রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-আইনি অস্থিরতায় স্থবির শিল্প

- প্রকাশের সময় : ০৫:৩৮:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
- / ৪৮ বার পঠিত
রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক দুর্দশা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে দেশে শিল্প খাত ক্রমশ গভীরতর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। দেশজুড়ে উদ্যোক্তারা ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কথা জানাচ্ছেন, কেউ কেউ এই পরিস্থিতিকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ শিল্পপতি তীব্র তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক সমন এবং এমনকি আইনি পদক্ষেপের আড়ালে চাঁদাবাজির হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে খুনসহ মিথ্যা ফৌজদারি অভিযোগ আনা হচ্ছে, যা আতঙ্ককে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই থেকে মার্চ) শিল্প পণ্যের আমদানিতে খোলা এলসির পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে কমেছে। এই সময়ে টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ১৬.০৭ শতাংশ কমেছে, যেখানে সেটেলমেন্ট ২১.৬৬ শতাংশ কমেছে। চামড়াশিল্পের এলসি খোলার পরিমাণও ১৮.১৮ শতাংশ কমেছে, যদিও সেটেলমেন্ট ২.৪৬ শতাংশ সামান্য বেড়েছে। ওষুধশিল্প আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ খাতে এলসি খোলার পরিমাণ ২১.৪৪ শতাংশ কমেছে এবং সেটেলমেন্ট ৪২.৫২ শতাংশ কমেছে।
প্যাকেজিং উপকরণের এলসি খোলার পরিমাণ ৩৫.৫২ শতাংশ কমেছে, সেটেলমেন্ট ৩৭.৬৯ শতাংশ কমেছে। কাঁচা তুলার জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ৯.২৯ শতাংশ কমেছে এবং সেটেলমেন্ট ২.৫৩ শতাংশ কমেছে। লোহা ও ইস্পাতের স্ক্র্যাপ, ক্লিংকার এবং চুনাপাথর, কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলার, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এবং মধ্যবর্তী পণ্যসহ অন্যান্য শিল্প আমদানি হ্রাস পেয়েছে। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল পাটের এলসি খোলার ক্ষেত্রে। এই খাতে এলসি খোলার পরিমাণ ৫৩.৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও সেটেলমেন্ট ১৪.৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
পোশাক খাত কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। যেখানে এলসি খোলার পরিমাণ ২০.৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেটেলমেন্ট ৫.৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত এলসি খোলার পরিমাণ ২৮.৬৮ শতাংশ কমে ১ হাজার ৮০৪ মিলিয়ন থেকে ১ হাজার ৩৩৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সেটেলমেন্টও ২৩.৮৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২ হাজার ১৩৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ হাজার ৫২১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতিসহ একাধিক কারণ রয়েছে। উচ্চ সুদের হার এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ব্যাংকঋণকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে, যা বিনিয়োগকে আরো নিরুৎসাহিত করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম বিরোধ এবং সরকার ও ব্যাবসায়িক খাতের মধ্যে সংলাপের অভাব এই অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ শাসনের পতনের পর উত্তেজনা আরো বেড়ে যায় এবং স্থলবাণিজ্য হ্রাস, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি এবং দুর্বল হয়ে পড়া বিশ্ববাজারের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে গুরুতর পরিণতি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শিল্প উৎপাদন হ্রাস এবং বৃহত্তর সামাজিক অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ যদি শোনা না যায়, তাহলে ঈদের পরে আমাদের কারখানা ত্যাগ করতে হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এ দেশে বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি সংস্কার ঘটছে, একটি বিপ্লব চলছে। আমরা সেই বিপ্লবের প্রধান অংশীদার।’ তিনি আরো বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখছি। দয়া করে এটি বিবেচনা করুন। যদি আপনি এই লোকদের বিবেচনায় না নেন, তাহলে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, এই দেশ আর প্রকৃত অর্থে একটি দেশ থাকবে না।’
বাংলাদেশ-থাই চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ একই রকম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘যতক্ষণ না ব্যাংকিং খাত তারল্য ফিরে না পায়, ততক্ষণ কোনো নতুন শিল্প বিনিয়োগ হবে না। ব্যাংকগুলোকে শিল্পে নয়, ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের জন্য তারল্য আরো কঠোর করা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরো কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকট রয়েছে, আছে ব্যাংক অর্থায়নের অভাব এবং সামগ্রিকভাবে নীতিগত অবহেলা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নীতিগুলো শিল্প প্রবৃদ্ধিকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে বলেও মন্তব্য করেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমানও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেখানে আইন-শৃঙ্খলা অনিশ্চিত, সেখানে কেউ বিনিয়োগ করবে না। সরকারকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।’
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি সতর্ক করে বলেন, সামগ্রিক ব্যাবসায়িক পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশ ব্যবসার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। অনাচার, চাঁদাবাজি, অযৌক্তিক মামলা এবং উদ্যোগের ওপর আক্রমণের ক্রমবর্ধমান ঘটনা কেবল অর্থনীতির ক্ষতি করছে না, বরং ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তুলছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, অবিলম্বে এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ আরো গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। সূত্র : ডেইলি সান