে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আদালত বিরত থাকছেন। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
মামলার তদন্ত পর্যায়ে প্রেস ব্রিফিং ও গ্রেপ্তারকৃতদের গণমাধ্যমে হাজির করা নিয়ে নীতিমালা করার নির্দেশ : আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা সংগত হবে যে ইদানীং প্রায়শ লক্ষ করা যাচ্ছে যে সংগঠিত আলোচিত ঘটনার তদন্তকালে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে এবং তদন্ত সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়, যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। যদিও এ বিষয়ে অত্র আদালতে একটি রায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আদালত বলেন, অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত বিষয়ে অতি উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধী বা অপরাধ করেছে। তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। সে কারণে মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি ও গ্রেপ্তারকৃতদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হলো।
জামিনের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিন্নির বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ ছিল। তিনি ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার আগে ও পরে আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির ১৩ বার ফোনালাপও হয়েছে। এসব আমরা আদালতে তুলে ধরে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেছিলাম। তবু আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন। আমরা এই আদেশে মর্মাহত। তাই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত ২৬ জুন সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল আলিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে মামলা করেন। এই মামলায় মিন্নি, রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়সহ ১৫ জনকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত নয়ন বন্ড ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। গত ১৬ জুলাই রাতে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পরদিন ১৭ জুলাই তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই গত ১৯ জুলাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগের দিন ১৮ জুলাই দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন বরগুনার এসপি মারুফ হোসেন। এ অবস্থায় প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ও পরে জেলা জজ আদালতে মিন্নির জামিনের আবেদন করা হলেও ওই দুই আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ হয়। এরপর হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করা হয়।
হতাশ নিহত রিফাতের বাবা: বৃহস্পতিবার মিন্নির জামিন আদেশের পর নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিন্নি আমার পুত্রবধূ। তার কারণেই আমার ছেলেকে জীবন দিতে হয়েছে। সে আমার ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে নিজেই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আজ তার জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। মিন্নি জামিন পাওয়ায় আমি হতাশ হয়েছি।’ (কালের কন্ঠ )