ফারমার্স ব্যাংকে ৫শ’ কোটি টাকা জালিয়াতি : এক পরিবারের পেটে ৩০০ কোটি টাকা
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৩:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০১৯
- / ৬১১ বার পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের প্রতিবেদন : ভুয়া নামে একাধিক অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর করে অভিনব কায়দায় আত্মসাৎ * চিশতীর মৌখিক নির্দেশে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন * অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক
মিজান মালিক ও দেলোয়ার হুসেন: বহুল আলোচিত ফারমার্স ব্যাংক জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক পরিবারের পেটেই গেছে ৩০০ কোটি টাকার বেশি। এ পরিবারটি হচ্ছে ব্যাংকের সাবেক প্রভাবশালী পরিচালক ও অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। তার স্ত্রী রোজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী ও কলেজ পড়ুয়া মেয়ে রিমি চিশতীর নামে এসব টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আলাদা দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফারমার্স ব্যাংকের ওপর তৈরি তদন্ত প্রতিবেদনটি দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর সূত্র ধরে দুদক আরও বিশদ অনুসন্ধান করেছে। তাদের অনুসন্ধানে ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বাবুল চিশতীর অবিশ্বাস্য সব জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে। দুদক এখন চিশতী পরিবারের সব সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে।
প্রতিবেদন দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফারমার্স ব্যাংকে বলতে গেলে কোনো ধরনের ব্যাংকিং নিয়মাচার মানা হয়নি। বাবুল চিশতীর মৌখিক নির্দেশে ব্যাংক কর্মকর্তারা শত শত কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। ব্যাংক থেকে নগদ টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো চেক বা কোনো লিখিত নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি।
এসব ছাড়াই চিশতীর মৌখিক নির্দেশে ব্যাংক থেকে টাকা দেয়া হয়েছে। তবে এসব টাকার বেশিরভাগই গেছে চিশতীর পরিবারের সদস্য ও তাদের স্বার্থসংশ্লিস্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে। পরে এসব অর্থ চিশতী নিজের কব্জায় নিয়েছেন।
প্রচলিত নিয়মে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হলে চেক বা পেমেন্ট দিতে গেলে লিখিত আদেশ দিতে হয়। এ ছাড়া টাকা তোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংকে চিশতীর বেলায় এসব কিছুই লাগেনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক পরিচালিত হয় কাগজপত্রের ভিত্তিতে। একটি ব্যাংকে সুশাসনের কতটুকু ঘাটতি থাকলে এমন জালিয়াতি ঘটতে পারে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এসব ঘটনার সঙ্গে যেসব ব্যক্তি বা ব্যাংকার জড়িত তারা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থার চির ধরবে।
প্রতিবেদন দুটিতে আরও দেখা গেছে, এসব অর্থ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে চিশতী অভিনব কৌশল নিয়েছেন। ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন হিসাব খুলে ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণের অর্থ একাধিক হিসাবে নগদ বা পে-অর্ডার আকারে স্থানান্তর করে পরে নগদ তুলে নেয়া হয়েছে। চিশতী পরিবারের সদস্যদের হিসাবেও নগদ জমা ও তোলা হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে শাখা ব্যবস্থাপকরা জড়িত বলে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুলশান শাখা থেকে ১৩০ কোটি, বকশীগঞ্জ শাখা থেকে ১৪০ কোটি ও অন্যান্য শাখা থেকে ৪২ কোটি টাকা তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে বলা হয়, ব্যাংকের রাজধানীর গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমান খানের সহায়তায় চিশতী পরিবারের বিভিন্ন হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এগুলো বাবুল চিশতী, তার স্ত্রী রোজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী ও মেয়ে রিমি চিশতীর নিজ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন হিসাব থেকে জমা হয়। এগুলোর সবই হয়েছে অবৈধভাবে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদন দুটিতে আরও বলা হয়, বাবুল চিশতী, তার পরিবারের সদস্য ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত ১৩০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জমা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সময়ে ১২১ কোটি টাকা তোলা হয়েছে।
ওই সময়ে শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিয়া উদ্দিন আহমেদ এবং দেলোয়ার হোসাইন। মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী এসব লেনদেনের ঘটনায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) করার কথা। ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন হলেই এ রিপোর্ট করতে হয়। দুই ব্যবস্থাপকই এটি করেননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখার গ্রাহক বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স। এর এমডি বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, চেয়ারম্যান তার স্ত্রী রোজী চিশতী এবং নির্বাহী পরিচালক বাবুল চিশতী নিজে। এ কোম্পানির চলতি হিসাবে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারী পর্যন্ত মোট ১৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা জমা হয় এবং তোলা হয় ১৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বকশীগঞ্জ শাখায় হিসাব খোলা হলেও লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে গুলশান শাখায়। কয়েকটি ছোট অঙ্কের লেনদেন ছাড়া সমুদয় অর্থ নগদে জমা করা ও তোলা হয়।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার এ এক অভিনব কৌশল। অনেক ঘটনাই ব্যাংকিং খাতে এভাবে ঘটছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় এসব টাকা লেয়ারিং বা স্থানান্তর করা হয় সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে কি না, যদি থাকে তাহলে অনুসন্ধান বা তদন্তে তারাও আসামি হবে। আর যদি তারা পরিস্থিতির শিকার হন তবে রাজ সাক্ষী হবেন।
তিনি আরও বলেন, যেসব হিসাবে চিশতীর এসব অবৈধ লেনদেন হয়েছে সেগুলো তার নিজের বা তার নিজস্ব লোকজনের কি না? যদি হয়ে থাকে তাহলে তারা চিশতীর সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু যদি হিসাবগুলো ভুয়াও হয়ে থাকে তাহলে এ হিসাব খুলতে যেসব ছবি ও ভোটার আইডির প্রয়োজন হয় সেগুলো কাদের। এ দায়দায়িত্ব ব্যাংকারদের নিতে হবে। ব্যাংকারদের সংশ্লিষ্টতার ওপর নির্ভর করবে তারা আসামি হবে কি না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় মাহবুবুল হক চিশতী, তার স্ত্রী রোজী চিশতী, মেয়ে রিমি চিশতী ও চিশতী প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ১৪টি হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক শাফকাত মতিনের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে বাবুল চিশতীর নামে ৫০ লাখ টাকার পে-অর্ডার করা হয়। পরে এ অর্থ ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় চিশতীর হিসাবে জমা হয়। তদন্ত কমিটির কাছে এ টাকা সম্পর্কে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বাবুল চিশতী।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফারমার্সের প্রধান কার্যালয় থেকে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ শাখা ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট শাখার ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কাজের আংশিক বিল বাবদ ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা রিমি এন্টারপ্রাইজের হিসাবে পে-অর্ডার করতে গুলশান শাখাকে নির্দেশ দেয়া হয়। ওই পে-অর্ডার রিমি এন্টারপ্রাইজের হিসাবে জমা হয়। একই দিনে ওই টাকা চিশতীর হিসাবে স্থানান্ত—র করা হয়। রিমি এন্টারপ্রাইজ চিশতী পরিবারের একটি প্রতিষ্ঠান।
একই বছরের ১২ ডিসেম্বর চিশতীর বকশীগঞ্জ শাখার হিসাবে ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা জমা করে আবার তুলে নেয়া হয়। বাবুল চিশতীর এ হিসাবে বিভিন্ন সময় বিপুল অর্থ নগদ জমা হয়। কিন্তু অর্থের উৎসের উল্লেখ নেই। এসব লেনদেন হয়েছে নগদ ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে। সুবিধাভোগীদের আড়াল করার জন্যই এ ধরনের লেনদেন হয়েছে বলে দুদকের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
ফারমার্সের গুলশান শাখার ঋণগ্রহীতা সাইফ পাওয়ারটেকের হিসাব থেকে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাবুল চিশতীর নামে ২ কোটি টাকার চেক ইস্যু করা হয়। যা চিশতীর হিসাবে ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারী জমা হয়। কেন এ অর্থের লেনদেন তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সাইফ পাওয়ারটেক ফারমার্স ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফ পাওয়ারটেকের নামে ঋণ প্রদানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ওই সময়ে ফারমার্স ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির প্রধান বাবুল চিশতী একক ক্ষমতা বলে প্রাথমিকভাবে আড়াই কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন। পরে চিশতীর মৌখিক নির্দেশে ঋণ সুবিধা ৪ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
হিসাবটিতে ২ কোটি টাকা জমা হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারী ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা নগদ তোলা হয়। একই দিন ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নগদ জমার মাধ্যমে লিয়াকত আলী খান মুকুলের নামে পে-অর্ডার করা হয়। লেনদেন শেষ করে হিসাবটি ২০ জানুয়ারী বন্ধ করা হয়। এর আগে সাইফ পাওয়ারটেকের নামে ব্যাংকের পর্ষদ ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর ১৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাবুল চিশতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যাংকের সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। এতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সায় ছিল। রাশেদুল হক চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় একই নামে একাধিক হিসাব খুলে গোপনে টাকা জমা রাখতেন। তদন্তের সময় দুদক কর্মকর্তাদের কাছে অর্জিত অর্থের উৎস ও স্থানান্তর সম্পর্কে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি চিশতী পরিবার।
ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে দুটি হিসাব খোলা হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে। ২০ জানুয়ারী এগুলোতে এফডিআর ছিল ৫৫ লাখ টাকা। পরে এগুলো নগদ অর্থে এবং পে-অর্ডারের মাধ্যমে যমুনা ব্যাংক গুলশান শাখায় জমা করা হয়।
একই শাখা থেকে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১১টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জমা হয়। এ শাখায় বাবুল চিশতীর মালিকানাধীন রাশেদ এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১৭টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ১ কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এগুলো পরে নগদ তুলে নেয়া হয়। (যুগান্তর)