টাওয়ার অব বাবেল
পৃথিবীর ভাষার বিভাজন ও মানবতার অহংকার

- প্রকাশের সময় : ০১:৩৫:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫
- / ৫৩ বার পঠিত
টাওয়ার অব বাবেল, প্রাচীন বাইবেলের একটি কাহিনি। এটি শুধু একটি ধর্মীয় গল্প নয়, পৃথিবীর ভাষাগত বৈচিত্র্য, সামাজিক বিভাজন এবং মানুষের সীমাবদ্ধতার গল্পও বটে। গল্পটি বলে যে, একসময় পৃথিবীতে সব মানুষ এক ভাষায় কথা বলত এবং একত্রিত হয়ে আকাশে পৌঁছানোর উদ্দেশে একটি বিশাল টাওয়ার নির্মাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে ঈশ্বর প্রতিক্রিয়া জানান এবং পৃথিবীতে ভাষার বিভাজন সৃষ্টি করেন, যা আজকের বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর ভিত্তি রচনা করে।
টাওয়ার অব বাবেলের পটভূমি বাইবেলের উৎপত্তির (Genesis) প্রথম খণ্ডে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে একতাবদ্ধভাবে মানুষের আকাশ পানে উঠতে চাওয়ার গল্প। আদম ও ইভের সন্তানদের পরবর্তী প্রজন্ম পৃথিবীতে বাস করতে শুরু করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা একটি টাওয়ার নির্মাণ করবে, যা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছাবে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই টাওয়ারের মাধ্যমে পৃথিবীতে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠিত করবে, যার ফলে সমগ্র পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা ও জাতির সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে। এই শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা নিজেদের ঈশ্বরের সমান বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। ঈশ্বর তাদের এই অহংকারের প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি তাদের ভাষাগতভাবে বিভ্রান্ত করে দেন। ফলে তারা একে অপরকে বুঝতে পারে না। ফলস্বরূপ, টাওয়ারের নির্মাণকাজ থেমে যায় এবং মানুষ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আসে, ‘ঈশ্বরের চোখে মানব জাতির অহংকার কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় এবং মানুষের উচিত তার সীমাবদ্ধতা ও ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।’
বাইবেল অনুসারে, ‘টাওয়ার অব বাবেল’ ঘটনাটি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি জিগুরাটের (Ziggurat) ইঙ্গিত হতে পারে। এই জিগুরাটগুলো ছিল প্রাচীন সভ্যতার ধর্মীয় মন্দির। এগুলোর আকৃতি ছিল পিরামিডের মতো। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় এই ধরনের নির্মাণকাজ করা হতো, যেখানে ঈশ্বরের উদ্দেশে আকাশ ছোঁয়া মন্দির বা টাওয়ার তৈরি করা হতো। টাওয়ার অব বাবেল এবং এই জিগুরাটগুলোর মধ্যে মিল পাওয়া যায়, যা এই কাহিনির ঐতিহাসিক ভিত্তি হতে পারে।
টাওয়ার অব বাবেলের এই কিংবদন্তি পৃথিবীতে ভাষাগত বিভাজনের উৎসের একটি ভিত্তির দিকে নির্দেশ করে। পৃথিবীতে এখন প্রায় সাত হাজার ভাষা প্রচলিত, এগুলোর প্রতিটির রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এই বিভাজনটি যদি বিবেচনা করি, তবে দেখা যায় যে, প্রাচীনকালে মানুষ যখন এক ভাষায় কথা বলত, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য ছিল। কিন্তু ভাষার বিভাজন মানুষকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং পৃথিবীজুড়ে নানা ভাষার সৃষ্টি হয়। বহু দার্শনিক এবং ভাষাতত্ত্ববিদ আলোচনা করেছেন যে, এই কিংবদন্তিটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণেরও গুরুত্ব বহন করে। আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি এবং তার বিশ্বায়নের ফলে ভাষাগত বিভাজন কিছুটা কমে আসছে। আমরা এখন একে অপরের সঙ্গে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারি। তবে ভাষাগত বিভাজন এখনো একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। টাওয়ার অব বাবেলের কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজে যদি অহংকার প্রবল হয়ে ওঠে, তাহলে একতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। টাওয়ার অব বাবেল শুধু কিংবদন্তি নয়, এটি আমাদের অহংকার, বিভাজন ও ঐক্য সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। আজকের পৃথিবীতে যেখানে একাধিক ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানে ঐক্য, সম্মান ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা একটি শৃঙ্খলিত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করতে পারি। টাওয়ার অব বাবেল আমাদের শেখায় যে, পৃথিবীর সব বিভাজন সত্ত্বেও, আমরা যদি একে অপরের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করি, তবে পৃথিবীকে আরো সুন্দর করা সম্ভব। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল।