জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলায় খালেদা জিয়ার ৫ বছর, তারেক রহমানসহ ৫ জনের ১০ বছর কারাদন্ড
- প্রকাশের সময় : ০৭:৪৬:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
- / ১৩০৪ বার পঠিত
ঢাকা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারী) এ রায় দেন। রায়ের পরপরই বেগম খালেদা জিয়াকে আদালত থেকে গ্রেফতার করে পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা আর দেশব্যাপী টানটান উত্তেজনার মধ্যে ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান এ রায় দেন। একই মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় অপর চার আসামিকেও ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া অপর আসামিদের প্রত্যেককে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট থেকে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
রায়ে বিচারক বলেন, ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের এ দন্ড দেয়া হলো। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া এ মামলায় অপর যে চার আসামিকে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে তারা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। রায়ে বলা হয়েছে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও বেগম খালেদা জিয়ার বয়স এবং সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় তাকে অন্যদের তুলনায় কম সাজা দেয়া হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাদের সকালে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয় রায় ঘোষণা উপলক্ষে। পরে তাদের কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া জামিনে থাকা বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হন। বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। অপর দুই আসামি ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান পলাতক আছেন।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক। দুই বছর মেয়াদি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের সময় জরুরী অবস্থা চলাকালে ২০০৭ সালে গ্রেফতার করা হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। সংসদ এলাকায় একটি সাব জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালে মামলাটি দায়ের করে দুদক। পরে এ মামলায় বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়। প্রায় ১০ বছরের মাথায় বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারী) রায় দেয়া হলো এ মামলার। ২০০৭ সালে সাব জেলে বন্দী থাকার পর বেগম খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে দ্বিতীয়বার কারাবন্দী হলেন।
বেগম খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার ১টা ৪৮ মিনিটে আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন এবং তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসেন। ২টা ১১ মিনিটে বিচারক ড. আখতারুজ্জামান আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনকে আদালত থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর বিচারক বলেন, মামলার রায়টি মোট ৬৩২ পৃষ্ঠার। তবে পুরো রায় না পড়ে রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ার কথা জানান তিনি। এরপর তিনি মামলা এবং অভিযোগ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে ১১টি পয়েন্ট উল্লেখ করেন।
এগুলো হচ্ছে- ১৯৯১-২০৯৬ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়া তার একান্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক রমনা শাখায় হিসাব খুলেছেন কি না, সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ইউএস ডলার ওই অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে কি না, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না, আসামিদের শাস্তি পাওয়া উচিত কি না, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কি না, তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এবং অন্য আসামিরা নির্দোষ দাবি করেছেন কিন্তু দাবির পক্ষে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। অপর দিকে দন্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারা এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় দুদক যে অভিযোগ এনেছে ৩২ জন সাক্ষীর মাধ্যমে তারা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন বিচারক। পরে দ্রুত রায় ঘোষণা করে ২০ মিনিটের মধ্যে আদালত কক্ষ ত্যাগ করেন বিচারক।
রায়ে ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ দায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
৪০৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে তাহার ব্যবসায় বা দেশে যেকোনো প্রকারে কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবে। দুদক আইনের ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ করিলে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের যোগ্য হইবেন। অপরাধমূলক অসদাচরণ সংশ্লিষ্ট আর্থিক সম্পদ অথবা সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হইবে।
দীর্ঘ এ মামলার বিচার চলাকালে মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে বেশ কয়েকবার উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার অনাস্থার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে দুই বার বিচারক পরিবর্তন করা হয়। ড. আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধেও অনাস্থার আবেদন করা হলে তা নাকচ করে দেন হাইকোর্ট। মামলা চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে।
বিএনপি নেতা ও আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বারবার এ মামলাকে মিথ্যা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক এবং বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও তারা বারবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ন্যায়বিচার হলে অবশ্যই বেগম জিয়া সম্পূর্ণ খালাস পাবেন। তারা আরো বলেছেন, সরকারি দলের লোকজনের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে রায় আগে থেকেই সাজানো রয়েছে।
রায়ের আগের দিন গত বুধবার গুলশানে নিজের কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনেও বেগম খালেদা জিয়া ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
অপর দিকে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল বেগম খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটল।
মামলার রায় ঘিরে বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারী) রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আলিয়া মাদরাসার আশপাশের সব রাস্তা, অলিগলিতে যানবাহন প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। আলিয়া মাদরাসার দিকে সব রাস্তার প্রবেশ পথে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। সকাল থেকেই বিপুল বিএনপি সমর্থক আইনজীবী এবং সাংবাদিকেরা উপস্থিত হন আলিয়া মাদরাসার মাঠে নবকুমার ইনস্টিটিউশন ও ড. শহীদুল্লাহ কলেজের সামনের রাস্তার প্রবেশ পথে। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নেয় শত শত পুলিশ। বেগম খালেদা জিয়ার ২০ জনের মতো সিনিয়র আইনজীবী ছাড়া আর কোনো আইনজীবীকে আদালতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। মাসুদ রানা ও নজরুল ইসলাম পাপ্পু এ সময় পুলিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, আদালত আইনজীবীদের জন্য। আইনজীবীদের আদালতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না এটা কেমন কথা। আপনারা সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। আইনজীবী মাসুদ রানা বলেন, আমিসহ যারা এ মামলার তালিকাভুক্ত আইনজীবী তাদেরও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
মামলা চলাকালে বিএনপির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনজীবীকে আদালতে ঢুকতে দেয়া হলেও বৃহস্পতিবার এ ক্ষেত্রে তীব্র কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এ নিয়ে পুলিশের সাথে প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি হয় আইনজীবীদের। একপর্যায়ে আইনজীবীদের মাঠের প্রবেশ মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে র্যাব নিয়ন্ত্রণে নেয় প্রবেশ পথের। পরে আইনজীবীরা সেখানে নানা ধরনের শ্লোগান দিতে থাকেন এবং বেগম খালেদা জিয়া আসা ও রায় ঘোষণা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন। বেগম খালেদা জিয়া আসার বেশ আগে থেকেই তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে। এ সময় প্রত্যেক আইনজীবীর সামনে একজন করে পুলিশও দাঁড়িয়ে থাকেন তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। বেগম খালেদা জিয়া আসার সময় আইনজীবীরা তার পক্ষে শ্লোগান দেন। রায় ঘোষণার পরও রায়ের বিরুদ্ধে তারা শ্লোগান দেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ মাত্র চারজন সিনিয়র নেতাকে আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
আদালত কক্ষে বিপুল পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন উপস্থিত ছিলেন। পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে নারী পুলিশ উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১০০। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। আদালতের বাইরে মাঠে শত শত পুলিশ, র্যাব, ডিবি সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান ছিলেন। মহিলা র্যাব সদস্যও ছিলেন শতাধিক।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায় ছয় আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধির ৪০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন।
বেগম খালেদা জিয়া এবং অপর আসামিদের পক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন, জমির উদ্দিন সরকার, মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, আব্দুর রেজাক খান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, জয়নুল আবেদীন, সানা উল্লাহ মিঞা, আহসান উল্লাহ, সৈয়দ মিজানুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, মাহবুব উদ্দিন খোকন, কায়সার কামাল, জাকির হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন দুদকের অস্থায়ী পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল। (দৈনিক নয়া দিগন্ত)