বাংলাদেশে অপ্রতিরোধ্য মাদক

- প্রকাশের সময় : ১২:২২:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১
- / ৫৩ বার পঠিত
ঢাকা ডেস্ক : কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল-সর্বত্রই নেশা এখন হাতের নাগালে। এক যুগে এর বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যেত। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। মাদকের আগ্রাসনে শত শত পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হয়েছে, তারও সঠিক হিসাব নেই।
মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে শক্ত আইনও প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ। ইয়াবা, কোকেন, হেরোইন ও প্যাথিড্রিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, পরিবহন, চাষাবাদ, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি বা বাজারজাতে রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ডের বিধান। তবে এমন শাস্তির খড়গও ঠেকাতে পারছে না মাদকের চোরাচালান। আইন কিংবা মাদক নির্মূলে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টার পরও ইয়াবাসহ মাদক আসছেই। সীমান্তে কড়াকড়ি, কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, গণআত্মসমর্পণ কিংবা কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে বিশেষ ও যৌথ নজরদারি জোরদারের পরও বন্ধ হয়নি মাদক আসা।
গত ১২ বছরের পরিসংখ্যান বলছে মাদকের চোরাচালান বেড়েছে। এমন কোনো দিন নেই সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবির হাতে মাদকদ্রব্য জব্দ হচ্ছে না। মাদকের ট্রানজিট রুট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জেলা কক্সবাজার। এ মাদকের মূল উপাদানগুলোর চোরাচালান বেশি হচ্ছে, থাইল্যান্ড, চীন, মিয়ানমার থেকে।
অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সারাদেশে সেবনকারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার নেশা গ্রহণ করছে। বছরের হিসাবে এর পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ব্যবসায় জড়িত ২০০ গডফাদার ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে ১ লাখ ৬৫ হাজার জন। প্রতি বছরই বাড়ছে এই সংখ্যা। মাদকদ্রব্য লেনদেনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এই সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভয়াবহ হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকসেবীর সংখ্যা এখন ২ কোটি হবে। এর মধ্যে দেড় কোটি নিয়মিত। ৫০ লাখের মতো অনিয়মিত। দেশে সেবনকারীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। মাদকের মাধ্যমে শুধু টাকা পাচার হচ্ছে তা নয়। মাদক হচ্ছে অপরাধের জনক। ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানিসহ যত ধরনের অপরাধ হয়- সবকিছুর মূলেই এই মাদক।
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে শীর্ষ থেকে মধ্যম মানের মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ হাজার। তাহলে আমাদের এতগুলো বাহিনীর সদস্যরা কী করছেন? আমরা ১০ হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে পারছি না? এটা সত্যিই আমাদের ভয়াবহ রকমের ব্যর্থতা।
বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি দ্বিগুণ করা হয়েছে। বিজিবি এখন ত্রিমাত্রিক ভূমিকায়। বিজিবি মাদকের চোরাচালান বন্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ও সীমান্ত বাসিন্দাদের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতায় কাজ করছে বিজিবি।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, কোনো অপরাধই রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব না। আর মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধের সামনে পেছনে অনেকের সম্পৃক্ততা থাকে। আমরা ইতিমধ্যে এমন মাদকের মাস্টারমাইন্ডদের তালিকা আদালতে দাখিল করেছি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১২ বছরে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৯৩০টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১১ সালে, ৩৭ হাজার ৩৯৫টি। পরের ছয় বছরে মামলার সংখ্যা কমলেও ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা লাখ পেরিয়ে যায়। ২০১৯ সালে মামলা হয় ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি, ২০২০ সালে ৮৫ হাজার ৭১৮টি। আর চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৪৮টি। গত ১২ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এক বছরে মাদক মামলায় সর্বনিম্ন আসামি হয়েছেন ৩৪ হাজার ৩১৫ জন, আর সর্বোচ্চ আসামি হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। মাদক মামলায় ২০০৯ সালে গ্রেফতার হন ৩৪ হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে ৩৭ হাজার ৫১০, ২০১১ সালে ৪৭ হাজার ৪০৩, ২০১২ সালে ৫৪ হাজার ১০০, ২০১৩ সালে ৪৭ হাজার ৫৩১, ২০১৪ সালে ৬২ হাজার ৮০, ২০১৫ সালে ৭০ হাজার ১৫৯, ২০১৬ সালে ৮৭ হাজার ১৪, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৯৩, ২০১৮ সালে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩২৩, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭, ২০২০ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৩ জন। আর ২০২১ সালের চলতি মাস পর্যন্ত ৩৮ হাজার ১১৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন মাদক মামলায়। ১২ বছরে মোট আসামি হয়েছেন ১০ লাখ ৩০ হাজার ৮৩২ জন।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া অফিসার লে. কমান্ডার আমিরুল হক বলেন, নৌ ও সমুদ্র সীমায় এখনো যে কোস্টগার্ডের নজরদারি এড়িয়ে মাদক চোরাচালান হচ্ছে না, তা নয়। তবে আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। কোস্ট গার্ডের নজরদারি সক্ষমতা বেড়েছে। চোরাচালান কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সীমান্ত পথে মাদকের চোরাচালানে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা অবশ্যই অ্যালার্মিং। এটা বন্ধে কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
এ ব্যাপারে মাদক বিশেষজ্ঞ সাবেক সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম বলেন, যদি বলি আমাদের অনেক দেশপ্রেম, স্বাধীন দেশ কিন্তু এই দেশ কী করে মাদকে ডুবে গেল? আসলে মাদক এ দেশে ঠেকানো সম্ভব না। যে দেশে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ থাকে না, যে দেশের সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর ভর করে চলে, সে দেশে নৈতিকতা থাকে না। এখানে নৈতিক মানুষরাই বিপন্ন ও সংখ্যালঘু। দুর্বৃত্তরা সর্বত্র ছড়ি ঘুরাচ্ছে। যে কারণে আইন যতই কঠিন করা হোক না কেন নৈতিকতা না থাকলে মাদক নির্মূল সম্ভব না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবদুস সবুর মণ্ডল বলেন, আসলে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি কয়েকটি সীমান্তবর্তী জেলায় গিয়েছি। সেখানকার মানুষের মতামত নিয়েছি, জেলা প্রশাসকদের মতামত নিচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন স্তরে থাকা তদারকি কর্মকর্তারা যদি আন্তরিক না হন, তাহলে তা কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। আবার দেখুন, বিভিন্ন মেকানিজমে কিংবা টেকনিক্যাল মিটিংয়ে একাডেমিশিয়ানদের ডাকা হয় না। এখানেও একমুখী আচরণ। মাদক উদ্ধার হয় মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ অধরাই থাকে। তাই সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে আন্তরিকভাবে খতিয়ে দেখার। আর সে জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন বাহিনীকে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ অর্থাৎ মাস্টার প্ল্যান।খবর সাম্প্রতিক দেশকাল