নিউইয়র্ক ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নিজের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে যা লিখেছিলেন মওলানা ভাসানী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৩৭:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ৪৮ বার পঠিত

নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শুনিয়াছি মহাপুরুষেরা প্রথম যখন নিজেদের প্রকাশ করেন, তাহারা হয়তো মনে করেন, মানুষের কাছে নিজেকে জাহির করবার জন্য তাহাদের কীর্তি যথেষ্ট নয়। আমি মহাপুরুষ নই আর তাই কীর্তি সম্পর্কে কখনও মাথা ঘামাই নাই। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা লইয়া পদে পদে চিন্তা করি। আজ আমার জিন্দেগী সম্পর্কে দুটি কথা লিখিতে গিয়া মোটেই বিনীত হইতে পারিতেছি না। কারণ আমি জানি আমার অভিজ্ঞতা বেশ ব্যাপক এবং মূল্যবান। জীবনে যদি কিছুই না করিয়া থাকি তবু একটি দাবী জোরেসোরে করিতে পারি, আমি মানুষকে দেখিয়াছি। আমি দেখিয়াছি, যে মানুষ নিচু তলায় আঁধারে পচিতেছে তাহারাই বুলেটের মুখে আত্মহুতি দিতেছে। তাই আমার জিন্দেগী- যদি বা আমার নয়ই কিন্তু মানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী হিসেবে আলোচ্য বিষয় বৈকি।

ছোটবেলা হইতেই আমার মনে দাগ কাটিয়া ছিল সমাজের তথাকথিত খান্দানিপনা। জমির পরিমাপে মানুষে মানুষে শ্রেণীভেদ করাটা আমি মোটেই বরদাস্ত করিতে পারতাম না। জমিদার মহাজনদের সুপরিকল্পিত শোষণের পরিচয় যেদিন পাইয়াছিলাম সেদিনই মনে চাইয়াছিল গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকে দুমড়াইয়া নতুন কিছুর পত্তন করি। তাই আসামে জলেশ্বরে জীবন-শিক্ষার হাতে খড়ি সূফি সাধক শাহ্‌ নাসিরুদ্দীন বোগদাদীর নিকট পাইলেও যুগের আকর্ষনে যোগ দিয়াছি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে, খিলাফত আন্দোলনে, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। শিখিবার জন্য, নিজেকে চিন্তায় ও কর্মে বলিষ্ঠ করার জন্য অনুসন্ধিৎসু মনে সঙ্গ লইয়াছি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা মোহাম্মদ আলী, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মওলানা আজাদ সোবহানী এবং মওলানা হোসেন আহমদ মদনীর মত ব্যাক্তি বর্গের। ঘটনা প্রবাহ আর ব্যাক্তিত্বের সঙ্গ আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়াছে। কিন্তু আমি যাহা বিশ্বাস করিয়াছি তাহা হইল : গড়িতে হইলে আগে ভাঙ্গিতে হয়। মানুষের মুক্তি আপোষরফায় আসে না, সুদূরপ্রসারী কর্মসূচিভিত্তিক বিপ্লবই এর একমাত্র পাথেয়।

কারাগারে আমার জীবনের অনেক কয়টি দিন কাটিয়াছে। আমি কিন্তু সেই দিনগুলিকে অযথা যাইতে দেই নাই। পাঁচ মিশালী চরিত্রের মানুষগুলিকে একত্রে পাইয়া দিনে দিনে অনেক শিখিয়াছি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কবিতাটি আজও আমার মনে পড়ে। কারাগারের এপাশে-ওপাশে তিনি হাঁটিতেন আর ধীরে ধীরে বলিতেনঃ
‘ওরে মন, হবেই হবে
যদি পণ করেই থাকিস
সে পণ রবেই রবে।’

কথাগুলি আমাদের নিকট মামুলি ধরণেরি মনে হইতো। কিন্তু জীবনের প্রবাহে প্রবাহে উপলব্ধি করিয়াছি এই কথা কয়টি কত কঠিন, কত বলিষ্ঠ। আমি একটি সিদ্ধান্তে গোড়া হইতেই পৌঁছাইয়াছিলাম। আমার রাজনৈতিক জীবনের এই ৬৮টি বৎসরে ইহার পরিবর্তন হয় নাই। তাহা হইল: আন্দোলনকে গ্রামে লইয়া যাওয়া এবং প্রত্যন্ত গ্রামের স্বরূপ হইতেই রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা সিদ্ধান্ত উদ্ধার করা। ইহার কারণ খুব সহজ। শতকরা ৯০ ভাগের বেশী লোক গ্রামে বাস করে। তাহাদের জিন্দেগী সুস্থ না হইলে দেশ ও জাতির কল্যান হইতে পারে না। আর একটি কারণ আছে বটে। শহুরে লোক লইয়া দীর্ঘ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় না। তাহারা কয়দিন পরই ভাঙ্গিয়া পড়ে। পক্ষান্তরে গ্রামের লোক কত দুঃসাহসী, কত আন্তরিক, কত অনুগত। এই তিনটি গুনের সমন্বয়ে কি যে অসাধ্য সাধন করা যায় তাহা আমি লিখিয়া শেষ করিতে পারিবোনা।

যে যাই বলুন না কেন জমিদার-মহাজনদের অপ্রতিরোধ অবিচার-শোষণ গ্রামের লোকই মোকাবিলা করিয়াছে। তাহাদের মধ্যে নেতৃত্ব ও ঐক্য দান করাটাই ছিল শুধু আমাদের কাজ। তাই আমি আজীবন সম্মেলনকে ভালবাসিয়াছি। ভাসান চরের সম্মেলন, ফুলছুড়ি ঘাটের সম্মেলন,ঘাগমারী সম্মেলন, সিরাজগঞ্জ সম্মেলন, কাগমারী সম্মেলন ইত্যাদী অত্যন্ত পরোক্ষ ভাবে হইলেও আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করিয়াছে। সূক্ষ্মভাবে যাচাই করিলে তাহা উপলব্ধি করে যাইবে। আর এইসব সম্মেলন করতে গিয়া আমি যেমন একাধারে সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটা আবিষ্কার করিয়াছি ঠিক পাশাপাশি তেমনি সেই সমাজভুক্ত মানুষের সুপ্ত মহাশক্তিকে উপলব্ধি করিয়াছি। সুত্র : বাংলা ভিশন টিভি

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

নিজের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে যা লিখেছিলেন মওলানা ভাসানী

প্রকাশের সময় : ১১:৩৭:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৩

নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শুনিয়াছি মহাপুরুষেরা প্রথম যখন নিজেদের প্রকাশ করেন, তাহারা হয়তো মনে করেন, মানুষের কাছে নিজেকে জাহির করবার জন্য তাহাদের কীর্তি যথেষ্ট নয়। আমি মহাপুরুষ নই আর তাই কীর্তি সম্পর্কে কখনও মাথা ঘামাই নাই। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা লইয়া পদে পদে চিন্তা করি। আজ আমার জিন্দেগী সম্পর্কে দুটি কথা লিখিতে গিয়া মোটেই বিনীত হইতে পারিতেছি না। কারণ আমি জানি আমার অভিজ্ঞতা বেশ ব্যাপক এবং মূল্যবান। জীবনে যদি কিছুই না করিয়া থাকি তবু একটি দাবী জোরেসোরে করিতে পারি, আমি মানুষকে দেখিয়াছি। আমি দেখিয়াছি, যে মানুষ নিচু তলায় আঁধারে পচিতেছে তাহারাই বুলেটের মুখে আত্মহুতি দিতেছে। তাই আমার জিন্দেগী- যদি বা আমার নয়ই কিন্তু মানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী হিসেবে আলোচ্য বিষয় বৈকি।

ছোটবেলা হইতেই আমার মনে দাগ কাটিয়া ছিল সমাজের তথাকথিত খান্দানিপনা। জমির পরিমাপে মানুষে মানুষে শ্রেণীভেদ করাটা আমি মোটেই বরদাস্ত করিতে পারতাম না। জমিদার মহাজনদের সুপরিকল্পিত শোষণের পরিচয় যেদিন পাইয়াছিলাম সেদিনই মনে চাইয়াছিল গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকে দুমড়াইয়া নতুন কিছুর পত্তন করি। তাই আসামে জলেশ্বরে জীবন-শিক্ষার হাতে খড়ি সূফি সাধক শাহ্‌ নাসিরুদ্দীন বোগদাদীর নিকট পাইলেও যুগের আকর্ষনে যোগ দিয়াছি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে, খিলাফত আন্দোলনে, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। শিখিবার জন্য, নিজেকে চিন্তায় ও কর্মে বলিষ্ঠ করার জন্য অনুসন্ধিৎসু মনে সঙ্গ লইয়াছি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা মোহাম্মদ আলী, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মওলানা আজাদ সোবহানী এবং মওলানা হোসেন আহমদ মদনীর মত ব্যাক্তি বর্গের। ঘটনা প্রবাহ আর ব্যাক্তিত্বের সঙ্গ আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়াছে। কিন্তু আমি যাহা বিশ্বাস করিয়াছি তাহা হইল : গড়িতে হইলে আগে ভাঙ্গিতে হয়। মানুষের মুক্তি আপোষরফায় আসে না, সুদূরপ্রসারী কর্মসূচিভিত্তিক বিপ্লবই এর একমাত্র পাথেয়।

কারাগারে আমার জীবনের অনেক কয়টি দিন কাটিয়াছে। আমি কিন্তু সেই দিনগুলিকে অযথা যাইতে দেই নাই। পাঁচ মিশালী চরিত্রের মানুষগুলিকে একত্রে পাইয়া দিনে দিনে অনেক শিখিয়াছি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কবিতাটি আজও আমার মনে পড়ে। কারাগারের এপাশে-ওপাশে তিনি হাঁটিতেন আর ধীরে ধীরে বলিতেনঃ
‘ওরে মন, হবেই হবে
যদি পণ করেই থাকিস
সে পণ রবেই রবে।’

কথাগুলি আমাদের নিকট মামুলি ধরণেরি মনে হইতো। কিন্তু জীবনের প্রবাহে প্রবাহে উপলব্ধি করিয়াছি এই কথা কয়টি কত কঠিন, কত বলিষ্ঠ। আমি একটি সিদ্ধান্তে গোড়া হইতেই পৌঁছাইয়াছিলাম। আমার রাজনৈতিক জীবনের এই ৬৮টি বৎসরে ইহার পরিবর্তন হয় নাই। তাহা হইল: আন্দোলনকে গ্রামে লইয়া যাওয়া এবং প্রত্যন্ত গ্রামের স্বরূপ হইতেই রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা সিদ্ধান্ত উদ্ধার করা। ইহার কারণ খুব সহজ। শতকরা ৯০ ভাগের বেশী লোক গ্রামে বাস করে। তাহাদের জিন্দেগী সুস্থ না হইলে দেশ ও জাতির কল্যান হইতে পারে না। আর একটি কারণ আছে বটে। শহুরে লোক লইয়া দীর্ঘ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় না। তাহারা কয়দিন পরই ভাঙ্গিয়া পড়ে। পক্ষান্তরে গ্রামের লোক কত দুঃসাহসী, কত আন্তরিক, কত অনুগত। এই তিনটি গুনের সমন্বয়ে কি যে অসাধ্য সাধন করা যায় তাহা আমি লিখিয়া শেষ করিতে পারিবোনা।

যে যাই বলুন না কেন জমিদার-মহাজনদের অপ্রতিরোধ অবিচার-শোষণ গ্রামের লোকই মোকাবিলা করিয়াছে। তাহাদের মধ্যে নেতৃত্ব ও ঐক্য দান করাটাই ছিল শুধু আমাদের কাজ। তাই আমি আজীবন সম্মেলনকে ভালবাসিয়াছি। ভাসান চরের সম্মেলন, ফুলছুড়ি ঘাটের সম্মেলন,ঘাগমারী সম্মেলন, সিরাজগঞ্জ সম্মেলন, কাগমারী সম্মেলন ইত্যাদী অত্যন্ত পরোক্ষ ভাবে হইলেও আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করিয়াছে। সূক্ষ্মভাবে যাচাই করিলে তাহা উপলব্ধি করে যাইবে। আর এইসব সম্মেলন করতে গিয়া আমি যেমন একাধারে সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটা আবিষ্কার করিয়াছি ঠিক পাশাপাশি তেমনি সেই সমাজভুক্ত মানুষের সুপ্ত মহাশক্তিকে উপলব্ধি করিয়াছি। সুত্র : বাংলা ভিশন টিভি