নিজস্ব জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে

- প্রকাশের সময় : ০৯:১৮:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মে ২০১৭
- / ৯৩৫ বার পঠিত
হার্ভার্ড (বোস্টন): বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ডার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ডেভোলপমেন্ট-২০১৭’ বিষয়ক এক কনফারেন্সে দেশ-বিদেশের উন্নয়ন বিষয়ক বক্তারা বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যুগান্তকারী। দেশটি তাদের নিজস্ব জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়েই উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আর এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দূর্নীতি রোধ ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা জরুরী বলে তারা অভিবত ব্যক্ত করেন। বক্তারা বলেন, ‘এমডিজি’র মতো এসডিজি বাস্তবায়নেও সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’।
বোস্টন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইন্যাবল ডেভোলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (আইএসডিআই) এবং হার্ভাড টিএইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথ্ ও হার্ভাড ল স্কুলের আওতাধীন ‘সাসটেইনিবিলিটি এন্ড হেলথ্ ইনিশিয়েটিভ ফর নেটপজিটিভ এন্টারপ্রাইজ (সাইন ইনিশিয়েটিভ)’ যৌথভাবে দু’দিনের (১২ ও ১৩ মে, শুক্র ও শনিবার) এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে সহযোগিতা প্রদান করে বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস্ অঙ্গরাজ্যের বোস্টনে অবস্থিত বিশ্বসেরা হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভাড ল স্কুলের মিলস্টেইন কনফারেন্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় কনফারেন্সটির মূল সেমিনার। মূল সেমিনারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অ্যাচিভিং এসডিজি-সাসটেইনঅ্যাবল ডেভোলপমেন্ট গোল থ্রু এন্ট্রিপ্রিনিউরশীপ, কর্মাস এন্ড ইনভেস্টমেন্ট’। কনফারেন্সে জাতিসংঘ ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারের প্রতিনিধিগণ, হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন বিশ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নীতি-নির্ধারক, থিংক ট্যাংক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ বক্তব্য রাখেন।
শুক্রবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয়ে বিকাল ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এ সেমিনারে ৭টি বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞগণ তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেন। বিষয়গুলো ছিল (১) এসডিজিস্ এন্ড স্যোসাল প্রটেকশন এন্ড লেবার স্ট্যান্ডার্ন্ড-মেজর চ্যালেঞ্জেস্ এন্ড অপরচুনিটিজ্ ফর বাংলাদেশ, (২) এন্ট্রিপ্রিনিউরিয়াল ইকোসিস্টেম এন্ড মিটিগেশন রিস্ক, (৩) চ্যালেঞ্জস্ এন্ড অপরচুনিটিস্ ফর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ, (৪) ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ফর এসডিজিস্, (৫) অ্যাফোর্ডেবল এন্ড ক্লিন এনার্জি: প্রসপেক্ট, অ্যাচিভমেন্ট এন্ড চ্যালেঞ্জেস্, (৬) ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভোলপমেন্ট ফর কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিস্ ও (৭) ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট ফর আইসিটি এন্ড টেকনোলজি সাসটেইনিবিলিটি।
শিক্ষক, গবেষক, নীতি নির্ধারক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত এ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থ-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান এনডিসি, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানসহ ব্যবসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সফল বাংলাদেশীগণ।
কনফারেন্সে আঙ্কটাড্ নিউইয়র্ক-এর প্রধান সান্তাল রাইন কারপেনটিয়ার, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাবেক উপ-প্রধান ডেভিড মিয়েলি এবং ইউএনসিডিএফ এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রুথ গুডউইন গ্রয়েন তাদের বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। এরফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারছে এবং উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপ এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ভূমিকা রাখছে’। এছাড়া রুথ গুডউইন গ্রয়েন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই এর প্রশংসা করে বলেন, ‘ডিজিটাল ফিনানসিয়াল ইকোসিস্টেম বাস্তবায়নে এটুআই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে যা এজডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অপরিহার্য’।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস ও বোস্টন ইনস্টিটিউট ফর ডেভোলপমেন্ট ইকোনমিক্স এর প্রেসিডেন্ট গুস্তাব পাপানেক বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারনে যেখানে বিশ্বের অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে সেখানে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে ৬ ভাগের উপরে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে যা বর্তমানে ৭ ভাগের উপরে। ৮০% থেকে দারিদ্র্য কমে বর্তমানে ৩০% এর নীচে নেমেছে। রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে যা বিশ্বের অনেক দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি’।
ড. মশিউর রহমান উপস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিনিধিসহ বিনিয়োগকারীদের এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘বিনিয়োগকে সহজ করার ক্ষেত্রে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সামর্থ্য বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে’। দেশের উদ্যেক্তাদের সমন্ধে তিনি বলেন, ‘নিজস্ব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই আমাদের এন্ট্রিপ্রিনিউরগণ দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে’।
উন্নয়ন অর্থায়নে ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে এসডিজি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া মাইক্রো সেভিংস মডেল বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভূক্তিকরণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সমূহকে গতিশীল করতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান তৈরি করার শেষধাপে রয়েছে। আমরা আশা করি বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে’।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়নে এই সেমিনার অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা দূরীকরণে জাতিসংঘসহ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে’।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গ্লোবাল এনট্রিপ্রিনিউরশীপ প্রোগামের পরিচালক থমাস ই. লার্সটেন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এন্ট্রিপ্রিনিউরশীপসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে যা উভয় দেশকেই সমানভাবে উপকৃত করছে’।
এমআইটি-লিগাটাম সেন্টার ফর ডিভিলপমেন্ট এন্ড এন্ট্রিপ্রিনিউরশীপ এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এমিরিটাস এবং গ্রামীণ ফোনের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইকবাল কাদির বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের ৮০% মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। টেলিকমিউনিকেশন খাতে প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ১৯৯৬ এর সরকারের সময় যা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত’। তিনি বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার ব্যবস্থা ‘বিকাশ’, প্রাইভেট ট্যাক্সি ‘উবার’ সহ এন্ট্রিপ্রিনিউরশীপ ডেভোলপমেন্টের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
শনিবার কনফারেন্সে ড. সিদ্দিকুর রহমান তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরেন এবং দেশের উন্নয়নের ব্যাপারে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি সহায়ক নীতি প্রণয়ন করে বাংলাদেশ উন্নয়ন চ্যালেঞ্জসমূহ সহজেই মোকাবিলা করতে পারবে বলে সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞগণ মতামত প্রদান করেন।
অন্যান্যদের মধ্যে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন হারভার্ড টি এইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথ্ এবং সাইন ইনিশিয়েটিভ এর কো-ডাইরেক্টর আইলিন ম্যকনিলি, লেবার এন্ড ওয়ার্ক রাইফ প্রগাম এর গবেষণা পরিচালক জন ট্রুমবর, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ভার্জিনিয়া গ্রীম্যান, সামিট গ্রুপের চেয়াম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভোলপমেন্ট অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম, জাতিসংঘের ইকোনমিক এন্ড স্যোসাল অ্যাফেয়ার্সের গ্লোবাল ইকোনমিক মনিটরিং বিভাগের প্রধান ড. হামিদ রশিদ, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাসটেইনঅ্যাবল ইনফ্রাস্টাকচার এর প্রোগ্রাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জুডিথ রডরিজগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক প্রশাসন ও এটুআই এর প্রকল্প পরিচালক কবির বিন আনোয়ার, এটুআই এর পলিসি অ্যাডভাইজর আনির চৌধুরীসহ প্রায় অর্ধশত বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ দিনব্যাপী এই সেমিনারে মূল্যবান বক্তব্য ও মতামত রাখেন। এছাড়া প্যানেলিস্ট ও বক্তাগণ অংশগ্রহণকারীদের বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত ও এসডিজি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।