নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সহজ নয়
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৫:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৭
- / ১১৩২ বার পঠিত
সালাহউদ্দিন আহমেদ: বিশিষ্ট ব্যাংকার, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচারক (এমডি) মোহাম্মদ রবিউল হোসেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সঙ্গত কারনেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশ এই দুই দেশের নিয়ম-কানুন মানা ছাড়াও ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নিউইয়র্কে সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি এখানে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভজনক নয়। কেননা, নিউইয়র্কে মানি ট্রন্সমিটারের ব্যবসা ‘কমিউনিটি বেইজড’। সোনালী এক্সচেঞ্জ সহ অন্যান্য মানি ট্রন্সমিটার প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলছে। সেই ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে আমেরিকান ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কমিউনিটির উপর ভরসা করে ব্যাংক চালানো কঠিন কাজ। সম্প্রতি নিউইয়র্কে এই প্রতিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে রবিউল হোসেন বলেন- বাংলাদেশের সর্বত্রই উন্নয়ন হচ্ছে। আর যেহেতু উন্নয়ন হচ্ছে, সেই হিসেবে ওভারঅল পরিস্থিতিও ভালো। তবে উন্নয়নের বেশীরভাগই হচ্ছে সরকারী পর্যায়ে। বেসরকারীভাবে উন্নয়ন কমই হচ্ছে। আর ব্যাংকিং খাতের কথা বললে, বলতে হবে ভালো না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার সম্পর্কে তিনি বলেন, এজন্য ব্যাংকারদের সিরিয়াসনের অভাবই মূল দায়ী। তানাহলে ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার বা দূর্নীতির ঘটনা একটার পর একটা কেনো ঘটছে। কোন ব্যাংকার যদি ঠিকমত সব জানেন এবং সঠিকভাবে সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করলে এমন ঘটনা ঘটনার কথা নয়। আসলে আমরা ব্যাংকিং জানিনা বা জেনেও তা প্রয়োগ করছি না। পাশাপাশি ব্যাংকিং নিয়ম-কানুন মানা যাচ্ছে না। অবার যে অর্থ খোয়া যাচ্ছে, তা আদায়ের ব্যবস্থা না থাকায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অপরদিকে ব্যাংক ও ঋৃণ গ্রহীতার মধ্যকার মামলা-মোকদ্দমায় সময় ক্ষেপনের ফলে অর্থ আদায় হচ্ছে না। মামলা মোকদ্দমায় রীট হওয়ার ফলে সময় ক্ষেপনও হচ্ছে। ফলে ঋণ আদায়ের হারও কম। আর যারা অর্থ লোপাট করছে তারা ব্যাংকের লোকের সহযোগিতা ছাড়া তা পারার কথা নয়।
ব্যাংকের দূর্নীতি বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশের চেয়ে সরকারের লিখিত আইন-কানুনকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে তা মেনে চলা উচিৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, মানুষ বা ব্যাংকের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার লোনের পরিমানও বাড়ছে। অথচ মানূস ও ব্যাংকের তার কার্যক্রম কমছে। অপরদিকে লোন দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লোনের অর্থ ফেরৎ নেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নতুনদের লোদ দিতে উৎসাহিত হতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার ও ব্যাংক সম্পর্কে রবিউল হোসেন বলেন, সকল ক্ষেতেই নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালা ব্যাংকগুলো কড়াকড়িভাবে মেনে চললে বড় ধরণের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, কেওয়াইসি (নো ইউর কাস্টমার) নীতি কঠোরভাবে মানলে অনেক সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব। অনেক সময় যথাযথ খোঁজখবর না নিয়ে জায়গা-জমি বা প্রোপার্টির অনুকূলে বড় অংর্কের অর্থ লোন দেয়া হচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে লোনের চেয়ে প্রপার্টির দাম কম। তখন লোন গ্রহিতা অর্থ ফেরৎ না দিয়ে প্রপার্টি দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যাংকের অর্থ লোপাট হচ্ছে আর দূর্নীতি বাড়ছে। তিনি দূঢ়তার সাথে বলেন, কোন সরকারই চায় না, তার বদনাম হোক। ব্যাংক পরিচালনার জন্য সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে ব্যর্থতা তাদের, সরকারের নয়।
বাংলাদেশে বেসরকারী ব্যাংক বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন, সমাজিক মর্যাদার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছেন বলেই দেশের এক শ্রেনীর মানুষ বেসরকারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করছেন। তবে মিউচ্যাল আনডাস্ট্যান্ডিং-এর মাধ্যমে লোন নেয়ার সুবিধা থাকায় অনেকেই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুযোগ নিচ্ছেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক ব্যাংকার রবিউল হোসেন বলেন, বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানী আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। তবে রেমিটেন্স সঠিকভাবে ব্যয় বা প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা সঠিকভাবে তদারকি দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন আছে- কোন জেলায়, কোন খাতে লোন দেয়া যাবে। ব্যাংকে বসে বসে দায়িত্ব পালন করলে চলবে না। বাস্তবতার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যাংককে। যারা ব্যাংকে আসবেন তাদেরকে লোন দিলেই চলবে না। লোন দেয়ার জন্য ব্যাংককে লোক খুঁজতে হবে।
দেশের বিসিক শিল্প নগরী সম্পর্কে তিনি বলেন, বিসিক নগরী প্রতিষ্ঠায় সরকারের সততার অভাব নেই। বিসিক নগরী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ভালো ছিলো। কিন্তু সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের সিরিয়স বা সততার অভাবের কারনেই অধিকাংশ বিসিক নগরীগুলো মুখ থুবরে পড়ে আছে।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরকে শক্তিশালী করতে তিনি মনে করেন যে, যারা প্রকৃত অর্থেই ব্যাংকার বা অবসরে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতা কাজ লাগানো দরকার। ডিম্যান্ড গ্যাপ খুজে বের করতে সার্ভে করা দরকার। লোনের ক্ষেত্রে পার্টির প্রপোজাল সঠিকভাবে তদারকি করা দরকার। লোনের ক্ষেত্রে ব্যাংক আর ব্যাংকের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করা। পেশাদার ব্যাংকার দিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করার পাশাপাশি সৎ ব্যাংকিংক জোরদার করা। সেই সাথে অবধারীতভাবে সকল ব্যাংকের এমডিকে কাজ জানা এবং শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করা।
এক নজরে ব্যাংকার রবিউল হোসেন
পুরো নাম: রবিউল হোসেন
জন্ম: ১৯৪৫, চুয়াডাঙ্গা
স্ত্রী: বেগম মমতাজ হোসেন (গৃহীনি)
পিতার নাম: মরহুম শাহাদৎ হোসেন
মাতার নাম: মরহুমা সায়মুন নাহার
শিক্ষা: এমকম (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) ও ব্যাংকিং ডিপ্লোমা।
কর্মজীবন: ব্যাংক যোগদান- ১৯৬৮ সালের পহেলা এপ্রিল ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড (জনতা ব্যাংক)-এ যোগদান। পরবর্তীতে ১৯৯৫ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে (জিএম) দায়িত্ব পালন। এক বছর তিন মাস বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (জিএম), সোনালী ব্যাংক, লন্ডন শাখার প্রধান নির্বাহী (এক বছর ৮ মাস)। জিএম অগ্রনী ব্যাংক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা (১০ মাস)। এমডি বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিডিবিএল) এক বছর তিন মাস। এমডি রূপালী ব্যাংক (এক বছর)। এমডি সোনালী ব্যাংক (২ বছর ৮ মাস)। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭ বছর (২ বছর কনসালটেন্ট ৫ বছর ট্রেনিং ইন্সটিটিউট প্রধান)।
অবসর: ২০০৪ সালের জুন।
ছেলে-মেয়ে: এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেরে রক সুমন রকেফেলার (৪৭) পরিচালক কেপিএমজি, নিউইয়র্ক। মেয়ে ইসরাত হোসেন মিথিলা (৩১) ঢাকায় একটি বিদেশী ব্যাংকে কর্মরত।
দুটি গ্রস্থ প্রকাশ: ‘জীবন ও মানুষ ব্যাংক ও ব্যাংকিং’ (২০১৩) এবং ‘একজন ব্যাংকারের দূর্লভ অভিজ্ঞতা’ (২০১৭)।