খোঁড়া হয়ে গেছে বিএনপি: ইকোনমিস্ট
- প্রকাশের সময় : ১০:১৬:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
- / ৮৯০ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। আরও পাঁচজনের সঙ্গে ১০ বছরের সাজা হয়েছে তার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও। বাংলাদেশের রাজনীতির এই ‘মোড় পরিবর্তনের’ খবর দেশের বাইরেও ফলাও করে প্রচার হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। খালেদা ও তারেক রহমানের রায়, আগামী সংসদ নির্বাচন এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্বাপর নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
“ইন দ্য ডক অ্যান্ড অন দ্য রোপস : দ্য কনভিকশন অব খালেদা জিয়া হবলস বাংলাদেশ’স অপজিশন” তথা ‘আদালতের কাঠগড়ায় এবং সুতোয় হাঁটা : খালেদার সাজায় খোঁড়া হয়ে গেল বাংলাদেশের বিরোধী দল’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন সাময়িকীটির প্রিন্ট সংস্করণের এশিয়া বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে।
গত এক দশক ধরে কোর্ট-কাচারিতেই বেশি সময় কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। তার নামে ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারির রায়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের স্মৃতি ধরে রাখতে এতিমদের জন্য গড়া একটি তহবিল থেকে ১৯৯১ সালে টাকা চুরির জন্য প্রথমবারের মতো দোষী সাব্যস্ত হলেন বেগম জিয়া। জিয়াউর রহমান একটি সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা আসেন, আবার তিনি নিজেও একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন।
বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল- বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিলের সময় জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকলেও খালেদার ভাগ্য প্রায় নির্ধারিতই হয়ে গেছে বলা যায়।
এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের দ্বি-দলীয় শাসনব্যবস্থার অবসান ও ‘জিয়া বংশের’ পতনের পথ প্রশস্থ হল। এতোদিন পর্যন্ত বিএনপি ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে।
‘দুই বেগম’ হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে বাংলাদেশের রাজনীতির অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়। কিন্তু, গত দশ বছরে খালেদা জিয়ার ক্ষমতা বেশ কমে গেছে। প্রথমে, সেনা সমর্থিত একটি সরকার ও পরে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মামলার পর মামলা দিয়ে তাকে কাবু করে ফেলে।
নির্বাচনের সময় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এড়াতে আওয়ামী লীগ সংবিধানে রদবদল করছে- এই অভিযোগে বিএনপি সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে। এর ফলে বর্তমান সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি নেই।
‘খালেদা জিয়া আমাদের নেত্রী, জিয়াউর রহমান আমাদের আদর্শ এবং তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যৎ’- এটিই ছিল বিএনপির শ্লোগান। কিন্তু, এখন ৭২ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ভালো নয়, এবং রায়ের ফলে হয়তো তিনি ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে অংশ নিতে পারবেন না।
আবার, তার ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী তারেক রহমানও নির্বাসনে। তার মা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় থাকার সময় বিভিন্ন অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। ওই পাঁচ বছর বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- শেখ হাসিনা এই ঘোষণা দেয়ার এক সপ্তাহ পর এই রায় দেয়া হলো। নির্বাচনে তার হারার কোনো ইচ্ছা আছে সেটা কেউ কল্পনাও করছে না। তিনি ২০১৪ সালে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী এবং সাবেক স্বৈরশাসক ও বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দলের নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে একটি সামরিক হাসপাতালে অবরুদ্ধ করেন।
সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ফলে বিএনপির সহযোগী ধর্মীয় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
এসব সত্ত্বেও সরকার চাইবে বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, যেন এটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো হাস্যকর মনে না হয়। ওই নির্বাচনে অর্ধেকেরও কম সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, একটি কার্যকর নির্বাচন আয়োজন করতে হলে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এমনকি বেশিরভাগ সময় নিরবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া ভারতও একটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়েছে।
তত্ত্বীয়ভাবে বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অথবা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া খালেদা জিয়ার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
ক্ষমতাসীন দল চাইলে কাউকে আকর্ষণীয় পদে নিযুক্ত করতে পারে আবার সব মামলাও তুলে নিতে পারে। ঢাকার বিভিন্ন আলোচক মহল মনে করছে- বিএনপি, অন্তত এর একটি অংশ রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার চাইতে সংসদে একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকাটাই পছন্দ করতে পারে।
তবে এই মুহূর্তে বিএনপিকে তাদের অবস্থানে অনড় মনে হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা নিশ্চিত করেছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তারা সেটি বয়কট করবেন। যেন তাদের কথার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতেই সরকার এই সপ্তাহে ১১শ’রও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে।
বিরোধী দলের বিক্ষোভকারীদের রাজধানী ঢাকার বাইরে রাখতে তারা চেকপয়েন্টও বসিয়েছে। বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা সতর্ক করে দিয়েছেন, এসব দমন অভিযান ও দন্ডাদেশের ফলে দলের মধ্যমপন্থী নেতাদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনের সমর্থকরা আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
অবশ্য তাতে শেখ হাসিনা বিশেষ ভীত হবেন না। তিনি ২০১৪ সালে নির্বাচন কেন্দ্রে বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের মোকাবেলা করেছেন। একই সঙ্গে সতর্কভাবে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। গত দশ বছরে সামরিক বাহিনীর আকার দ্বিগুণ করা হয়েছে এবং অনেক নতুন নতুন ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। আপাতত, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনো উপায়ই দেখা যাচ্ছে না।