পুলিশ দেশের নাগরিক বিদেশের!

- প্রকাশের সময় : ০৫:৪৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ৮৯ বার পঠিত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের আমলনামা তৈরি শুরু হয়েছে মাস তিনেক আগেই। বিতর্কিত কর্তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কেউ আছেন দেশের বাইরে আবার কেউ আছেন কর্মস্থলে বা আত্মগোপনে। আমলনামা তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো কোনো কর্মকর্তা বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য কোনো দেশের নাগরিক। এসব তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর।
সদর দপ্তর নিশ্চিত হয়েছে, অন্তত ১০ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা অন্য কিছু দেশের নাগরিক হয়েছেন। তাদের সবার কাছে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের পাসপোর্ট রয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মালয়েশিয়া। সরকারের কয়েকটি সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে যেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশি পাসপোর্ট নিয়েছেন তার মধ্যে সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব আছে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। তাদের দুর্নীতির উৎস বের করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করতে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছে বিশেষ চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকেও চিঠি দিয়েছে সরকারের একটি সংস্থা। চিঠিতে বলা হয়েছে, পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তথ্য গোপন করে বাংলাদেশ ছাড়াও ভিন্ন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই পুলিশের অনেক কর্মকর্তা চলে যান আত্মগোপনে। আবার কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন। তারা গ্রেপ্তার এড়াতে বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে নিজেদের রক্ষা করাসহ তাদের অপকর্ম ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদের এ ধরনের কার্যকলাপ সরকারি চাকরিবিধি ২০১৮-এর ৪০ ধারার পরিপন্থী।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কথিত পুলিশ কর্মকর্তাদের একাধিক পাসপোর্ট নেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য হলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ গোপন করে তা বিদেশে পাচার করা ও ভোগ করা। তাদের এমন কার্যকলাপ দেশে দুর্নীতির প্রসারে ভূমিকা রাখছে এবং দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সংশ্লিষ্ট আইনের ৪০ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো সরকারি কর্মচারী অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। চিঠি পাওয়ার পর পুলিশ সদর দপ্তর ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। ওই কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানদের কাছে চিঠি দিয়েছে সদর দপ্তর। পুলিশের কোন কোন কর্মকর্তার সন্তানরা দেশের বাইরে পড়ালেখা করছে কি না, তার তথ্যও বের করার চেষ্টা চলছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গত শুক্রবার বলেন, ‘যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার পাশাপাশি অঢেল সম্পদ গড়েছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রায় দুই মাস ধরে আমরা অনুসন্ধান করছি। তালিকার মধ্যে এমন কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন যারা নিজেদের আওয়ামী লীগ বিরোধী কর্মকর্তা দাবি করছেন। তবে তারা গত ১৬ বছর ধরে ভালোস্থানেই দায়িত্ব পালন করেছেন।’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও তারা ভালো স্থানেই দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের বিষয়েও আমরা তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তার সন্তানরা দেশের বাইরে পড়ালেখা করছে, তাদের তালিকা বের করার চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিকদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশে আমরা যোগাযোগ করছি। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করতে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রধানদের কাছে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ এক হাজারের মতো ব্যক্তির প্রাণ গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি গোপনে ভারতে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের বড় বড় নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। তাদের মতোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবলরা আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০২ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এখন পর্যন্ত ৩৩ জন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের রিমান্ডে নিয়ে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের বেপরোয়া বলপ্রয়োগের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। রিমান্ডে ধৃত অন্য পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরাও কার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে তথ্য দিয়েছেন তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশের বলপ্রয়োগের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে। ওইসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকাভুক্তরা বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ তুরস্ক ও লন্ডনের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক প্রধান মীর রেজাউল আলম অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান ও আলোচিত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ আমেরিকার পাসপোর্ট নিয়েছেন। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ, র্যাবের সাবেক প্রধান এম খুরশিদ হোসেন, রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক আবুল বাতেন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবীসহ অন্তত ১০ কর্মকর্তার যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট আছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর নিশ্চিত হয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তারা ছাত্র-আন্দোলনের সময় নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোকজনকে হত্যা করেছে। দেশের বাইরে নাগরিকত্ব লাভ ও যাদের সন্তানরা বিদেশে পড়ালেখা করছে তাদের মধ্যে ৭ম, ৮ম ব্যাচ, ১২, ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। তাছাড়া ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর ও কনস্টেবলদের সন্তানরাও দেশের বাইরে পড়ালেখা করছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। পুলিশ সদর দপ্তরের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে দুদকও কাজ করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উচ্চাভিলাষী অপেশাদার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে পুলিশের বিভিন্ন আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেন। সূত্র : দেশ রূপান্তর।