নিউইয়র্ক ০৭:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834
নিউইয়র্কের আসন্ন মেয়র নির্বাচন ঘিরে মুসলিম শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের আশা ও বাস্তবতা

ব্রঙ্কস থেকে ব্রুকলীন : ধর্ম নয় ভাড়াই এখন বড় আলোচনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৪৯:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১৬ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: যুক্তরষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। আগামী নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে শহরের শ্রমিক শ্রেণীর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আলোচনা ও উদ্বেগ, তা চিরাচরিত ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে এখন সাশ্রয়ী জীবনযাপন ও ভাড়া নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদার দিকে মোড় নিয়েছে। নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভোটাররা কীভাবে পরিস্থিতি দেখছেন, তা জানতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন শ্রমিক শ্রেণীর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পরিদর্শন করেছে।
মরিসানিয়া, ব্রঙ্কস : মামদানির বার্তা সহজ জীবনযাত্রার
ব্রঙ্কসের মরিসানিয়া পাড়ায় কান পাতলেই প্রায়শই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়- ‘মামদানি, মামদানি, মামদানি’। এই এলাকাটি দ্রুত বর্ধনশীল পশ্চিম আফ্রিকান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল- যাদের মধ্যে অনেক নতুন মুসলিম অভিবাসীও রয়েছেন। এই মরিসানিয়া তেমনই এক অঞ্চল যেখানে আগামী ৪ নভেম্বরের নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের আগে জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্নটি শ্রমিক শ্রেণীর চাহিদার সাথে একীভূত হয়ে গেছে।
এই সম্প্রদায়ের অনেকেই ৩৪ বছর বয়সী মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানির জয়ের উপর গভীর আস্থা রাখছেন। কারণ, প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর বিরুদ্ধে মামদানির এই জয় নিউইয়র্ক সিটির জন্য এক ঐতিহাসিক প্রথম সাফল্যের সিরিজ হিসেবে চিহ্নিত হবে- এটি শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র, আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরটির নেতৃত্বদানকারী প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির আগমনকে সূচিত করবে। এই বাস্তবতা শহরের কাঠামোর সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়া এবং বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষের ভয়াবহ স্মৃতিও জাগিয়ে তুলেছে।
কিন্তু মরিসানিয়ার একজন দোকান মালিক আইচা ডনজার জন্য, যেখানে বার্ষিক গড় আয় শহরের গড়ের প্রায় অর্ধেক, এটি কোনও ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্ন নয়। স্বীকৃত ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট এই প্রার্থীর সাশ্রয়ী মূল্যের বার্তা, বিনামূল্যের বাসের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি, নির্দিষ্ট ভবনের ভাড়া স্থগিতকরণ এবং সর্বজনীন শিশু যত্ন, যা আংশিকভাবে ধনীদের উপর কর বৃদ্ধি করে পরিশোধ করা হবে, তার সমর্থন অর্জন করেছে।
ডনজা আল জাজিরাকে বলেন, ‘তিনি (মারদানি) বলছেন, তিনি জিনিসগুলি আরো সহজ করে দেবেন।’ ডনজা তার দোকানে রাখা ঘানা থেকে আনা কলা গুঁড়ো; তার জন্মস্থান লাইবেরিয়া থেকে আমদানি করা পাম তেল; তুরস্ক, মিশর এবং সউদী আরব থেকে আমদানি করা ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক পোশাক দেখিয়ে আরো বলেন, এখানাকার ভাড়া এত বেশি যে প্রতিদিন লোকেরা দোকানে আসে, তারা বলে দাম অনেক বেশি। আর বিনামূল্যের বাস, যদি সে তা পরিচালনা করতে পারে, তাহলে তা অনেক বড় পার্থক্য আনবে।
পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা : নতুন প্রজন্মের নতুন ধারণা
ব্রঙ্কসের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের বাইরে নামাজ শেষে ৬০ বছর বয়সী গাম্বিয়ান বংশোদ্ভূত এসা টুনকালা বলেন, ‘এটা প্রায় পশ্চিম আফ্রিকার মতো। সেনেগাল, লাইবেরিয়া, ঘানা, টোগো, মালি-সব দেশের মানুষ এখানে আছে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, মামদানি কি সীমিত ক্ষমতার মেয়র পদে থেকে রাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ে জোট গড়ে তার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন? তবুও তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের নতুন ধারণা দরকার। তাই আমি তাকে সমর্থন করি।’
একই মত পোষণ করেন সিয়েরা লিওনের ৫৫ বছর বয়সী ক্যাব চালক আহমেদ জেজো। তিনি বলেন, ‘আমরা এরিক অ্যাডামসকে দেখেছি, কুওমোকেও দেখেছি। মামদানি নতুন শুরু করছেন, আর আমি এটা ধর্মের কারণে নয়, বরং তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমর্থন করি।’
মরিয়ম সালেহ, কুমাসি রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাদের জন্য তার মুসলিম হওয়াটা বিশাল অগ্রগতি। এটি কেবল নিউইয়র্ক নয়, পুরো আমেরিকার মুসলিমদের জন্যও এক বড় পদক্ষেপ।’
ব্রাইটন বিচ, ব্রুকলীন : ‘বর্তমান ব্যবস্থাটি কাজ করছে না’
নগর ইতিহাসবিদ আসাদ ডান্ডিয়া বলেন, ‘এটি নিউইয়র্কের চার শতাব্দীর মুসলিম ইতিহাসের চূড়ান্ত পরিণতি। প্রথম দিকের মুসলিমরা ছিলেন দাসত্ববন্দী আফ্রিকান।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর নিউইয়র্কে অন্তত ২৫০টি মসজিদে নজরদারি চালিয়েছিল এনওয়াইপিডি। সেই সময় ডান্ডিয়াও ছিলেন লক্ষ্যবস্তু। ২০১৩ সালে তিনি তথ্যদাতাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সফল মামলা করেছিলেন।
তার ভাষায়, ‘আমাদের কেউ কেউ ভুলে গেছি, সেই সময়টা কতটা ভয়াবহ ছিল। কিন্তু এখন যে সম্প্রদায় একসময় নজরদারির শিকার ছিল, তারাই আজ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ভাবুন, যে পুলিশ বিভাগ একসময় আমাদের ওপর নজরদারি করত, তারা এখন মামদানির অধীনে কাজ করবে।’
ব্রাইটন বিচে মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। উজবেক, পাকিস্তানী ও মধ্য এশীয় মুসলিমরা এখানে ঘনবসতিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলেছেন। শুক্রবারে কখনও কখনও নামাজের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের নির্বাচনে এখানকার অনেকে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু এ বছরের প্রাইমারিতে মামদানিকেই সমর্থন করেছেন।
কমিউনিটি সেন্টারের প্রধান ইরুম হানিফ বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থাটি কাজ করছে না। উবার ড্রাইভার, মুদি দোকান কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী-সবাই দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তাই তারা মামদানির দিকে ঝুঁঁকছে।’
লাহোরের বাসিন্দা আমিনা মালিক বলেন, ‘আমাদের মতো বয়স্করা ভাড়ার চাপে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। পরিবারগুলো শিশু যত্নের খরচ দিতে পারছে না। মামদানি এসব বুঝেন।’
৬৬ বছর বয়সী পারভীন জিয়া বলেন, ‘জোহরান আমাদের মতোই একজন। তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন, সংস্কৃতি বোঝেন, আর নিশ্চিত করবেন যে সেবা ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ হয়।’
সাউথ রিচমন্ড হিল, কুইন্স : ‘মানুষ মনে করে পরিবর্তনের সময় এসেছে’
প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে কুইন্সের সাউথ রিচমন্ড হিল এলাকায় মসজিদ আল আবিদিনের মিনারগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় ‘লিটল গায়ানা’, যেখানে ইন্দো-ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ স্পষ্ট।
এখানকার শিশু যত্নকর্মী অ্যানি নাজির বলেন, ‘এই পাড়ায় সবাই আত্মীয়ের মতো। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে আমরা এখন পরিবর্তন চাই।’
২০১২ সালে শুরু হওয়া মসজিদটির নির্মাণকাজ কোভিডের আর্থিক ক্ষতির কারণে বন্ধ হয়ে আছে। ধর্মপ্রাণরা এখন পাশের টাউনহাউসে নামাজ পড়েন।
নাজির বলেন, তিনি ড্রাম বিটস নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যারা দক্ষিণ এশীয় ও ইন্দো-ক্যারিবিয়ান শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং মামদানিকে সমর্থন করছে।
জুনের প্রাইমারিতে জয়ের পর থেকে মামদানি জরিপে এগিয়ে থাকলেও সেপ্টেম্বরে মেয়র এরিক অ্যাডামস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ব্যবধান কমেছে।
এদিকে প্রাক্তন গভর্নর কুওমো মুসলিম সম্প্রদায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। প্রাইমারিতে হেরে যাওয়ার পর তিনি চারটি মসজিদে যান, যদিও বিতর্কের সময় নিজের আমলে কোনো মসজিদ পরিদর্শনের স্মৃতি উল্লেখ করতে পারেননি।
কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের ইমাম কাজী কাইয়ুম কুওমোকে সমর্থন করেছেন। তবে মামদানি বিতর্কে বলেন, ‘আমাকেই শহরের সেই অংশগুলো দেখাতে হয়েছে, যেখানে তারা কখনও যায়নি।’
গায়ানিজ সম্প্রদায়ের কিছু লোকের মধ্যে এই আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যারা উল্লেখ করেছেন যে মামদানি মে মাসে প্রাথমিক নির্বাচনের আগে মসজিদ আল আবিদিন পরিদর্শন করেছিলেন। সম্প্রদায়ের সাথে অন্যান্য সম্পর্ক নির্বাচনের আগে থেকেই রয়েছে। একজন অ্যাসেম্বলি সদস্য হিসেবে, মামদানি প্রকাশ চুরামনের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, একজন গায়ানিজ অভিবাসী যিনি দাবি করেছেন যে তাকে মিথ্যা খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি ২০২১ সালে ১৫ দিনের অনশন ধর্মঘটে ট্যাক্সি শ্রমিকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।
মসজিদে সন্ধ্যার নামাজের পর আল জাজিরার সাথে কথা বলার সময় ক্লিন্ট অ্যালি বলেন, তিনি আশা করেন মামদানির সম্প্রদায়-ভিত্তিক স্টাইল, যার মধ্যে ছোট দাতাদের জন্য কর্পোরেট অনুদান পরিহার করা অন্তর্ভুক্তি ছিল অনুরণিত হবে। ‘ইতিহাসে তিনি প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে খ্যাত হতে পারেন, কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় শহর,’ ৪৯ বছর বয়সী এই মেয়র বলেন। ‘আমাদের এমন একজনের প্রয়োজন যে সবাইকে বোঝে।’
বে রিজ, ব্রুকলিন : ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী…অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে’
ব্রুকলীনের বে রিজের ফিফথ অ্যাভিনিউতে তার অফিসে বসে, ৭১ বছর বয়সী জেইন রিমাউই যখন ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার একটি ভিডিও দেখছেন, তখন তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনি অধিকারের প্রতি মামদানির স্পষ্ট সমর্থন এবং গাজায় গণহত্যার নিন্দা স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষভাবে অনুরণিত হয়েছে, যাকে ‘লিটল প্যালেস্টাইন’ বলা হয়, যেখানে ক্যাফেগুলির নাম ‘আল আকসা বেকারি’ এবং ‘নাবলুস সুইটস’।
রিমাউই বলেন যে, তিনি মামদানিকে প্রায় আট বছর ধরে চেনেন, যখন তিনি ২০ বছর বয়সী ছিলেন, তখন থেকে তিনি ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লুথেরান যাজক খাদের এল-ইয়াতিমের সমর্থনে একটি প্রচারণায় কাজ করছিলেন, যিনি ২০১৭ সালে নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের জন্য ব্যর্থ দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। ‘আমি সবসময় তরুণদের বলি- যেকোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো। যদি তোমরা জিতো, আমরা জিতবো,’ তিনি বলেন। ‘যদি তোমরা হেরে যাও, আমরা জিতবো। কারণ একজন মুসলিমের পক্ষে একা কোনও আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সহজ নয়, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ, তাই এটি উভয়ের জন্যই লাভজনক পরিস্থিতি।’
কিন্তু রিমাউই মামদানির সাফল্যকেও দেখেছেন, অন্তত এখন পর্যন্ত শহরের ক্রমবর্ধমান সম্পদের বৈষম্যের ফসল হিসেবে, যা বিশেষ করে বে রিজের মতো একটি এলাকায় প্রাসঙ্গিক, একসময় শ্রমিক শ্রেণীর শক্ত ঘাঁটি ছিল যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আবাসনের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে।
তিনি বলেণ, ‘১৯৮৮ সালে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন এক সপ্তাহের বেতন দিয়ে গড় ভাড়া মেটানো হত। এখন এটি আপনার এক মাসের বেতনের বেশিরভাগই খরচ করে। নিউ ইয়র্কে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে শীঘ্রই আমাদের কেবল দুটি শ্রেণী থাকবে: ধনী এবং দরিদ্র।’
পাশের বাড়ির, ৪৬ বছর বয়সী এসা মাসুদ, বালাডি মার্কেট চালান, লেভান্ট জুড়ে পণ্য বিক্রি করেন। বে রিজে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা এই ফিলিস্তিনি আমেরিকান, জুনে মামদানির জয়ের পর অতি ডানপন্থিদের ইসলামোফোবিক ট্রপগুলিকে ঠেলে দেওয়া দেখে অবাক হননি। ট্রাম্প মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। কুওমো তাকে ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে অভিহিত করেছেন।
মাসুদ এই আক্রমণগুলিকে সাবধানে ক্যালিব্রেটেড ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটি সাধারণ জনগণের ধারণা পরিবর্তনের একটি প্রচেষ্টা, যাতে মানুষ ভয় পায় যে তাকেই ভোট দেওয়া উচিত নয়।’ মাসুদ আরো বলেন, একজন ব্যবসায়ী এবং বাড়িওয়ালা হিসেবে, মামদানির নীতিমালা সম্পর্কে তার আপত্তি আছে, যার মধ্যে রয়েছে ভাড়া স্থগিতকরণ এবং শহরে ঘণ্টায় ৩০ ডলার ন্যূনতম মজুরির প্রতি তার সমর্থন। তিনি মামদানির দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেন না, তবে আশা করেন যে তিনি নির্বাচিত হলে ভারসাম্য থাকবে।
আরব-আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মারওয়া জানিনি বলেন, ‘গত দুই বছর আমাদের জন্য ছিল বেদনা ও গর্বের। গাজায় হত্যাযজ্ঞের জন্য বেদনা, আর মামদানির উত্থানের জন্য গর্ব।’
তিনি বলেন, ‘মুসলিম নিউ ইয়র্কবাসী হিসেবে আমাদের পরিচয় স্থির নয়; এটি পরিবর্তনশীল। কিন্তু ৯/১১-পরবর্তী ভয়ের প্রেক্ষাপটে এটি বিশাল এক মুহূর্ত।’
নিউইয়র্কের মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থান এখন পরিষ্কার। তারা ধর্ম নয়, জীবিকার প্রশ্নে ভোট দিচ্ছেন। ভাড়া, পরিবহন, শিশু যত্ন, আয় বৈষম্য ও নিরাপত্তা-এই বাস্তব বিষয়গুলোই তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। ব্রঙ্কসের দোকানদার আইচা ডনজার এক কথায় যেন গোটা বাস্তবতা ধরা পড়েছে- ‘ধর্ম নয়, ভাড়াই এখন বড় বিষয়।’ এবং সেই কথাই আজ নিউইয়র্কের বহুজাতিক মুসলিম সমাজের নতুন রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সূত্র : আল জাজিরা।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

নিউইয়র্কের আসন্ন মেয়র নির্বাচন ঘিরে মুসলিম শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের আশা ও বাস্তবতা

ব্রঙ্কস থেকে ব্রুকলীন : ধর্ম নয় ভাড়াই এখন বড় আলোচনা

প্রকাশের সময় : ০১:৪৯:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

হককথা ডেস্ক: যুক্তরষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। আগামী নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে শহরের শ্রমিক শ্রেণীর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আলোচনা ও উদ্বেগ, তা চিরাচরিত ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে এখন সাশ্রয়ী জীবনযাপন ও ভাড়া নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদার দিকে মোড় নিয়েছে। নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভোটাররা কীভাবে পরিস্থিতি দেখছেন, তা জানতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন শ্রমিক শ্রেণীর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পরিদর্শন করেছে।
মরিসানিয়া, ব্রঙ্কস : মামদানির বার্তা সহজ জীবনযাত্রার
ব্রঙ্কসের মরিসানিয়া পাড়ায় কান পাতলেই প্রায়শই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়- ‘মামদানি, মামদানি, মামদানি’। এই এলাকাটি দ্রুত বর্ধনশীল পশ্চিম আফ্রিকান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল- যাদের মধ্যে অনেক নতুন মুসলিম অভিবাসীও রয়েছেন। এই মরিসানিয়া তেমনই এক অঞ্চল যেখানে আগামী ৪ নভেম্বরের নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের আগে জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্নটি শ্রমিক শ্রেণীর চাহিদার সাথে একীভূত হয়ে গেছে।
এই সম্প্রদায়ের অনেকেই ৩৪ বছর বয়সী মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানির জয়ের উপর গভীর আস্থা রাখছেন। কারণ, প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর বিরুদ্ধে মামদানির এই জয় নিউইয়র্ক সিটির জন্য এক ঐতিহাসিক প্রথম সাফল্যের সিরিজ হিসেবে চিহ্নিত হবে- এটি শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র, আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরটির নেতৃত্বদানকারী প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির আগমনকে সূচিত করবে। এই বাস্তবতা শহরের কাঠামোর সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়া এবং বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষের ভয়াবহ স্মৃতিও জাগিয়ে তুলেছে।
কিন্তু মরিসানিয়ার একজন দোকান মালিক আইচা ডনজার জন্য, যেখানে বার্ষিক গড় আয় শহরের গড়ের প্রায় অর্ধেক, এটি কোনও ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্ন নয়। স্বীকৃত ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট এই প্রার্থীর সাশ্রয়ী মূল্যের বার্তা, বিনামূল্যের বাসের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি, নির্দিষ্ট ভবনের ভাড়া স্থগিতকরণ এবং সর্বজনীন শিশু যত্ন, যা আংশিকভাবে ধনীদের উপর কর বৃদ্ধি করে পরিশোধ করা হবে, তার সমর্থন অর্জন করেছে।
ডনজা আল জাজিরাকে বলেন, ‘তিনি (মারদানি) বলছেন, তিনি জিনিসগুলি আরো সহজ করে দেবেন।’ ডনজা তার দোকানে রাখা ঘানা থেকে আনা কলা গুঁড়ো; তার জন্মস্থান লাইবেরিয়া থেকে আমদানি করা পাম তেল; তুরস্ক, মিশর এবং সউদী আরব থেকে আমদানি করা ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক পোশাক দেখিয়ে আরো বলেন, এখানাকার ভাড়া এত বেশি যে প্রতিদিন লোকেরা দোকানে আসে, তারা বলে দাম অনেক বেশি। আর বিনামূল্যের বাস, যদি সে তা পরিচালনা করতে পারে, তাহলে তা অনেক বড় পার্থক্য আনবে।
পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা : নতুন প্রজন্মের নতুন ধারণা
ব্রঙ্কসের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের বাইরে নামাজ শেষে ৬০ বছর বয়সী গাম্বিয়ান বংশোদ্ভূত এসা টুনকালা বলেন, ‘এটা প্রায় পশ্চিম আফ্রিকার মতো। সেনেগাল, লাইবেরিয়া, ঘানা, টোগো, মালি-সব দেশের মানুষ এখানে আছে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, মামদানি কি সীমিত ক্ষমতার মেয়র পদে থেকে রাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ে জোট গড়ে তার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন? তবুও তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের নতুন ধারণা দরকার। তাই আমি তাকে সমর্থন করি।’
একই মত পোষণ করেন সিয়েরা লিওনের ৫৫ বছর বয়সী ক্যাব চালক আহমেদ জেজো। তিনি বলেন, ‘আমরা এরিক অ্যাডামসকে দেখেছি, কুওমোকেও দেখেছি। মামদানি নতুন শুরু করছেন, আর আমি এটা ধর্মের কারণে নয়, বরং তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমর্থন করি।’
মরিয়ম সালেহ, কুমাসি রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাদের জন্য তার মুসলিম হওয়াটা বিশাল অগ্রগতি। এটি কেবল নিউইয়র্ক নয়, পুরো আমেরিকার মুসলিমদের জন্যও এক বড় পদক্ষেপ।’
ব্রাইটন বিচ, ব্রুকলীন : ‘বর্তমান ব্যবস্থাটি কাজ করছে না’
নগর ইতিহাসবিদ আসাদ ডান্ডিয়া বলেন, ‘এটি নিউইয়র্কের চার শতাব্দীর মুসলিম ইতিহাসের চূড়ান্ত পরিণতি। প্রথম দিকের মুসলিমরা ছিলেন দাসত্ববন্দী আফ্রিকান।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর নিউইয়র্কে অন্তত ২৫০টি মসজিদে নজরদারি চালিয়েছিল এনওয়াইপিডি। সেই সময় ডান্ডিয়াও ছিলেন লক্ষ্যবস্তু। ২০১৩ সালে তিনি তথ্যদাতাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সফল মামলা করেছিলেন।
তার ভাষায়, ‘আমাদের কেউ কেউ ভুলে গেছি, সেই সময়টা কতটা ভয়াবহ ছিল। কিন্তু এখন যে সম্প্রদায় একসময় নজরদারির শিকার ছিল, তারাই আজ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ভাবুন, যে পুলিশ বিভাগ একসময় আমাদের ওপর নজরদারি করত, তারা এখন মামদানির অধীনে কাজ করবে।’
ব্রাইটন বিচে মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। উজবেক, পাকিস্তানী ও মধ্য এশীয় মুসলিমরা এখানে ঘনবসতিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলেছেন। শুক্রবারে কখনও কখনও নামাজের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের নির্বাচনে এখানকার অনেকে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু এ বছরের প্রাইমারিতে মামদানিকেই সমর্থন করেছেন।
কমিউনিটি সেন্টারের প্রধান ইরুম হানিফ বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থাটি কাজ করছে না। উবার ড্রাইভার, মুদি দোকান কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী-সবাই দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তাই তারা মামদানির দিকে ঝুঁঁকছে।’
লাহোরের বাসিন্দা আমিনা মালিক বলেন, ‘আমাদের মতো বয়স্করা ভাড়ার চাপে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। পরিবারগুলো শিশু যত্নের খরচ দিতে পারছে না। মামদানি এসব বুঝেন।’
৬৬ বছর বয়সী পারভীন জিয়া বলেন, ‘জোহরান আমাদের মতোই একজন। তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন, সংস্কৃতি বোঝেন, আর নিশ্চিত করবেন যে সেবা ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ হয়।’
সাউথ রিচমন্ড হিল, কুইন্স : ‘মানুষ মনে করে পরিবর্তনের সময় এসেছে’
প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে কুইন্সের সাউথ রিচমন্ড হিল এলাকায় মসজিদ আল আবিদিনের মিনারগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় ‘লিটল গায়ানা’, যেখানে ইন্দো-ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ স্পষ্ট।
এখানকার শিশু যত্নকর্মী অ্যানি নাজির বলেন, ‘এই পাড়ায় সবাই আত্মীয়ের মতো। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে আমরা এখন পরিবর্তন চাই।’
২০১২ সালে শুরু হওয়া মসজিদটির নির্মাণকাজ কোভিডের আর্থিক ক্ষতির কারণে বন্ধ হয়ে আছে। ধর্মপ্রাণরা এখন পাশের টাউনহাউসে নামাজ পড়েন।
নাজির বলেন, তিনি ড্রাম বিটস নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যারা দক্ষিণ এশীয় ও ইন্দো-ক্যারিবিয়ান শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং মামদানিকে সমর্থন করছে।
জুনের প্রাইমারিতে জয়ের পর থেকে মামদানি জরিপে এগিয়ে থাকলেও সেপ্টেম্বরে মেয়র এরিক অ্যাডামস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ব্যবধান কমেছে।
এদিকে প্রাক্তন গভর্নর কুওমো মুসলিম সম্প্রদায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। প্রাইমারিতে হেরে যাওয়ার পর তিনি চারটি মসজিদে যান, যদিও বিতর্কের সময় নিজের আমলে কোনো মসজিদ পরিদর্শনের স্মৃতি উল্লেখ করতে পারেননি।
কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের ইমাম কাজী কাইয়ুম কুওমোকে সমর্থন করেছেন। তবে মামদানি বিতর্কে বলেন, ‘আমাকেই শহরের সেই অংশগুলো দেখাতে হয়েছে, যেখানে তারা কখনও যায়নি।’
গায়ানিজ সম্প্রদায়ের কিছু লোকের মধ্যে এই আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যারা উল্লেখ করেছেন যে মামদানি মে মাসে প্রাথমিক নির্বাচনের আগে মসজিদ আল আবিদিন পরিদর্শন করেছিলেন। সম্প্রদায়ের সাথে অন্যান্য সম্পর্ক নির্বাচনের আগে থেকেই রয়েছে। একজন অ্যাসেম্বলি সদস্য হিসেবে, মামদানি প্রকাশ চুরামনের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, একজন গায়ানিজ অভিবাসী যিনি দাবি করেছেন যে তাকে মিথ্যা খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি ২০২১ সালে ১৫ দিনের অনশন ধর্মঘটে ট্যাক্সি শ্রমিকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।
মসজিদে সন্ধ্যার নামাজের পর আল জাজিরার সাথে কথা বলার সময় ক্লিন্ট অ্যালি বলেন, তিনি আশা করেন মামদানির সম্প্রদায়-ভিত্তিক স্টাইল, যার মধ্যে ছোট দাতাদের জন্য কর্পোরেট অনুদান পরিহার করা অন্তর্ভুক্তি ছিল অনুরণিত হবে। ‘ইতিহাসে তিনি প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে খ্যাত হতে পারেন, কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় শহর,’ ৪৯ বছর বয়সী এই মেয়র বলেন। ‘আমাদের এমন একজনের প্রয়োজন যে সবাইকে বোঝে।’
বে রিজ, ব্রুকলিন : ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী…অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে’
ব্রুকলীনের বে রিজের ফিফথ অ্যাভিনিউতে তার অফিসে বসে, ৭১ বছর বয়সী জেইন রিমাউই যখন ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার একটি ভিডিও দেখছেন, তখন তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনি অধিকারের প্রতি মামদানির স্পষ্ট সমর্থন এবং গাজায় গণহত্যার নিন্দা স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষভাবে অনুরণিত হয়েছে, যাকে ‘লিটল প্যালেস্টাইন’ বলা হয়, যেখানে ক্যাফেগুলির নাম ‘আল আকসা বেকারি’ এবং ‘নাবলুস সুইটস’।
রিমাউই বলেন যে, তিনি মামদানিকে প্রায় আট বছর ধরে চেনেন, যখন তিনি ২০ বছর বয়সী ছিলেন, তখন থেকে তিনি ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লুথেরান যাজক খাদের এল-ইয়াতিমের সমর্থনে একটি প্রচারণায় কাজ করছিলেন, যিনি ২০১৭ সালে নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের জন্য ব্যর্থ দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। ‘আমি সবসময় তরুণদের বলি- যেকোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো। যদি তোমরা জিতো, আমরা জিতবো,’ তিনি বলেন। ‘যদি তোমরা হেরে যাও, আমরা জিতবো। কারণ একজন মুসলিমের পক্ষে একা কোনও আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সহজ নয়, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ, তাই এটি উভয়ের জন্যই লাভজনক পরিস্থিতি।’
কিন্তু রিমাউই মামদানির সাফল্যকেও দেখেছেন, অন্তত এখন পর্যন্ত শহরের ক্রমবর্ধমান সম্পদের বৈষম্যের ফসল হিসেবে, যা বিশেষ করে বে রিজের মতো একটি এলাকায় প্রাসঙ্গিক, একসময় শ্রমিক শ্রেণীর শক্ত ঘাঁটি ছিল যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আবাসনের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে।
তিনি বলেণ, ‘১৯৮৮ সালে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন এক সপ্তাহের বেতন দিয়ে গড় ভাড়া মেটানো হত। এখন এটি আপনার এক মাসের বেতনের বেশিরভাগই খরচ করে। নিউ ইয়র্কে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে শীঘ্রই আমাদের কেবল দুটি শ্রেণী থাকবে: ধনী এবং দরিদ্র।’
পাশের বাড়ির, ৪৬ বছর বয়সী এসা মাসুদ, বালাডি মার্কেট চালান, লেভান্ট জুড়ে পণ্য বিক্রি করেন। বে রিজে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা এই ফিলিস্তিনি আমেরিকান, জুনে মামদানির জয়ের পর অতি ডানপন্থিদের ইসলামোফোবিক ট্রপগুলিকে ঠেলে দেওয়া দেখে অবাক হননি। ট্রাম্প মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। কুওমো তাকে ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে অভিহিত করেছেন।
মাসুদ এই আক্রমণগুলিকে সাবধানে ক্যালিব্রেটেড ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটি সাধারণ জনগণের ধারণা পরিবর্তনের একটি প্রচেষ্টা, যাতে মানুষ ভয় পায় যে তাকেই ভোট দেওয়া উচিত নয়।’ মাসুদ আরো বলেন, একজন ব্যবসায়ী এবং বাড়িওয়ালা হিসেবে, মামদানির নীতিমালা সম্পর্কে তার আপত্তি আছে, যার মধ্যে রয়েছে ভাড়া স্থগিতকরণ এবং শহরে ঘণ্টায় ৩০ ডলার ন্যূনতম মজুরির প্রতি তার সমর্থন। তিনি মামদানির দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেন না, তবে আশা করেন যে তিনি নির্বাচিত হলে ভারসাম্য থাকবে।
আরব-আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মারওয়া জানিনি বলেন, ‘গত দুই বছর আমাদের জন্য ছিল বেদনা ও গর্বের। গাজায় হত্যাযজ্ঞের জন্য বেদনা, আর মামদানির উত্থানের জন্য গর্ব।’
তিনি বলেন, ‘মুসলিম নিউ ইয়র্কবাসী হিসেবে আমাদের পরিচয় স্থির নয়; এটি পরিবর্তনশীল। কিন্তু ৯/১১-পরবর্তী ভয়ের প্রেক্ষাপটে এটি বিশাল এক মুহূর্ত।’
নিউইয়র্কের মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থান এখন পরিষ্কার। তারা ধর্ম নয়, জীবিকার প্রশ্নে ভোট দিচ্ছেন। ভাড়া, পরিবহন, শিশু যত্ন, আয় বৈষম্য ও নিরাপত্তা-এই বাস্তব বিষয়গুলোই তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। ব্রঙ্কসের দোকানদার আইচা ডনজার এক কথায় যেন গোটা বাস্তবতা ধরা পড়েছে- ‘ধর্ম নয়, ভাড়াই এখন বড় বিষয়।’ এবং সেই কথাই আজ নিউইয়র্কের বহুজাতিক মুসলিম সমাজের নতুন রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সূত্র : আল জাজিরা।