নিউইয়র্ক ০৫:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বঙ্গবন্ধু এবং শেখ মুজিব

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:১৮:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৮ বার পঠিত

সাঈদ তারেক: ডেনমার্কের রাজকুমারকে বাদ দিয়ে যেমন ‘হ্যামলেট’ হয় না তেমনি শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিব- এক থেকে আর এককে আলাদা করা যায় না। স্বাধীনতার কথা বললে শেখ মুজিবের কথা আসবেই।
স্বাধীনতার স্বপ্ন অনেকেই দেখে থাকতে পারেন। কে কার আগে দেখেছেন এ নিয়েও বাহাস আছে। কিন্তু মুখ্যত বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন সেই ’৪৭ থেকেই। তখনকার মুসলিম লীগ এবং তফশীল জাতি ফেডারেশনের নেতারা যুক্ত বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার বিরোধীতায় তা হয় নাই। বরঞ্চ এরা ধর্মের ভিত্তিতে সেদিন বাংলাকে ভাগ করেছেন। তারই এক ভাগ হয় পূর্ব পাকিস্তান। কাজেই সে সময়কার নেতাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখে থাকতেই পারেন।
কিন্তু এই পথে কার্যকর উদ্যোগটি নিয়েছিলেন শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবই ছয় দফা ঘোষনা করে বাঙালীর হৃদয়ে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বপন করেন। জেল জুলুম মামলা হামলায় জর্জড়িত হয়ে বিশেষ করে আগরতলা য়ড়যন্ত্র মামলায় বিচারের সম্মুখিন হয়ে স্বাধীনতার যৌক্তিকতা প্রমান করেন। ’৭০এর নির্বাচনে জয়লাভ করে স্বাধীনতার ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই ইতিহাস। এখানে একক নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
বিতর্কের জায়গাটা তৈরী হয় এর পরের অধ্যায়ে। প্রশ্ন আছে, গোটা জাতিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরী করে সাতই মার্চ কেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা করলেন না। কেন ২৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ইয়াহিয়া খানের সাথে দেন-দরবার করলেন। কেন ২৫ মার্চ রাতে সবার সাথে না পালিয়ে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন বা আত্ম সমর্পন করলেন। প্রশ্নগুলোর নানা ব্যখ্যা আছে। আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকেও কারন বলা হয়েছে। তবে নানা তথ্যসূত্রে যতটুকু জানা যায় স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ মুজিব ছিলেন দোদুল্যমান। মূলত: স্বাধীনতার প্রেক্ষিতটা গড়ে তুলেছিল তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সিরাজুল আলম খানের হাতে। মূলত: স্বাধীনতার জন্য অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছিল ছাত্ররা। মৃুজিব এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছিলেন ইয়াহিয়ার সাথে দর কষাকষির একটা হাতিয়ার হিসাবে। তা ব্যর্থ হলে ২৫শে মার্চ রাতে তিনি ইয়াহিয়া সরকারের হেফাজতে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় বা নিরাপদ মনে করেছিলেন।
তারপরও, তাকে নেতা মেনেই গোটা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তিনিই ছিলেন প্রেরণার উৎস। প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি। হানাদার বাহিনীর কাছে তার আত্মসমর্পনকে দেখা হয়েছে কৌশল হিসাবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে বিজয় এলে এবং দেশ স্বাধীন হলে তাকে বসানো হয় অবিসংবাদিত নেতার আসনে। ভুট্টোর বদান্যতায় তিনি দ্রæত দেশে ফিরে আসেন।
এ পর্যন্ত শেখ মুজিব বাংলার একজন বন্ধু। ছাত্ররা তাকে বাংলার বন্ধু বা বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী দেশে ফেরার কিছুদিন পর পর্যন্ত তিনি আপামর মানুষের ভালবাসা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। মানুষ তাকে প্রকৃতই বঙ্গবন্ধু মনে করতো।
এ সময় তাকে ‘জাতির পিতা’র আসনে বসানো হয়। কিন্তু ‘জাতির পিতা’ হয়ে তিনি একটা নির্দিষ্ট দলের সাথে সম্পৃক্ত রইলেন। দলীয় সরকার গঠন করলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে সড়িয়ে সে পদটি দখল করলেন। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। রক্ষীবাহিনীসহ নানা দলীয় বাহিনী তৈরী করে অল্প দিনের মধ্যে সারা দেশে বিভীষিকার অবস্থা তৈরী করলেন। যে ছাত্ররা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিল তারা তা কেড়ে নিলো। তার শাসনকালে বিরোধী দলগুলোর অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত হলো। ফলে তিনি আর বঙ্গবন্ধু থাকলেন না। ‘জাতির পিতা’ বিষয়টা গোড়া থেকেই বিতর্কিত ছিল। তার নেতৃত্বে বা উছিলায় বাংলাদেশ নামে একটা নতুন দেশ তৈরী হলো অথচ অতিউৎসাহি চাটুকারেরা তাকে হাজার বছরের পুরনো বাঙালী ‘জাতির পিতা’ বানিয়ে দিলো। বাংলাদেশ ভুখন্ডে বসবাসকারি সকল অধিবাসীকে নিয়ে নতুনভাবে গঠিত বাংলাদেশী জাতিসত্বার বা ‘বাংলাদেশী জাতির পিতা’ বানালেও কথা ছিল। কিন্তু বেকুবেরা বাংলাদেশী জাতিসত্বা বলে কিছু স্বীকারই করে না।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের দুইটা অধ্যায়। এক. স্বাধীনতার পূর্বকালের, দুই. স্বাধীনতার পরের কালের। স্বাধীনতাপুর্বকালে তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা। স্বাধীনতার পরের কালে তিনি একজন শাষক মুজিব। সন্ত্রাস সহিংসতা দূর্নীতি লুটপাট দুর্ভিক্ষ অপশাষন দু:শাসন সর্বোপরি এক দলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গনতন্ত্রের কবর দিয়ে একটা স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য সর্বোতভাবে একজন ব্যর্থ শাসক। কাজেই শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল্যায়ন করতে হলে দুটি অধ্যায়কে বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে। স্বাধীনতা পূর্বকালের বঙ্গবন্ধু বলেই যেমন তার স্বৈর শাসন বৈধ হয়ে যায় না তেমনি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই তার স্বাধীনতার জন্য ভুমিকা বা অবদান মুছে যায় না। যারা শেখ মুজিবের রাজনীতির শুধুমাত্র একটামাত্র দিক বিবেচনায় নিয়ে তার সার্বিক মূল্যায়ন করেন তারা হয় দলকানা অথবা মতলববাজ।
আওয়ামী লীগের কাছে তিনি সকল ভুলের উর্দ্ধে একজন মহামানব। বিরোধীদের কাছে জাতির ভিলেন বা একজন খানে দজ্জাল। আওয়ামী লীগের কাছে তার স্বাধীনতা পরবর্তী ভুমিকার জন্য কোন অনুশোচনা নেই, বিরোধীদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনে তার নেতৃত্বের কোন মূল্য নেই। উভয় মূল্যায়নই সত্যের অপলাপ, পক্ষপাতদুষ্ট। আওয়ামী লীগের ব্যপারটা বোধগম্য, কারন মুজিব ছিলেন তাদের নেতা। স্বাধীনতার পর থেকে দলটা তাকে দলীয় নেতা বানিয়েই রেখেছে, জাতির নেতার অবস্থানটা ধরে রাখতে দেয়নি। পক্ষান্তরে যারা স্বাধীনতা অর্জনে শেখ মুজিবের সকল অবদান এবং ভুমিকা অস্বীকার করে তাকে একজন ভিলেন বানাতে চায় এরা মূলত: ’৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। এরা ছিল এক পাকিস্তানের পক্ষে। পাকিস্তান ভাঙার জন্য তারা এককভাবে শেখ মুজিবকে দায়ী করে (অথচ বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান ভাঙার জন্য যদি কোন মামলা হয় তার এক নম্বর আসামী হবেন সিরাজুল আলম খান)। ৫৪ বছর ধরে শেখ মুজিবের বিরদ্ধে এই মহলের যে আক্রমন তা এই রাগ এবং ক্ষোভ থেকে। নতুন প্রজন্মের অনেককে বিশেষ করে জেন জি’র একটা অংশকে দেখা যায় শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সাথে শেখ মুজিবকে মিলিয়ে ফেলে। অথচ এরা শেখ মুজিবকে দেখেনি, তার সম্পর্কে জানেও না। এদের মধ্যে যারা হালে রাজনীতিতে যুক্ত- অনেকেই মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উঠে এসেছে। এদের মন মানসিকতা গড়ে উঠেছে ওস্তাদদের কাছ থেকে নিয়ত: ‘পাকিস্তান ছিল মুসলমানদের দেশ, এটা ভাঙা অন্যায় হয়েছে’ ‘৭১এ বাংলাদেশ বানানো ঠিক হয়নি’ ইত্যাকার সবক শিখতে শিখতে। ফলে এদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা এবং শেখ মুজিব একজন জাতীয় ভিলেন।
শেখ মুজিব চলে গেছেন সেই পচাত্তুর সালে। তার অন্যায় অপকর্ম বা সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা দু:শাসনের দায় চুকিয়ে গেছেন সপরিবারে প্রাণ দিয়ে। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈর শাষনের সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই, তারপরও ৩২ নম্বরে তার বাড়ী বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ’৭১এর পরাজয়ের আক্রোশ থেকে। টুঙ্গীপাড়ায় গিয়ে তার কবর তুলে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয় পাকিস্থান ভেঙে যাওয়ার ক্ষোভ থেকে। ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় ভয় থেকে- যদি মুজিব উঠে আসেন! যদি আর একবার স্বাধীনতার ডাক দেন!

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বঙ্গবন্ধু এবং শেখ মুজিব

প্রকাশের সময় : ০১:১৮:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫

সাঈদ তারেক: ডেনমার্কের রাজকুমারকে বাদ দিয়ে যেমন ‘হ্যামলেট’ হয় না তেমনি শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিব- এক থেকে আর এককে আলাদা করা যায় না। স্বাধীনতার কথা বললে শেখ মুজিবের কথা আসবেই।
স্বাধীনতার স্বপ্ন অনেকেই দেখে থাকতে পারেন। কে কার আগে দেখেছেন এ নিয়েও বাহাস আছে। কিন্তু মুখ্যত বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন সেই ’৪৭ থেকেই। তখনকার মুসলিম লীগ এবং তফশীল জাতি ফেডারেশনের নেতারা যুক্ত বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার বিরোধীতায় তা হয় নাই। বরঞ্চ এরা ধর্মের ভিত্তিতে সেদিন বাংলাকে ভাগ করেছেন। তারই এক ভাগ হয় পূর্ব পাকিস্তান। কাজেই সে সময়কার নেতাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখে থাকতেই পারেন।
কিন্তু এই পথে কার্যকর উদ্যোগটি নিয়েছিলেন শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবই ছয় দফা ঘোষনা করে বাঙালীর হৃদয়ে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বপন করেন। জেল জুলুম মামলা হামলায় জর্জড়িত হয়ে বিশেষ করে আগরতলা য়ড়যন্ত্র মামলায় বিচারের সম্মুখিন হয়ে স্বাধীনতার যৌক্তিকতা প্রমান করেন। ’৭০এর নির্বাচনে জয়লাভ করে স্বাধীনতার ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই ইতিহাস। এখানে একক নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
বিতর্কের জায়গাটা তৈরী হয় এর পরের অধ্যায়ে। প্রশ্ন আছে, গোটা জাতিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরী করে সাতই মার্চ কেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা করলেন না। কেন ২৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ইয়াহিয়া খানের সাথে দেন-দরবার করলেন। কেন ২৫ মার্চ রাতে সবার সাথে না পালিয়ে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন বা আত্ম সমর্পন করলেন। প্রশ্নগুলোর নানা ব্যখ্যা আছে। আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকেও কারন বলা হয়েছে। তবে নানা তথ্যসূত্রে যতটুকু জানা যায় স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ মুজিব ছিলেন দোদুল্যমান। মূলত: স্বাধীনতার প্রেক্ষিতটা গড়ে তুলেছিল তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সিরাজুল আলম খানের হাতে। মূলত: স্বাধীনতার জন্য অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছিল ছাত্ররা। মৃুজিব এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছিলেন ইয়াহিয়ার সাথে দর কষাকষির একটা হাতিয়ার হিসাবে। তা ব্যর্থ হলে ২৫শে মার্চ রাতে তিনি ইয়াহিয়া সরকারের হেফাজতে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় বা নিরাপদ মনে করেছিলেন।
তারপরও, তাকে নেতা মেনেই গোটা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তিনিই ছিলেন প্রেরণার উৎস। প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি। হানাদার বাহিনীর কাছে তার আত্মসমর্পনকে দেখা হয়েছে কৌশল হিসাবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে বিজয় এলে এবং দেশ স্বাধীন হলে তাকে বসানো হয় অবিসংবাদিত নেতার আসনে। ভুট্টোর বদান্যতায় তিনি দ্রæত দেশে ফিরে আসেন।
এ পর্যন্ত শেখ মুজিব বাংলার একজন বন্ধু। ছাত্ররা তাকে বাংলার বন্ধু বা বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী দেশে ফেরার কিছুদিন পর পর্যন্ত তিনি আপামর মানুষের ভালবাসা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। মানুষ তাকে প্রকৃতই বঙ্গবন্ধু মনে করতো।
এ সময় তাকে ‘জাতির পিতা’র আসনে বসানো হয়। কিন্তু ‘জাতির পিতা’ হয়ে তিনি একটা নির্দিষ্ট দলের সাথে সম্পৃক্ত রইলেন। দলীয় সরকার গঠন করলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে সড়িয়ে সে পদটি দখল করলেন। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। রক্ষীবাহিনীসহ নানা দলীয় বাহিনী তৈরী করে অল্প দিনের মধ্যে সারা দেশে বিভীষিকার অবস্থা তৈরী করলেন। যে ছাত্ররা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিল তারা তা কেড়ে নিলো। তার শাসনকালে বিরোধী দলগুলোর অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত হলো। ফলে তিনি আর বঙ্গবন্ধু থাকলেন না। ‘জাতির পিতা’ বিষয়টা গোড়া থেকেই বিতর্কিত ছিল। তার নেতৃত্বে বা উছিলায় বাংলাদেশ নামে একটা নতুন দেশ তৈরী হলো অথচ অতিউৎসাহি চাটুকারেরা তাকে হাজার বছরের পুরনো বাঙালী ‘জাতির পিতা’ বানিয়ে দিলো। বাংলাদেশ ভুখন্ডে বসবাসকারি সকল অধিবাসীকে নিয়ে নতুনভাবে গঠিত বাংলাদেশী জাতিসত্বার বা ‘বাংলাদেশী জাতির পিতা’ বানালেও কথা ছিল। কিন্তু বেকুবেরা বাংলাদেশী জাতিসত্বা বলে কিছু স্বীকারই করে না।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের দুইটা অধ্যায়। এক. স্বাধীনতার পূর্বকালের, দুই. স্বাধীনতার পরের কালের। স্বাধীনতাপুর্বকালে তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা। স্বাধীনতার পরের কালে তিনি একজন শাষক মুজিব। সন্ত্রাস সহিংসতা দূর্নীতি লুটপাট দুর্ভিক্ষ অপশাষন দু:শাসন সর্বোপরি এক দলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গনতন্ত্রের কবর দিয়ে একটা স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য সর্বোতভাবে একজন ব্যর্থ শাসক। কাজেই শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল্যায়ন করতে হলে দুটি অধ্যায়কে বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে। স্বাধীনতা পূর্বকালের বঙ্গবন্ধু বলেই যেমন তার স্বৈর শাসন বৈধ হয়ে যায় না তেমনি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই তার স্বাধীনতার জন্য ভুমিকা বা অবদান মুছে যায় না। যারা শেখ মুজিবের রাজনীতির শুধুমাত্র একটামাত্র দিক বিবেচনায় নিয়ে তার সার্বিক মূল্যায়ন করেন তারা হয় দলকানা অথবা মতলববাজ।
আওয়ামী লীগের কাছে তিনি সকল ভুলের উর্দ্ধে একজন মহামানব। বিরোধীদের কাছে জাতির ভিলেন বা একজন খানে দজ্জাল। আওয়ামী লীগের কাছে তার স্বাধীনতা পরবর্তী ভুমিকার জন্য কোন অনুশোচনা নেই, বিরোধীদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনে তার নেতৃত্বের কোন মূল্য নেই। উভয় মূল্যায়নই সত্যের অপলাপ, পক্ষপাতদুষ্ট। আওয়ামী লীগের ব্যপারটা বোধগম্য, কারন মুজিব ছিলেন তাদের নেতা। স্বাধীনতার পর থেকে দলটা তাকে দলীয় নেতা বানিয়েই রেখেছে, জাতির নেতার অবস্থানটা ধরে রাখতে দেয়নি। পক্ষান্তরে যারা স্বাধীনতা অর্জনে শেখ মুজিবের সকল অবদান এবং ভুমিকা অস্বীকার করে তাকে একজন ভিলেন বানাতে চায় এরা মূলত: ’৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। এরা ছিল এক পাকিস্তানের পক্ষে। পাকিস্তান ভাঙার জন্য তারা এককভাবে শেখ মুজিবকে দায়ী করে (অথচ বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান ভাঙার জন্য যদি কোন মামলা হয় তার এক নম্বর আসামী হবেন সিরাজুল আলম খান)। ৫৪ বছর ধরে শেখ মুজিবের বিরদ্ধে এই মহলের যে আক্রমন তা এই রাগ এবং ক্ষোভ থেকে। নতুন প্রজন্মের অনেককে বিশেষ করে জেন জি’র একটা অংশকে দেখা যায় শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সাথে শেখ মুজিবকে মিলিয়ে ফেলে। অথচ এরা শেখ মুজিবকে দেখেনি, তার সম্পর্কে জানেও না। এদের মধ্যে যারা হালে রাজনীতিতে যুক্ত- অনেকেই মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উঠে এসেছে। এদের মন মানসিকতা গড়ে উঠেছে ওস্তাদদের কাছ থেকে নিয়ত: ‘পাকিস্তান ছিল মুসলমানদের দেশ, এটা ভাঙা অন্যায় হয়েছে’ ‘৭১এ বাংলাদেশ বানানো ঠিক হয়নি’ ইত্যাকার সবক শিখতে শিখতে। ফলে এদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা এবং শেখ মুজিব একজন জাতীয় ভিলেন।
শেখ মুজিব চলে গেছেন সেই পচাত্তুর সালে। তার অন্যায় অপকর্ম বা সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা দু:শাসনের দায় চুকিয়ে গেছেন সপরিবারে প্রাণ দিয়ে। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈর শাষনের সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই, তারপরও ৩২ নম্বরে তার বাড়ী বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ’৭১এর পরাজয়ের আক্রোশ থেকে। টুঙ্গীপাড়ায় গিয়ে তার কবর তুলে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয় পাকিস্থান ভেঙে যাওয়ার ক্ষোভ থেকে। ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় ভয় থেকে- যদি মুজিব উঠে আসেন! যদি আর একবার স্বাধীনতার ডাক দেন!