রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংস নির্যাতন: ৭৩ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় : রাখাইনে ৮৬ হিন্দু হত্যার শিকার
- প্রকাশের সময় : ০১:২৮:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
- / ১১২৫ বার পঠিত
ঢাকা: মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংস নির্যাতন চলছে। শিশুদের শিরñেদ করা হচ্ছে। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। অন্যদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম। সেনাবাহিনীর সহিংসতা ও অভিযানের মুখে ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের উদ্দ্যেশ্য মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি গুলি ছুড়ছে। এসব গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসতবাড়িতে এসেও পড়ছে। এমনই একটি ভিডিও প্রচার করেছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এক মিনিট ৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে একটি বসতি। পরিষ্কার বোঝা যায় সেখানে বেশ কিছু পরিবারের বসতি ছিল। ভিডিও ধারনের সময়ও সেখানে আগুন জ্বলছিল। দূরে দেখা যায় অগ্নিকান্ডের ফলে সৃষ্ট কালো ধোয়া আকাশকে ঢেকে ফেলেছে। কালো আস্তরণ সৃষ্টি হয়েছে আকাশে। আর তা থেকে বাঁচতে লাইন দিয়ে মানুষ আশ্রয় খুঁজছে বাংলাদেশে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ অবস্থায় সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে মিয়ানমারের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তাই তিনি এই সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির প্রতি। তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান। তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছেন। যারা এ অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছেন তাদেরকে তিনি দুষ্কর্মে সহায়তাকারী হিসেবে অভিহিত করেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মিয়ানমারের প্রতি সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই সহিংসতা বন্ধ না হলে মিয়ানমার ও পুরো অঞ্চলে এর প্রভাব পড়বে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিমের দেশ ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার মিয়ানমার এসে পৌঁছেছেন। অং সান সুচি ও অন্যদের সঙ্গে তার বৈঠক করার কথা।
ওদিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাখাইনে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই। সেনাবাহিনীর হিসাবেই কমপক্ষে ৪০০ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ যুদ্ধা নিহত হয়েছে। তবে তারা সবাই যে প্রতিরোধী এমন প্রমাণ কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দিতে পারেন নি। কারণ, তাদের কাউকেই ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে সরকারি হিসাবে ৪০০ নিহতের কথা বলা হলেও ধারণা করা হয় নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। যেসব সাধারণ মানুষ ভয়াবহ সহিংসতা থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন তারা ভয়াবহতার বর্ণনা দিচ্ছেন। তা শুনে গা শিউরে উঠবে যেকোনো মানুষের। তারা বলছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র গ্রুপ রোহিঙ্গাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। চুট পাইন গ্রামে ৫ ঘন্টা ধরে হামলা চালানো হয়েছে। সেখান থেকে বেঁচে পালিয়েছেন আবদুর রহমান (৪১) নামে একজন। তিনি দাতব্য সংস্থা ফোরটিফাই রাইটসকে বলেছেন, রোহিঙ্গা পুরুষদের বার বার অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়েছিল। তাদেরকে বাঁশে তৈরি একটি ঘরের ভিতর আটকে রাখা হয়। এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা উল্লাস করে। আবদুর রহমান বলেন, এভাবেই আমার এক ভাইকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগুন দেয়ার পর ওই ঘরের ভিতর থেকে শুধু বেরিয়ে এসেছে আর্তনাদ। আগুনের লেলিহান শিখা আর কান্না মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমন দৃশ্য কে সহ্য করতে পারে বলুন! একটি মাঠের ভিতর পরিবারের বাকিদের খুঁজে পাই। তাদের শরীরে বুলেটবিদ্ধ। কারো দেহ কেটে গেছে। আমার দুই ভাতিজার মাথা কেটে নেয়া হয়েছে। তাদের একজনের বয়স ৬ বছর। অন্যজন ৯ বছরের। আমার শ্যালিকাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই গ্রামের আরেকজন সুলতান আহমেদ (২৭)। তিনি বলেছেন, অনেক মানুষের শিরচ্ছেদ করা হয়েছে। অনেকের দেহ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। যখন এভাবে মানুষের মাথা দেহ থেকে কেটে নেয়া হচ্ছিল তখন আমরা পালিয়ে ছিলাম একটি ঘরে। এ দৃশ্য দেখেই আমরা ঘরের পিছন দিয়ে দৌড়াতে শুরু করি। অন্য গ্রামের জীবিতরাও বর্ণনা করেছেন একই রকমের সহিংসতার। তারাও বলেছেন, আমরা দেখেছি মানুষের মাথা কেটে নেয়া হচ্ছে। গলা কেটে দেয়া হচ্ছে। ফোরটিফাই রাইটসের প্রধান ম্যাথিউ স্মিথ বলেছেন, বেসামরিক মানুষদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার সরকার। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ওদিকে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের স্যাটেলাইটে দেখতে পেয়েছে শুধু চেইন খার লি গ্রামেই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ৭০০ বাড়ি। আক্রান্ত এলাকাগুলোতে সাংবাদিক বা পর্যবেক্ষকদের প্রবেশে অনুমতি দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এ অবস্থায় পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর সহিংসতা ও অভিযানের মুখে ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রয়টার্সকে এতথ্য জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-র আঞ্চলিক মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান। একদিন আগে শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) ইউএনএইচসিআর জানিয়েছিল বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬০ হাজারের মতো। ফলে একদিনের ব্যবধানে আরও ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছে সংস্থাটি।
অপরদিকে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীকে অহিংস আচরণ করার আহবান জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুটারেস। সহিংসতায় প্রায় ৪’শ রোহিঙ্গা নিহত ঘটনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন তিনি।
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ জানান তিনি। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সহিংসতায় উদ্বিগ্ন তিনি। মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে সেখানে সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার জন্য আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের।
বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী এক রাতের ব্যবধানেই টেকনাফে পালিয়ে আসা নতুন ১৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে চিহ্নিত করেছে। অস্থায়ী আশ্রয়ের জন্য স্কুল-মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো এখন উপচে পড়ছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বলেছেন, এক রাতের ব্যবধানেই তারা রোববার নতুন অন্তত ১৩০০০ রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করেছেন। ফলে, শনিবার যেখানে রাখাইন থেকে পালিয়ে ঢোকা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬০ হাজারের মত বলা হয়েছিলো, রবিবার সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৭৩ হাজার।
ভিভিয়েন ট্যান বিবিসির ফারহানা পারভীনকে বলেন, বলেন, যেভাবে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে শীঘ্রই আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরণের জরুরী সঙ্কট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির- কুতুপালং এবং নয়াপাড়া- তাতে আর তিল ধরণের জায়গা নেই।
স্থানীয় স্কুল মাদ্রাসা ছাড়াও, বিভিন্ন খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে পালিয়ে আসা মানুষজনকে ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বর্তমান হারে শরণার্থী আসতে থাকলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে ঈদের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা এখন সম্ভব হলেও, ছুটির পর কি হবে তা নিয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, আরো হাজার হাজার লোক বাংলাদেশ সীমান্তের পথে রয়েছে। টেকনাফের বালুখালি এলাকায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্পেই রোববার সকাল থেকে ৮০টি পরিবার এসে ঢুকেছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া জামাল হোসেন বলেন, পথে শত শত মানুষ সীমান্তের দিকে এগুচ্ছে। বাংলাদেশে-মিয়ানমার সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডের কয়েকটি জায়গায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে।
রেডক্রস কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ বিবিসিকে বলেন, নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসে থাকা রোহিঙ্গাদের অবস্থ সঙ্গিন, কারণ তাদেরকে কোনো সাহায্য দেওয়া যাচ্ছেনা। রেডক্রসের একটি দলের রোববার নো-ম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষমাণ লোকজের কাছে ত্রাণ-সাহায্য নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সরকারের সাথে বোঝাপড়া সম্পন্ন না হওয়ায় তারা যেতে পারেননি বলে বিবিসি জানায়।
এদিকে রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টদের পরিচালিত একটি ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে, রোববারও কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গা ভিশন রবিবার দাবি করেছে, রাতেডাউং গ্রামের ঘরবাড়ি হারানো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকায় আটকা পড়েছে। তাদের মানবিক ও চিকিৎসা সহযোগিতা প্রয়োজন। রবিবার সকাল ১০টার দিকে মংগডুর নগা সা কুয়েই গ্রামে আগুন দিয়েছে সেনাবাহিনী। পরে বিকাল ৫টার দিকে মংগডুর বালুহালি ও ফাউহালি গ্রামে আগুন দেয়। এতে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রোহিঙ্গা ভিশন নামের ফেসবুক পেজের এই দাবি অন্য কোনও সূত্র থেকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
গত ২৫ আগষ্ট শুরু হওয়া সর্বশেষ এই সহিংসতায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। শুক্রবার রয়টার্স ও গার্ডিয়ানের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে এক সপ্তাহে উত্তর-পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে ৪শ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের সেনাবাহিনী নিহত ৪শ জনের মধ্যে ৩৭০ জনকে সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেছে। তবে রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ব্যাংককভিত্তিক এক মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস দাবি করেছে, সিত্তি জেলার রাতারডাং-এর চাট পিং গ্রামে ১৪০০ মানুষের মধ্যে ২০০ জনকে এরইমধ্যে হত্যা করা হয়েছে বলে সেখানকার জীবিতরা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গা ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত অন্তত ৬০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এসময়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে অন্তত দেড় লাখ মানুষ। সহিংসতা কবলিত অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় রোহিঙ্গা ব্লগারদের এই দাবির সত্যতা কোনও বার্তা সংস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি।
শনিবার মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে রাখাইনে ২৬০০ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য দেশটি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করেছে। তবে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইট ছবি ও বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে আগুন লাগিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এদিকে, কক্সবাজার জেলা টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ২ হাজার ১১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে কোস্টগার্ডের সদস্যরা।
খবরে বলা হয়, আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ হাজার ২৬৬ জন শিশু ও ৪৮৭ জন নারী। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর অন্তত ২০টি ফাঁড়িতে একযোগে সমন্বিত হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক রাথেংডাংয়ে অভিযানে একদিনেই শতাধিক বেসামরিক নাগরিক হত্যা করার অভিযোগ উঠে। এ সহিংসতা এখনও অব্যাহত হয়েছে।
উল্লেখ্য, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এসব রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে মিয়ানমার। দেশটি তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে।
বাংলাদেশের বসতবাড়িতে মিয়ানমারের গুলি, সতর্ক বিজিবি: সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের উদ্দ্যেশ্য মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি গুলি ছুড়ছে। এসব গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসতবাড়িতে এসেও পড়ছে। রোববার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। গোলাগুলিতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে এতে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার তিন দফায় আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতিবাদ জানানোর এক দিনের মাথায় সীমান্তে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। গুলিবর্ষণের পরপরই সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়িয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। সূত্রের দাবি, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের উপর গুলি বর্ষণ করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েক রাউন্ড গুলি পড়ে। এর মধ্যে তিন রাউন্ড গুলি তুমব্রুর পশ্চিমকুল ১নং ওয়ার্ডের আবদুল করিম সওদাগরের টিনের চাল ভেদ করে ঘরে পড়ে। গোলাগুলির ঘটনায় স্থানীয় বাজার ও আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, তুমব্রু বাজারে গুলি এসে পড়ায় স্থানীয়রা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আমরা কয়েকটি গুলি উদ্ধার করে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে জমা দিয়েছি। ঘুমধুম এলাকার আবদুর রহিমও একই কথা জানান। বিজিবি ও পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান বলেন, স্থানীয়রা এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে আমাদের ক্যাম্পে দিয়ে গেছে। পরে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এর পর থেকে সীমান্তে বিভিন্ন পয়েন্টে বিজিবি কড়া অবস্থানে রয়েছে।
রাখাইনে ৮৬ হিন্দু হত্যার শিকার: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় ৮৬ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। তিনি আরও জানান, একইসঙ্গে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হিন্দু রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর এবং লুট করা হয়েছে তাদের সব সম্পদ। আর এ কারণে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৫শ হিন্দু রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু।
রোববার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের দেখতে যান রানা দাশ গুপ্ত। এসময় উপ¯ি’ত সাংবাদিকদের তিনি এসব তথ্য জানান।
রানা দাশ বলেন, রাখাইনের মংডু চিকন ছড়ি নামক গ্রামে ৪৮৯ জন হিন্দু নারী, পুরুষ ও শিশু বসবাস করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সেখানে সহিংসতা শুরু হয়। এসময় মুসলিমদের পাশাপাশি মংডু চিকন গ্রামের হিন্দুদের ওপরও আক্রমণ চালায় মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীরা এ পর্যন্ত ৮৬ জন হিন্দুকে হত্যা করেছে। একইসঙ্গে তারা হিন্দু রোহিঙ্গাদের সব সম্বল কেড়ে নিয়ে বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে।
এসময় রানা দাশ গুপ্ত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি পরিমল কান্তি চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক তাপস হৌড়, কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদসহ স্থানীয় নেতারা। এসময় কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজখবর নেন রানা দাশ গুপ্ত। পরে তিনি হিন্দু রোহিঙ্গাদের মাঝে কাপড় ও খাদ্য বিতরণ করেন।