‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির হিড়িক
- প্রকাশের সময় : ০৯:৫৬:০৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০১৯
- / ৩৮১ বার পঠিত
ঢাকার বাড্ডায় ছেলেধরা গুজবে তাসলিমা বেগম রানুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উশৃঙ্খল কিছু যুবক তাকে পেটায়। লাল দাগ চিহ্নিত যুবকটিকে পেটাতে দেখা যায়। ইনসেটে নিহত তাসলিমা। ছবি: সংগৃহীত
হককথা ডেস্ক: দেশে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার ভয়াবহ প্রবণতা শুরু হয়েছে। নিছক সন্দেহের বশে পিটুনির ফলে অনেকের মৃত্যুও ঘটছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পুত্রশত্রুতার জের ধরেও জনতাকে দিয়ে হত্যা করাতে কাউকে ভীড়ের মধ্যে গিয়ে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। ফলে যেকোন নির্দোষ ব্যক্তি যেকোন সময় এই ঘটনার শিকার হতে পারেন। গণপিটুনিতে মৌলভীবাজার ও সাভারে আরো দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ৭ জেলায় আহত হয়েছে আরো ১৩ জন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি (৫০) নিহত হয়েছেন। গত শনিবার (২০ জুলাই) গভীর রাতে রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয়রা জানান, এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে ঐ ব্যক্তিকে চা শ্রমিকরা আটক করে তার নাম পরিচয় জানতে চায়। অসংলগ্ন কথাবার্তায় ছেলেধরা সন্দেহে তাকে শ্রমিকরা পিটুনি দিয়ে গুরুতরভাবে আহত করে। রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করেন।
অন্যদিকে, সাভারে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত পরিচয় এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। শনিবার তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এ গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৮শ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ওই নারী প্রথমে তেঁতুলঝোড়া এলাকার জজ মিয়ার বাড়িতে বাড়ি ভাড়া নিতে যান। সেখানে পছন্দমতো ঘর না পরে পার্শ্ববর্তী ফারুক মিয়ার বাসায় যান। বাসা দেখে বের হওয়ার সময় কে বা কারা তাকে ‘ছেলেধরা’ বলে মারধর শুরু করে। এরপর আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। একপর্যায়ে সবাই মিলে তাকে মারতে মারতে প্রায় পাঁচশ গজ দুরে হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কে নিয়ে যায়। জনতা তাকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে এবং পা দিয়ে পিষে মারতে থাকে। ঘটনাটি সাভার মডেল থানায় জানানো হলে স্থানীয় ট্যানারি ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছে তাকে মারাত্মক জখম ও অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯ টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
পৃথক ঘটনায় নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে ছেলেধরা সন্দেহে (৬৫) বছর বয়সের এক বৃদ্ধা মহিলাকে পিটুনি দিয়ে পুলিশ সোর্পদ করেছে এলাকাবাসী। গতকাল সকাল ৮টার দিকে উপজেলার সদর পৌরসভার মসজিদ এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। পরে জানা জায় তিনি মানসিক প্রতিবন্ধি। ভিক্ষা করতে ওই এলাকায় গিয়ে ছিলেন। রাবেয়া বেগম নামের ওই নারীর বাড়ি গোপালদী পৌর সভার মোল্লার চর গ্রামে।
এদিকে, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে একই সন্দেহে এক যুবককে স্থানীয় জনতা আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। শনিবার রাত ৮ টার দিকে উপজেলার ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের হিম্মতনগর বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। গণধোলাইয়ের শিকার যুবকের নাম মোঃ নাসির উদ্দিন (২৫)। সে উপজেলার অচিন্তপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের আঃ রাশিদের ছেলে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ওই ব্যক্তিকে গৌরীপুর ইউনিয়নের হিম্মতনগর বাজারে এলাকায় দেখে অপরিচিত হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হয়। এক পর্যায়ে তারা তাকে ধরে গণপিটুনি শুরু করে। নাসির উদ্দিন জানান, পাশের গ্রামের বন্ধু জুয়েলের সাথে সাক্ষাত করতে তিনি হিম্মতনগরে যান। কোনো একজনকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে জনতা দৌড়তে থাকলে আমিও দৌড়াতে থাকি। হঠাত্ আমি এক বাড়ীর সামনে পড়ে যাই। এ সময় আমাকে একজন জড়িয়ে ধরে বলে ‘ছেলেধরা পাইছি’। আমি যতই বলি আমার বাড়ী পাশের গ্রাম কৃষ্ণপুর, ছেলেধরা নই। কিন্তু কোন কথা না শুনেই তারা আমাকে গণপিটুনি দেয়।
অন্যদিকে, নাটোরে ছেলে ধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেয়ার সময় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন জানান, দুপুরে শহরের হাফরাস্তা তালতলা এলাকায় এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসী তাকে ধরে গণপিটুনি শুরু করে। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জানায় উদ্ধারকৃত ব্যক্তি একজন মানসিক প্রতিবন্ধি।
রাজশাহীর তানোরেও ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। শনিবার বিকেলে উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহাড়া ও কামারগাঁ ইউনিয়নের কচুয়া এলাকায় এ দুই ঘটনা ঘটে।
পৃথক ঘটনায় নওগাঁর মান্দায় পুকুর থেকে মাছ ধরার সময় ৬ জেলেকে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ওই ৬ জেলেকে উদ্ধার করেছে। রোববার সকালে ৯ টার দিকে উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে রঞ্জিত কুমারের পুকুরে এই ঘটনা ঘটে। ওই ছয় জেলের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলায়।
দ্বিতীয় ঘটনায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক প্রতিবন্ধী এক নারীকে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। শনিবার পৌর এলাকার শ্রীমন্ত পুরে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। ওসি জানান, ওই নারীর ছেলে রাজশাহী কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার সোনালী ব্যাংকে চাকুরী করেন।
এছাড়া, পাবনার চাটমোহরে ছেলে ধরা সন্দেহে এক যুবককে আটক করে এলাকাবাসী মারপিট করে থানা পুলিশে সোপর্দ করেছে। আটককৃত যুবক জেলার ঈশ্বরদী আমবাগানের ফরিদুল ইসলামের ছেলে রাসেল হোসেন (২৫)। শনিবার দুপুরের দিকে উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের বনগ্রাম দীঘিপাড়া গ্রাম থেকে তাকে আটক করা হয়। দুপুরের দিকে রাসেল একটি বস্তা নিয়ে বনগ্রাম দীঘিপাড়ায় ঘোরাফেরা করছিল। এসময় ওই পাড়ার নায়েব আলীর স্ত্রী মুক্তি খাতুন দেখতে পান তার ৩ বছরের শিশু সন্তান আব্দুল্লাহকে ওই যুবক আদর করছে। তিনি দেখেই ছেলেধরা বলে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এসে রাসেলকে আটক করে।
পৃথক ঘটনায় টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছেলে ধরা সন্দেহে অজ্ঞাত এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয় জনতা। রোববার দুপুর ২ টার দিকে উপজেলার সয়া বাজারে এই ঘটনা ঘটে। সয়া বাজারে একটি সিএনজি করে এক অজ্ঞাত যুবককে দুইজন শিশুকে নিয়ে যেতে দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। স্থানীয় জনতা ওই যুবককে পিটুনি দিয়ে পুলিশে খবর দেয়।
এদিকে, সিদ্ধিরগঞ্জে গনপিটুনিতে নিহত সিরাজের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রোববার বিকাল ৪ টায় সিদ্ধিরগঞ্জ সাইলো রোড মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে নামাজে জানাা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। শনিবার সকালে নিজের মেয়েকে আদর করতে গিয়ে এলাকাবাসী ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিলে হাসপাতালে সে মারা যায়।
জানা যায়, নিহত সিরাজ (৩৫) সিদ্ধিরগঞ্জের কলাবাগ পশ্চিম এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিল। ভোলার লাল মোহন থানার মুগিয়া বাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদের ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে সিরাজ ছিল সবার বড়। এই ঘটনায় রোববার সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলায় ৮৮ জনের নাম উল্লেখ ও সাড়ে ৩ শতাধিক লোককে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। ১৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
রাজশাহীতেও গুজব: রাজশাহী অঞ্চলে ‘ছেলেধরা গুজব’ ডালপালা আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এনিয়ে স্থানীয় জনমনে রীতিমত আতঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলেধরা সন্দেহে গত দু’দিনে অন্তত ১২ ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এধরনের গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, এ ধরনের গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। এদিকে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় থানা পুলিশকে মাইকিং করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শহিদুল্লাহ সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেধরা’র বিষয়টি একেবারেই গুজব। কোনো মহল হয়তো অসত উদ্দেশ্যে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই আতঙ্কে কোনো শিশুর যেন স্কুলে যাওয়া বন্ধ না হয়। কারও আচরণ সন্দেহজনক হলে পুলিশকে অবহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। (দৈনিক ইত্তেফাক)