নিউইয়র্ক ০৪:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ২৭ আগষ্ট

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:২২:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৫
  • / ১৮২৪ বার পঠিত

ঢাকা: তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ বিশ্ব মানবতার জয়গানে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূ-লোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’- ওঠার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে খুলে দিয়েছেন বিস্ময়কর নতুন দিগনমশ। প্রেম দ্রোহ সাম্য মানবতার মহাকবি তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজাংল ইসলাম। বিস্ময়কর এই তূর্যবাদকের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী । ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) ১১৭ নম্বর কেবিনে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। সে দিন ছিল বাংলা ১২ ভাদ্র। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও নজরুল কখনো আপস করেননি। ‘চির বিদ্রোহী বীর’, ‘চির উন্নত শির’-এর কবি মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবতা আর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমন্ডকূতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্য গগনে। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন অভাবনীয় কণ্ঠ। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্…’। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে দুরন্ত এক শিশুর জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে)। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গোটা উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি ও চেতনার মহাকবি। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলে, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি করে অজেয় শক্তির লেখনী দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে জেল খেটেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সব অবিচার-অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছেন দুহাতে। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও। ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক, নতুন ধারা, নতুন মাত্রার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। শুধু কবিতাতেই নয়, বাংলায় সঙ্গীত সৃষ্টিতে নজরুল অভূতপূর্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার সঙ্গীত রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সঙ্গীতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্ব পরিচিতি, বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার অনন্য সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি।
নজরুল তদানীন্তন পূর্ববাংলায় তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছেন অনেকবার। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুরে কৈশরের অনেকটা সময় কেটেছে তার। জীবনের মধ্যপথে তেজোদ্দীপ্ত কবি অকস্মাৎ নির্বাক হয়ে যান। চিরতরে মূক হয়ে পড়েন গানের পাখি। সময়টা ১৯৪২ সালের শেষার্ধ।
১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারী তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। দেশে ফেরার পর ঢাকার বাইরে একমাত্র টাঙ্গাইল সফর করে কাজী নজরুল ইসলাম। কবির স্মরণে টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নজরুল সেনা’র পক্ষ থেকে নির্বাক কবিকে প্রণঢালা সম্বর্ধণা দেয়া হয়। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় মহাকবিকে। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে জাতীয় কবিকে। কবি স্মরণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। আজ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে কবির সমাধি ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
খালেদা জিয়ার বাণী: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাণীতে তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতির সামনে চলার পথে অন্তহীন প্রেরণার উৎস। আমরা সবাই জানি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার কবিতা ও গান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আজও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তার কবিতা ও গান আমাদের শক্তি, সাহস জোগায়। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম মানবতা ও সাম্যের চেতনায় তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমকে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন উল্লেখ করে বাণীতে বলা হয়, তার রচিত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম তাকে বিদ্রোহী কবির খ্যাতিও দিয়েছে।
কর্মসূচী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের এক সংবাদ বিঞ্জপ্তিতে বলা হয়, কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সকাল ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমাবেশ ও সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে উপাচার্যের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সহকারে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে গমন, পুষ্পার্পণ এবং ফাতেহা পাঠ। পরে কবির মাজার প্রাঙ্গণে উপাচাযের্র সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সকাল ৮টায় জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পমাল্য নিবেদন, ফাতেয়া পাঠ ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার আহবান জানিয়েছেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ জনি স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পুস্পার্ঘ্য অর্পণ অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং বিএনপি’র মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপনসহ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে যথাসময়ে মাজার প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে দলের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিশ্ব বাঙ্গালী সম্মেলন ও বিশ্ব কবিতা কংগ্রেস সকালে ৮টা ৩০ মিনিটে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও রুহের মাগফেরাত কামনা সহ মোনাজাত এবং কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে ।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী বুধবার বিকেল ৪টায় একাডেমীর কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তণে একক বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ।
এ দিকে জাতীয় কবির ৩৯তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতিজড়িত কুমিল্লায় নজরুল পরিষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে চেতনায় নজরুল স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এছাড়াও দিবসের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি, হাম-নাত পরিবেশন ও দোয়া মাহফিল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ২৭ আগষ্ট

প্রকাশের সময় : ০২:২২:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৫

ঢাকা: তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ বিশ্ব মানবতার জয়গানে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূ-লোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’- ওঠার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে খুলে দিয়েছেন বিস্ময়কর নতুন দিগনমশ। প্রেম দ্রোহ সাম্য মানবতার মহাকবি তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজাংল ইসলাম। বিস্ময়কর এই তূর্যবাদকের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী । ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) ১১৭ নম্বর কেবিনে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। সে দিন ছিল বাংলা ১২ ভাদ্র। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও নজরুল কখনো আপস করেননি। ‘চির বিদ্রোহী বীর’, ‘চির উন্নত শির’-এর কবি মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবতা আর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমন্ডকূতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্য গগনে। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন অভাবনীয় কণ্ঠ। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্…’। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে দুরন্ত এক শিশুর জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে)। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গোটা উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি ও চেতনার মহাকবি। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলে, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি করে অজেয় শক্তির লেখনী দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে জেল খেটেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সব অবিচার-অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছেন দুহাতে। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও। ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক, নতুন ধারা, নতুন মাত্রার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। শুধু কবিতাতেই নয়, বাংলায় সঙ্গীত সৃষ্টিতে নজরুল অভূতপূর্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার সঙ্গীত রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সঙ্গীতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্ব পরিচিতি, বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার অনন্য সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি।
নজরুল তদানীন্তন পূর্ববাংলায় তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছেন অনেকবার। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুরে কৈশরের অনেকটা সময় কেটেছে তার। জীবনের মধ্যপথে তেজোদ্দীপ্ত কবি অকস্মাৎ নির্বাক হয়ে যান। চিরতরে মূক হয়ে পড়েন গানের পাখি। সময়টা ১৯৪২ সালের শেষার্ধ।
১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারী তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। দেশে ফেরার পর ঢাকার বাইরে একমাত্র টাঙ্গাইল সফর করে কাজী নজরুল ইসলাম। কবির স্মরণে টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নজরুল সেনা’র পক্ষ থেকে নির্বাক কবিকে প্রণঢালা সম্বর্ধণা দেয়া হয়। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় মহাকবিকে। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে জাতীয় কবিকে। কবি স্মরণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। আজ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে কবির সমাধি ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
খালেদা জিয়ার বাণী: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাণীতে তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতির সামনে চলার পথে অন্তহীন প্রেরণার উৎস। আমরা সবাই জানি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার কবিতা ও গান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আজও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তার কবিতা ও গান আমাদের শক্তি, সাহস জোগায়। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম মানবতা ও সাম্যের চেতনায় তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমকে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন উল্লেখ করে বাণীতে বলা হয়, তার রচিত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম তাকে বিদ্রোহী কবির খ্যাতিও দিয়েছে।
কর্মসূচী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের এক সংবাদ বিঞ্জপ্তিতে বলা হয়, কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সকাল ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমাবেশ ও সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে উপাচার্যের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সহকারে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে গমন, পুষ্পার্পণ এবং ফাতেহা পাঠ। পরে কবির মাজার প্রাঙ্গণে উপাচাযের্র সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সকাল ৮টায় জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পমাল্য নিবেদন, ফাতেয়া পাঠ ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার আহবান জানিয়েছেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ জনি স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পুস্পার্ঘ্য অর্পণ অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং বিএনপি’র মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপনসহ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে যথাসময়ে মাজার প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে দলের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিশ্ব বাঙ্গালী সম্মেলন ও বিশ্ব কবিতা কংগ্রেস সকালে ৮টা ৩০ মিনিটে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও রুহের মাগফেরাত কামনা সহ মোনাজাত এবং কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে ।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী বুধবার বিকেল ৪টায় একাডেমীর কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তণে একক বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ।
এ দিকে জাতীয় কবির ৩৯তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতিজড়িত কুমিল্লায় নজরুল পরিষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে চেতনায় নজরুল স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এছাড়াও দিবসের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি, হাম-নাত পরিবেশন ও দোয়া মাহফিল।