নিউইয়র্ক ১১:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মানবাধিকারের চরম লংঘনকারী হাসিনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ৩৬ বার পঠিত

জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের’ প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে জুলাই-আগস্টে যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। বিক্ষোভ দমাতে ১৪শ’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। ১২ বছরের শিশুর গায়ে ২০০ গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। চোখ হারিয়েছে কয়েকশ’ মানুষ এবং পঙ্গু হয়েছে হাজারেরও বেশি। বিক্ষোভকারীদের দমাতে ‘প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের’ নির্দেশ দেয় শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নিপীড়ন পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় তৎকালীন সরকার এবং নিরাপত্তা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠন যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, ‘জনবিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে একটি পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিত কৌশল হিসেবে নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল সাবেক সরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে’। গতকাল বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বেলা ২টা ৩০ মিনিট) জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় জেনেভার প্যালেস দেস নেশনে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদন সংস্থাটির দপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনে’র সুপারিশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়। পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)-এর কর্মকাণ্ড সীমিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

হাসিনা রেজিমের দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে (ওএইচসিএইচআর) ধন্যবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। জেনেভায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন। এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ওএইচসিএইচআর-এর এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন। এছাড়া হাইকমিশনার অফিসের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানিও উপস্থিত ছিলেন।জুলাই-আগস্টের প্রাণহানির ঘটনাগুলো নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। ওই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মানবাধিকারবিষয়ক তদন্তকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং নিশানা করে হত্যার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা সবচেয়ে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার মধ্যে পড়ে এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল বলেও বিবেচিত হতে পারে। জাতীয় ক্ষত সারাতে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, জনবিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে একটি পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিত কৌশল হিসেবে এমন নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল সাবেক সরকার। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাঁদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

মানবাধিকার লংঘন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে ফলকার টুর্ক বলেন, প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে, সাবেক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল। প্রকৃতপক্ষে গুম, নির্বিচার গ্রেফতার, সহিংস পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দমনের মতো নানা ধরনের মানবাধিকার লংঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ‘অভিযুক্ত শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। এ ক্ষেত্রে কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি অপরাধী দেশের বাইরে থাকে, তখন ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যে দেশে অপরাধী অবস্থান করছে তাদের গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অপরাধের বিচার করতে সম্মত হতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) এ বিষয়ে তদন্তের জন্য বলতে পারে।

জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন বলেন, বিচার প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করলে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের কাছে দেওয়া হবে না। প্রতিবেদনে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু আমরা প্রচুর তথ্য সংরক্ষণ করেছি। সর্বোচ্চ মান অনুযায়ী এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে যাতে করে পরে ব্যবহার করা যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করার বিষয়ে রোরি মুনগোভেন বলেন, জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী মৃত্যুদ-ের বিষয়টি আমাদের জন্য একটি সমস্যা। আমরা এমন বিচারে সহযোগিতা করতে পারি না যেটা মৃত্যুদণ্ডের দিকে নিয়ে যায়। তবে বিচার প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হবে।

প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ : তৎকালীন সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠন যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত ছিল। যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন। ওএইচসিএইচআর যুক্তিসঙ্গত কারণে বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় এই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল।

প্রতিবেদনের আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, ওএইচসিএইচআরের অনুমান, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে নিহত হয়েছেন। এই ধরনের শটগান সাধারণত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু এবং পুলিশের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন জানিয়ে বলা হয়, পুলিশ এবং র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার এবং আটক করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু বলে জানা গেছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেফতার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে। বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখ সারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পৈশাচিক কায়দায় মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন; যার মধ্যে ছিল লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয় যে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি সম্প্রসারিত দল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে তথা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, অনেক অভিযানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশের সহিংস প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে অভিযান শুরুর আগেই সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পুলিশের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ ফোর্সের পেছনে থেকে ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল এবং সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ ও এইচসিএইচআরকে পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাঁদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করেছে। পুলিশের মতে, এই ব্যক্তিরাই হাসিনার অলিগার্ক হিসেবে বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা এবং ৭ জন পুলিশ সদস্য।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হয়, যেখানে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে আরো জানা যায় যে, এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে ‘বিক্ষোভের মূল হোতা’, ‘গ-গোল সৃষ্টিকারী’দের গ্রেফতার, হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন’।

প্রতিবেদন তৈরিতে যেই অনুসন্ধানকারীরা কাজ করেছেন তাঁদের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবং নিয়মিত আদালতে সে সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের অসহযোগিতার কারণে সরকারের এই প্রচেষ্টা বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগে বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে এই প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা পুলিশি অসদাচরণ, যেমন গণহারে মামলা দিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের, অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও স্বপদে বহাল থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার ক্রমাগত ভয় দেখানো, প্রমাণে কারসাজি সেই সঙ্গে আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত অন্যান্য যথাযথ প্রক্রিয়াগত জটিলতা।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশ : প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় এই বলে যে, ওই সময়কালে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লংঘন এবং অপব্যবহারের গুরুতর মাত্রা এবং তাদের অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলো দূর করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে একই ধরনের গুরুতর লংঘন পুনরায় না ঘটে। নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, অনেক দমনমূলক আইন ও নীতি বাতিল, অন্য আইনগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানসম্পন্ন করার জন্য সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসন খাতের সংস্কার, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সুশাসন যাতে করে বাংলাদেশের সকল মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকার সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত হয়। এ ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যায্য এবং স্বাধীন ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যাপক প্রতিকারের পদ্ধতি, যা জাতীয় সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করবে। একটি সামগ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রেক্ষাপট-ভিত্তিক ক্রান্তিকালীন বিচার প্রক্রিয়া বিকাশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ এবং পরামর্শ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ও একটি বৃহত্তর ভুক্তভোগী-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে বড় অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এ ধরনের প্রক্রিয়া সামাজিক সংহতি, জাতীয় নিরাময় এবং সম্প্রদায়ের পুনর্মিলনকে সমর্থন করবে। ওএইচসিএইচআর দায়বদ্ধতা সমর্থন করার লক্ষ্যে প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত লংঘন এবং অপব্যবহারের আরও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশকে সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত রয়েছে। ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো বাংলাদেশে এবং অনলাইনে ভুক্তভোগী এবং অন্য সাক্ষীদের সঙ্গে পরিচালিত ২৩০টিরও বেশি গভীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। সরকার, নিরাপত্তা খাত এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের সাথে আরো ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ জ্ঞান রয়েছে এমন অনেক সাবেক এবং বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তারা রয়েছে। প্রমাণীকৃত ভিডিও এবং ফটো, মেডিক্যাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে অনুসন্ধানগুলো সঙ্গতিপূর্ণ এটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যয় : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সব ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার খাতে ‘কাঠামোগত দুর্বলতা’ তৈরি হয়েছে। আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সকলকে আহ্বান জানাই, আপনারা ন্যায়বিচার, আইন এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখুন। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লংঘন করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসুন। সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

মানবাধিকারের চরম লংঘনকারী হাসিনা

প্রকাশের সময় : ০২:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের’ প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে জুলাই-আগস্টে যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। বিক্ষোভ দমাতে ১৪শ’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। ১২ বছরের শিশুর গায়ে ২০০ গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। চোখ হারিয়েছে কয়েকশ’ মানুষ এবং পঙ্গু হয়েছে হাজারেরও বেশি। বিক্ষোভকারীদের দমাতে ‘প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের’ নির্দেশ দেয় শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নিপীড়ন পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় তৎকালীন সরকার এবং নিরাপত্তা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠন যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, ‘জনবিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে একটি পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিত কৌশল হিসেবে নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল সাবেক সরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে’। গতকাল বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বেলা ২টা ৩০ মিনিট) জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় জেনেভার প্যালেস দেস নেশনে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদন সংস্থাটির দপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনে’র সুপারিশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়। পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)-এর কর্মকাণ্ড সীমিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

হাসিনা রেজিমের দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে (ওএইচসিএইচআর) ধন্যবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। জেনেভায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন। এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ওএইচসিএইচআর-এর এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন। এছাড়া হাইকমিশনার অফিসের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানিও উপস্থিত ছিলেন।জুলাই-আগস্টের প্রাণহানির ঘটনাগুলো নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। ওই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মানবাধিকারবিষয়ক তদন্তকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং নিশানা করে হত্যার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা সবচেয়ে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার মধ্যে পড়ে এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল বলেও বিবেচিত হতে পারে। জাতীয় ক্ষত সারাতে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, জনবিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে একটি পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিত কৌশল হিসেবে এমন নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল সাবেক সরকার। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাঁদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

মানবাধিকার লংঘন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে ফলকার টুর্ক বলেন, প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে, সাবেক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল। প্রকৃতপক্ষে গুম, নির্বিচার গ্রেফতার, সহিংস পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দমনের মতো নানা ধরনের মানবাধিকার লংঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ‘অভিযুক্ত শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। এ ক্ষেত্রে কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি অপরাধী দেশের বাইরে থাকে, তখন ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যে দেশে অপরাধী অবস্থান করছে তাদের গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অপরাধের বিচার করতে সম্মত হতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) এ বিষয়ে তদন্তের জন্য বলতে পারে।

জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন বলেন, বিচার প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করলে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের কাছে দেওয়া হবে না। প্রতিবেদনে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু আমরা প্রচুর তথ্য সংরক্ষণ করেছি। সর্বোচ্চ মান অনুযায়ী এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে যাতে করে পরে ব্যবহার করা যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করার বিষয়ে রোরি মুনগোভেন বলেন, জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী মৃত্যুদ-ের বিষয়টি আমাদের জন্য একটি সমস্যা। আমরা এমন বিচারে সহযোগিতা করতে পারি না যেটা মৃত্যুদণ্ডের দিকে নিয়ে যায়। তবে বিচার প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হবে।

প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ : তৎকালীন সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠন যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত ছিল। যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন। ওএইচসিএইচআর যুক্তিসঙ্গত কারণে বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় এই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল।

প্রতিবেদনের আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, ওএইচসিএইচআরের অনুমান, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে নিহত হয়েছেন। এই ধরনের শটগান সাধারণত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু এবং পুলিশের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন জানিয়ে বলা হয়, পুলিশ এবং র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার এবং আটক করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু বলে জানা গেছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেফতার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে। বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখ সারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পৈশাচিক কায়দায় মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন; যার মধ্যে ছিল লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয় যে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি সম্প্রসারিত দল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে তথা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, অনেক অভিযানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশের সহিংস প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে অভিযান শুরুর আগেই সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পুলিশের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ ফোর্সের পেছনে থেকে ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল এবং সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ ও এইচসিএইচআরকে পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাঁদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করেছে। পুলিশের মতে, এই ব্যক্তিরাই হাসিনার অলিগার্ক হিসেবে বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা এবং ৭ জন পুলিশ সদস্য।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হয়, যেখানে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে আরো জানা যায় যে, এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে ‘বিক্ষোভের মূল হোতা’, ‘গ-গোল সৃষ্টিকারী’দের গ্রেফতার, হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন’।

প্রতিবেদন তৈরিতে যেই অনুসন্ধানকারীরা কাজ করেছেন তাঁদের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবং নিয়মিত আদালতে সে সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের অসহযোগিতার কারণে সরকারের এই প্রচেষ্টা বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগে বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে এই প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা পুলিশি অসদাচরণ, যেমন গণহারে মামলা দিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের, অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও স্বপদে বহাল থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার ক্রমাগত ভয় দেখানো, প্রমাণে কারসাজি সেই সঙ্গে আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত অন্যান্য যথাযথ প্রক্রিয়াগত জটিলতা।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশ : প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় এই বলে যে, ওই সময়কালে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লংঘন এবং অপব্যবহারের গুরুতর মাত্রা এবং তাদের অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলো দূর করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে একই ধরনের গুরুতর লংঘন পুনরায় না ঘটে। নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, অনেক দমনমূলক আইন ও নীতি বাতিল, অন্য আইনগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানসম্পন্ন করার জন্য সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসন খাতের সংস্কার, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সুশাসন যাতে করে বাংলাদেশের সকল মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকার সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত হয়। এ ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যায্য এবং স্বাধীন ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যাপক প্রতিকারের পদ্ধতি, যা জাতীয় সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করবে। একটি সামগ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রেক্ষাপট-ভিত্তিক ক্রান্তিকালীন বিচার প্রক্রিয়া বিকাশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ এবং পরামর্শ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ও একটি বৃহত্তর ভুক্তভোগী-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে বড় অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এ ধরনের প্রক্রিয়া সামাজিক সংহতি, জাতীয় নিরাময় এবং সম্প্রদায়ের পুনর্মিলনকে সমর্থন করবে। ওএইচসিএইচআর দায়বদ্ধতা সমর্থন করার লক্ষ্যে প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত লংঘন এবং অপব্যবহারের আরও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশকে সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত রয়েছে। ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো বাংলাদেশে এবং অনলাইনে ভুক্তভোগী এবং অন্য সাক্ষীদের সঙ্গে পরিচালিত ২৩০টিরও বেশি গভীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। সরকার, নিরাপত্তা খাত এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের সাথে আরো ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ জ্ঞান রয়েছে এমন অনেক সাবেক এবং বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তারা রয়েছে। প্রমাণীকৃত ভিডিও এবং ফটো, মেডিক্যাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে অনুসন্ধানগুলো সঙ্গতিপূর্ণ এটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যয় : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সব ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার খাতে ‘কাঠামোগত দুর্বলতা’ তৈরি হয়েছে। আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সকলকে আহ্বান জানাই, আপনারা ন্যায়বিচার, আইন এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখুন। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লংঘন করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসুন। সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।