রাজধানীতে কৃষিশুমারি, তাও বর্ষায়! : বিবিএসের জরিপ-শুমারিতে সীমাহীন লুটপাট-গাফিলতি
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৩:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০১৯
- / ২৮৬ বার পঠিত
আরিফুর রহমান: একবার ভাবুন তো, পরিবার-পরিজন নিয়ে থিতু হয়ে আপনি বসবাস করছেন রাজধানী শহরে। আচমকা একদিন আপনার বাসায় একজন এসে বললেন, ‘আমরা সরকারের লোক। কৃষিশুমারি করতে এসেছি।’ তারপর হাতে একটি ফরম নিয়ে সরকারি লোকটি বললেন, ‘দয়া করে বলতে থাকুন, আমি পূরণ করে নিই।’ ফরমের দিকে তাকিয়ে লোকটি একে একে প্রশ্ন করতে থাকলেন—আপনার খানার (এক রান্নায় যতজন খাবার খায় এবং একসঙ্গে বসবাস করে) সদস্যসংখ্যা কত, কৃষিকাজে নিয়োজিত সদস্য কত; বসতভিটার জমি কত, আবাদি জমি কত, অনাবাদি কত, পুকুর-দিঘি-নার্সারি কত, হাঁস মুরগি কবুতর কোয়েল কত, গরু ছাগল মহিষ ভেড়া কত; আলু পটোল ঢেঁড়স পেঁয়াজ কতটুকু জমিতে; আম লিচু কুল কাঁঠাল কত; ট্রাক্টর পাওয়ার টিলার নলকূপ কতটি… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব প্রশ্ন শুনে কী করবেন আপনি? লোকগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলতে ইচ্ছা করবে না—‘এরা কি পাগল! ইটপাথর লোহালক্কড়ের এই মহানগরে জীবনযাপন আমার। এখানে কৃষিকাজ আসবে কোত্থেকে!’
এই ঘটনা বাস্তবে ঘটেছে জাতীয় কৃষিশুমারির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগর চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন এলাকায় কৃষিশুমারি চালিয়েছে। ঢাকার একটি এলাকার বেশ কয়েকটি ফরম কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। সেগুলোতে গৃহকর্তার নামধাম, মোবাইল ফোন নম্বর ও খানার সদস্যসংখ্যা ছাড়া আর সব ঘর ফাঁকা। সংগত কারণেই আমরা এলাকা ও গৃহকর্তার নামধাম ছাপলাম না। তবে পূরণ করা একটি ফরমের মোবাইল নম্বরে সোমবার (১৪ অক্টোবর) রাতে ফোন করলে ওপার থেকে একজন ফোন ধরে গৃহকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘হ্যাঁ, গত জুন মাসে আমার বাসায় একজন এসেছিলেন। ওই সব পপ্রশ্ন শুনে আমি তাঁকে বলেছি, ভাই, আমি একটা গার্মেন্টে চাকরি করে খাই। এসব প্রশ্ন নিয়ে গ্রামে যান, এগুলো শহরের জন্য না।’
গত ৯ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দেশজুড়ে সর্বশেষ কৃষিশুমারি করে বিবিএস। শুমারির আগে মাঠকর্মীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ এবং দৈনিক ১২৫ টাকা করে প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়ার কথা। প্রশিক্ষণ ও ভাতা ঠিকমতো হয়েছে কি না অনুসন্ধানের জন্য গত ৪ সেপ্টেম্বর নামধাম জোগাড় করে ফোন দেওয়া হয় রাঙামাটি সদরের সুপারভাইজর অনিল কান্তি চাকমাকে। প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্ময়ের সুরে বলেন, ‘দাদা, এত কষ্ট করার পরও আমার লিগ্যাল টাকাটা আমি পাই নাই। এদের মানসিকতা এমন কেন দাদা!’ আপনার তো ছাতা, টি-শার্ট, ক্যাপ এসব পাওয়ার কথা- পেয়েছেন?’ অনিল কান্তি চাকমা স্বভাবসুলভ সরলতায় বললেন, ‘কী যে বলেন দাদা! লিগ্যাল টাকাটাই পাইনি আর ছাতা, টি-শার্ট পাব!’
টাকার অঙ্ক এবং একজন অনিল কান্তির টাকা না পাওয়ার দুঃখ অতি সামান্য মনে হলেও তাঁর কণ্ঠেই যেন ধ্বনিত হলো- কী অরাজক অবস্থা চলছে বিবিএসের করা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব জরিপ-শুমারির নেপথ্যে, সেই সুর।
দেশের কৃষক-জেলে-খামারিদের সহযোগিতার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেওয়া হয় বিবিএসের কৃষিশুমারির মাধ্যমে; বের করা হয় দেশে কৃষিভিত্তিক খানার (হাউসহোল্ড) সংখ্যা কত, কী কী ধরনের শস্য উৎপাদন হয়, ভূমির ব্যবহার, জমিতে চাষের প্রকারভেদ, চাষের পদ্ধতি, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির সংখ্যা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের তথ্য-উপাত্ত।
দেশবাসীর প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন ও সেবা খাতের পরিকল্পনার জন্য জানা দরকার দেশের জনসংখ্যা কত। আর বিবিএসের করা আদমশুমারির মাধ্যমেই সেটা জানা যায়। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান-মর্যাদাও নির্ভর করে এই জনসংখ্যার ওপর। বিবিএসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থনৈতিক শুমারি। এর মাধ্যমে কৃষি খাতের বাইরে দেশের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য জানা যায় এবং তার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বিবিএসের করা শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে জানা যায় দেশে বেকারত্বের হার, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা, শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের হার, প্রবাসী শ্রমশক্তির সংখ্যা ইত্যাদি। আর তার ভিত্তিতেই করা হয় কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, বিনিয়োগসহ তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নানা পরিকল্পনা। বিবিএস দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় খানা ডাটাবেইস জরিপ (এনএইচডি) করেছে এবার।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান বলছে, এসব জতীয় গুরুত্বপূর্ণ জরিপ-শুমারির নামে চলছে ফাঁকিবাজি, গাফিলতি, খামখেয়ালি আর টাকা লুটপাটের মচ্ছব।
কৃষিশুমারিতে বেশুমার লুটপাট: গত ৯ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দেশজুড়ে কৃষিশুমারি করার কথা থাকলেও সেটা গড়ায় ২৮ জুন পর্যন্ত। দেশের মোট সাড়ে তিন কোটি খানা (১৬ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ প্রতি খানার আওতায় ৪.০৬ জন) থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে এক লাখ ৪৪ হাজার ২১১ জন গণনাকারী (৯ হাজার টাকা করে) ও ২৪ হাজার ৭০০ জন সুপারভাইজর (১০ হাজার টাকা করে) নিয়োগ দিয়ে তাঁদের তিন দিনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল গত রমজানের সময়। অনুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেক গণনাকারীর জন্য প্রতিদিন ১২৫ টাকা করে সাড়ে চার কোটি টাকা সম্মানী রাখা ছিল। সুপারভাইজরদের জন্যও প্রশিক্ষণ বাবদ প্রতিদিন ১২৫ টাকা করে রাখা ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণের পর সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও লক্ষীপুর সদরের এমরান আহমেদ, নোয়াখালীর মাসুদ আহমেদ, রাঙামাটি সদরের সবিনা চাকমা ও কেলভিন চাকমা, চট্টগ্রামের রাজু আহমেদসহ অন্তত ১০ জন গণনাকারীর সঙ্গে গত ৭ ও ৮ আগস্ট ফোনে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কেউই প্রশিক্ষণের টাকা পাননি। একইভাবে লক্ষীপুর সদরের কাজী দেলোয়ার হোসেনসহ চারজন সুপারভাইজরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরাও জানান, কেউ প্রশিক্ষণের টাকা পাননি। পরিসংখ্যান কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঝামেলা করলে ভবিষ্যতে আর কোনো কাজ পাবেন না এমন ভয় থেকে কেউ টাকা পাওয়ার চেষ্টাও করেননি। রাঙামাটি সদরের সুপারভাইজর অনিল কান্তি চাকমার দুঃখের কথা আগেই বলা হয়েছে। রাঙামাটিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এ এইচ এম ওহিদুজ্জামান গত মাসে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ জেলায় কেউ কৃষিশুমারির টাকা পাননি, আমার কাছে এমন অভিযোগ আসেনি। তার পরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
এর আগে ১ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জুনিয়র পরিসংখ্যান সহকারী আবু মুসা অভিযোগ করেন, এবারের কৃষিশুমারিতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সম্মানী ও আপ্যায়ন বিল পেতে অনেক দেরি হয়েছে। টি-শার্ট, ক্যাপ ও ছাতা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। জামালপুরের সাবেক কৃষি কর্মকর্তা আবদুস সালাম, যিনি ওই কৃষিশুমারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ওই রাতে কালের কণ্ঠ’র কাছে একই অভিযোগ তুলে ধরেন।
কৃষিশুমারিতে মানুষ যাতে সঠিকভাবে তথ্য দেয়, সে জন্য সারা দেশের দুই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে প্রচার-প্রচারণার খরচের জন্য ৪০ লাখ টাকা রাখা ছিল। কিন্তু গত ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট কুমিল্লা, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি ও ময়মনসিংহ পাঁচটি জেলার জোনাল অফিসার ও সুপারভাইজরদের কাছে খবর নিয়ে জানা গেল, এ ধরনের কোনো প্রচার-প্রচারণা সেখানে হয়নি।
সাধারণত কোনো জরিপ ও শুমারি চালানোর জন্য মোক্ষম সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মে মাস। তখন আবহাওয়া ভালো থাকে। কিন্তু সর্বশেষ কৃষিশুমারির কাজটি হয় গত ৯ জুন থেকে ২৮ জুন। সময়টি ছিল ভরা বর্ষা। কখনো বৃষ্টি, কখনো তীব্র দাবদাহে গণনাকারী ও সুপারভাইজররা মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে পারেননি। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত যে চারবার কৃষিশুমারি হয়, প্রতিটিই ডিসেম্বর থেকে মে সময়কালে হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা কেন বর্ষায় করা হলো, সে এক রহস্য। তার চেয়ে বড় রহস্য হলো, এই কৃষিশুমারি চালানো হয়েছে খোদ ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ অন্য বড় সিটিগুলোতেও। এই রাজধানী শহরে কৃষক কোথায় আর কৃষিজমি কোথায়? এই প্রশ্ন ঘুরছে বিবিএসের মধ্যেই। এবারের কৃষিশুমারির বরাদ্দ ৩৪৫ কোটি টাকার পুরোটাই জলে গেছে- বিবিএসের পরিচালক ও উপপরিচালক পর্যায়ের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা এ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ সংগত কারণেই নাম প্রকাশ করতে রাজি নন।
কৃষি শুমারি শহরাঞ্চল ঘিরে করা উচিত কি না এই প্রশ্ন সোমবার (১৪ অক্টোবর) রাতে রাখা হয় বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সাত্তার মন্ডলের কাছে। তিনি বলেন, শহরাঞ্চলে কৃষিশুমারি করা সময়ের অপচয় মাত্র। সেই সঙ্গে তথ্যের বিভ্রান্তিও ঘটতে পারে। কারণ শহরাঞ্চলে তো কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ থাকে না। শহরে কেউ গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন কিংবা জমি চাষবাস করে না। যেকোনো জরিপ-শুমারি পরিচালনার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, কার কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হবে। শুমারির সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই শহরের দিকে মনোযোগী না হয়ে ওই জনবল গ্রামে দেওয়া উত্তম বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
স্বাধীনতার আগে ও পরে কৃষি শুমারিগুলো কোন সময় করা হয়েছে তা জানতে গত ১৩ অক্টোবর খোঁজ করা হয় বিবিএসের লাইব্রেরিতে। সব শুমারির প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, ডিসেম্বর থেকে মে- এই সময়েই হয়েছিল সব শুমারি। পাকিস্তান আমলে প্রথম কৃষি শুমারি হয়েছিল ১৯৬০ সালের ১ ফেব্রæয়ারী থেকে ২১ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কৃষি শুমারি হয় ১৯৭৭ সালে, ১৪ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয়টি হয় মার্চ মাসে। তৃতীয়টি হয় ১৯৯৬ সালে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারী পর্যন্ত। ওপরের একটি কৃষি শুমারিতেও শহরাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০০৮ সালের ১১ থেকে ২৫ মে চতুর্থ কৃষি শুমারিতে প্রথম শহরাঞ্চল আনা হয়।
কৃষি শুমারি করার সঠিক সময় আসলে কখন জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফকির আজমল হুদা সোমবার বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ কৃষিশুমারির জন্য মোক্ষম সময়। কারণ বৈশাখের আগেই সব ফসল উঠে যায়। আষাঢ় মাসে শুমারি করলে ভালো ফল আশা করা যায় না। কারণ তখন গণনাকারীরা মাঠ পর্যায়ে তথ্য আনতে যেতে পারেন না।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার জোনাল অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান সোমবার রাতে বলেন, জুন মাসে শুমারি করার কারণে দাবদাহে অনেক গণনাকারী অসুস্থ হয়ে যান। আবার টানা দুই দিন বৃষ্টিও ছিল। তাই শুমারি করতে সমস্যা হয়েছে। কৃষি শুমারির উপকরণ ছাতা ও টি-শার্ট পাননি বলে তিনিও অভিযোগ করেন।
জানতে চাইলে এবারের কৃষি শুমারির প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) জাফর আহমেদ গত ২০ আগস্ট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুপারভাইজর ও গণনাকারীরা কেন টাকা পাননি, আমি খবর নেব।’ তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা পেতে এবার দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি। অসময়ে কেন শুমারি করা হলো জানতে চাইলে জাফর আহমেদের জবাব, ‘ফেব্রæয়ারীতে করার কথা ছিল। কিন্তু বাজেট না পাওয়ায় দেরি হয়েছে।’ মাঠকর্মীদের অনেকে টাকা ও উপহার সামগ্রী কেন পাননি প্রশ্ন তুললে জাফর আহমেদ বলেন, ‘কেউ আপনাকে আমার পেছনে লাগিয়েছে। আমার অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
শেষ হয় না ধনী-গরিবের তালিকা: দেশের দুস্থ-অসহায়-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের ১৪৫টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপযুক্তদের বদলে সচ্ছলদের ভাতা পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মত, এই অনিয়মের প্রধান কারণ দেশে ধনী-দরিদ্রের কোনো তালিকা না থাকা। চলতি অর্থবছরের ৭৪ হাজার কোটি টাকাসহ সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার স্বচ্ছতা আনতে ২০১৩ সালে প্রতিটি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজে হাত দেয় বিবিএস। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় খানা ডাটাবেইস জরিপ (এনএইচডি) চালিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো একটি ধনী-দরিদ্রের তালিকা তৈরি করা। সেই তালিকা ধরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সত্যিকারের দরিদ্রদের ভাতা দেবে। ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে তিন কোটি খানার তথ্য সংগ্রহ করার প্রকল্প এনএইচডি ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটা পারেনি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। উপরন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কাছে আবেদন করে আরো দুই বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, ৩২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৭২৭ কোটি টাকা করা হয়েছে।
এই অনুসন্ধানের জন্য বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডারের অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রথম ধাপের তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সময়ের পার্থক্য অনেক বেশি- প্রায় এক বছর। এ কারণে দুটি ধাপের তথ্যের সমন্বয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তা ছাড়া ২০১৭ সালে মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের গুণগত মান এত দিন ধরে রাখাও অসম্ভব। ২০২১ সালে যখন এই প্রকল্পের আওতায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হবে, তখন তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি খানা থেকে তথ্য আনার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এই প্রকল্পে তা করা হয়নি। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে অনেক খানা থেকে তথ্য আনা হয়নি বলে এই প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বিভিন্ন সভায় আলোচনা হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি সভার কার্যবিবরণী কালের কণ্ঠ’র সংগ্রহে আছে। সেগুলো থেকে এসব তথ্য জানার পর রাজধানীর মিরপুরে কয়েকটি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, যারা সরকারের দেওয়া বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য। তালতলায় ৫২৭ নম্বর বাসায় ভাড়ায় থাকেন ষাটোর্ধ্ব হালিমা খাতুন। একটি টং দোকান দিয়ে সংসার চলে তাঁর। গত ৫ আগস্ট হালিমার দোকানে গিয়ে ‘সরকারের কেউ বাসায় এসে তথ্য নিয়েছে কি না’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো দিন আমার নামটাও জানতে আসেনি।’ সরকারের কোনো সুবিধাই তিনি পান না বলে জানালেন। একই দিন পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৪৭৩ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকা নাজমা আক্তারও একই কথা জানালেন।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সারা দেশে সাড়ে তিন কোটি খানা থেকে তথ্য আনতে আদমশুমারি, কৃষি শুমারিসহ অন্য জরিপে টানা ২০ দিন কিংবা এক মাসের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলা হয়। পঞ্চম আদমশুমারি হয়েছে সাত দিনে। কিন্তু এনএইচডির ক্ষেত্রে সাড়ে তিন কোটি পরিবার থেকে তথ্য নেওয়া হয় তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ২০১৭ সালের এপ্রিলে; দ্বিতীয় ধাপে ৯ মাস পর ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে এবং তৃতীয় ধাপে আরো ৯ মাস পর সেপ্টেম্বরে। পরিসংখ্যানের নিয়ম হলো- কোনো শুমারি ও জরিপের সময় মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ছয় মাসের মধ্যে প্রাথমিক ফল ঘোষণা করতে হয়। প্রতিটি প্রকল্প দলিলে এ কথা লেখা থাকে। কিন্তু ছয় মাস দূরের কথা, ছয় বছরেও এনএইচডি প্রকল্পের ফল ঘোষণা করতে পারেনি সংস্থাটি।
এর কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সফিউল আলম গত আগস্ট মাসে বললেন, ‘কাজটি অনেক বড়। প্রতিটি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। মাঠ থেকে তথ্য এনে আমরা এখন ডাটা স্থানান্তর করছি। আমাদের আরো কিছু সময় লাগবে।’
‘কিন্তু সব খানা থেকে তথ্য আনা হয়নি বলে আমাদের অনুসন্ধান বলছে’ জানালে সফিউল আলম বলেন, ‘শহর এলাকা থেকে তথ্য আনা খুব কঠিন। আমাদের দেশবাসীর মাঝে এখনো তথ্য দেওয়ার প্রবণতা ও আগ্রহ গড়ে ওঠেনি। তাই কিছুটা সমস্যা হয়েছে।’ গত ছয় বছরে পাঁচজন প্রকল্প পরিচালক কাজ করার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দেরি হওয়ায় প্রকল্পের এমন বেহাল বলে জানান সফিউল আলম।
অর্থহীন অর্থনৈতিক শুমারি: ১৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে করা অর্থনৈতিক শুমারির ফল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দুই বছর আগে প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন অর্থনৈতিক শুমারির যে ফল দিয়েছেন, সেটি এ বছর হালনাগাদ করতে গিয়ে আগের শুমারির অসংগতি খুঁজে পেয়েছেন বিবিএসের শিল্প শাখার পরিচালক ঘোষ সুবব্রত। আগের শুমারিতে দেখা গেছে, ১০ জনের বেশি জনবল আছে এমন স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সারা দেশে পাওয়া গেছে এক লাখ ৫৫ হাজার। সেটি এবার কমে হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার। দুই বছরের ব্যবধানে স্বাভাবিকভাবে যেখানে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাড়ার কথা, সেখানে কেন কমেছে জানতে চাইলে ঘোষ সুবব্রত বলেন, সারা দেশে রাস্তাঘাট ও সড়ক উন্নয়ন কাজের কারণে অনেক দোকান উচ্ছেদ হয়ে গেছে। সে কারণে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমতে পারে।
দুই কর্মকর্তার পাওয়া দুই ধরনের তথ্যের সূত্র ধরে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে অর্থনৈতিক শুমারির প্রকল্প প্রস্তাবটিই (ডিপিপি) সংগ্রহ করে ফেলা হয়। সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেল, প্রথম দফার শুমারিতে সারা দেশ থেকে দোকানপাট, শিল্প-কারখানা মিলিয়ে এক কোটি ১০ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিটের তালিকা সংগ্রহ করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন। কিন্তু প্রতিবেদনে তিনি ৮৫ লাখ ইউনিটের কোড নম্বর দিয়েছেন এবং তা কম্পিউটারে ধারণ করা হয়েছে। বাদ পড়েছে ২৫ লাখ ইউনিট। এরপর অর্থনৈতিক শুমারির চূড়ান্ত ফল যখন প্রকাশ করা হয়, তখন প্রকল্প পরিচালক দিলদার ৭৮ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিটের তথ্য প্রকাশ করেন। এবার বাদ পড়ল আরো সাত লাখ ইউনিট। আর আগের বাদ পড়া ২৫ লাখের তো খবরই নেই।
এভাবে দুই বছর আগের ফল ও এবারের ফল- দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ে যেসব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হয়, তা এই শুমারি থেকে তথ্য নিয়েই করা হয়। এই মুহূর্তে দেশে কোন শিল্প উদীয়মান; ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কী অবস্থা; কোন জেলায় শিল্প কম, কোন জেলায় বেশি; কোন শিল্প লোকসানে আছে আর কোন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়া জরুরি- এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই শুমারি থেকে জানা যায় এবং সেইমতো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ফলের ভিত্তিতে এ রকম রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত-পরিকল্পনার পরিণতি যে কী হয়, তা বলাই বাহুল্য।
জানতে চাইলে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে অর্থনৈতিক শুমারির প্রকল্প পরিচালক উপ সচিব দিলদার হোসেন বলেন, ‘আমি যে শুমারি করেছি, সেখানে দশের বেশি জনবলবিশিষ্ট স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার। সেটি এখন কেন কমে এক লাখ ৩৪ হাজারে নেমে এসেছে, তা দেখতে হবে; জানতে হবে। এবার যারা হালনাগাদ তথ্য বের করেছে, তারা কী প্রক্রিয়ায় সেটা করেছে, আমি জানি না।’ (কালের কন্ঠ)