নিউইয়র্ক ০৬:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কিসের অপেক্ষায় ইসি?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:৩৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ৯৯ বার পঠিত

দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। একটিতে চোখ নিবদ্ধ করতেই সামনে হাজির আরেকটি। সময় যাচ্ছে অস্থিরতায়। ফ্যাসিজমের সিম্বল ছিল ৩২ নম্বর রোডে শেখ মুজিবের বাড়ি। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ক্ষমতাচ্যুত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হাসিনার দিল্লিতে বসে উসকানির প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাড়িটি ধুলায় মিশিয়ে। এটিকে ‘ইস্যু’ করে হাসিনা এবং উৎখাত হওয়া বশংবদরা এখন মেতে উঠেছেন অপতৎপরতায়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। তৎপর হয়েছে সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণহীনতা’ প্রমাণে। নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছে সারাদেশে। এতে নাগরিক মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মানুষ লক্ষ করছে, প্রতিদিনই ঘটছে কিছু না কিছু। কে কোন দিক দিয়ে ঘটাচ্ছে-ঠাহর করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘ব্যর্থতা’ আবিষ্কার করতে চাইছে। ভারত আশ্রিত হাসিনার টার্গেটও সেটি। তাই এ দিল্লিদাসী হাসিনা নিজেই অডিও ছেড়ে মাঝেমধ্যেই দিচ্ছেন নিত্য-নতুন উসকানি। ভারত পালিয়ে যাওয়া মাফিয়া সরকারের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও পদধারী ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্র। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ফাঁস হওয়া পরিকল্পনা। গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর আ ক ম মোজাম্মেল ও জাহাঙ্গীর অনুসারীদের হামলা। পরপরই ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু। এক ইস্যু নিরসন চেষ্টা থেকে কয়েক ইস্যুর সৃষ্টি। সিনেমার সিকোয়েন্সের মতো মুহূর্তে বদলাচ্ছে সিনারিও। কিন্তু এর শেষ কোথায়? ড.মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘ভদ্রতা’কে দুর্বলতা মনে করে নৈরাজ্যকে বাড়তেই বা দিচ্ছে কারা? এসবের যবনিকাপাতই বা ঘটবে কিভাবে? অনেকে মনে করছেন, ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে সব নৈরাজ্যের ইতি। নির্বাচিত সরকারই পারে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে। দ্রুত নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধুমাত্র বিএনপির একক দাবি হিসেবে দেখছেন না তারা। দিল্লির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হাসিনার আস্ফালন, তার অনুসারীদের চোরাগোপ্তা কর্মকা- তথা ক্রমঃবিস্তৃত অস্থিরতা মানুষের মনে এই প্রশ্ন উসকে দিয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে কি-না? ডিসেম্বরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কি-না? প্রশ্নগুলো এখন উঠছে এ কারণে যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিত্যনুতন চ্যালেঞ্জ আরো সামনে আসছে। যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব করা যায় তাহলে গভীর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা। ‘সংবিধান সংরক্ষণ কমিটি’র মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব দ্রুত নির্বাচনের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে, সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দেয়া উচিত। বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই অর্থে সংস্কারের হাত পড়েনি। হাসিনা নিযুক্ত এবং ফ্যাসিবাদের সমর্থক বিচারকরা এখনো সুপ্রিম কোর্টে বহাল। দুর্নীতি বিচার বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এসবের কিনারা না করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কি করে সম্ভব? এগুলো তো নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সরকারের কাজ। তাহলে নির্বাচন কমিশন কিভাবে এককভাবে নির্বাচনের ডেডলাইন ঘোষণা দেবে?

এদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসি নিজেই অনেকক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করছে। নির্বাচন কমিশন ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ছে। সরকারও নানাভাবে ম্যানিপুলেট করে থাকতে পারে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ধরা যাক, দেশে একটি গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ আছে। নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণী আইনের সংশোধনীরও একটি বিষয় রয়েছে। নির্বাচনের সমস্ত প্রস্তুতি আটকে আছে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এ দুটি আইনের সংশোধনীর ওপর। অথচ এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। এখন পর্যন্ত চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। যদিও একজন কমিশনার বলেছেন, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ বছরের শেষ দিকে কিংবা আগামী বছরের শুরুর দিকে। একজন কমিশনারের কাছ থেকে মানুষ জানল যে, কিছু সংস্কার কার্যক্রমের কারণে প্রস্তুতিতে নির্বাচন কমিশন আটকে আছে। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। দুটি আইনই সংশোধন হবে নাকি আইন সংস্কার হবে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কিছুই জানে না। এ বিষয়ে সময়ক্ষেপণ হলে প্রস্তুতিতে পিছিয়ে যাবে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচনের আয়োজন করা কঠিন হবে। আমরা পিছিয়ে যাবো।

প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন কেন কিছু জানবে না? কে ইসিকে জানিয়ে দেবে যে, কবে নির্বাচন? তার মানে ইসি কি স্বাধীন নয়? সম্পূর্ণরূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল? কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন থাকার কথা। ইসির কার্যক্রম তো সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। কেউ চাইলেই নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনারদেরও সরিয়ে দিতে পারবে না। তাহলে কে নির্বাচন কমিশনকে ‘পরাধীন’ করে রেখেছে? নির্বাচন মুক্তকণ্ঠে তাদের অন্তরায়গুলোর কথা জাতিকে জানাতে পারে। কে, কোথায় কিভাবে সঙ্কট সৃষ্টি করছে? প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে? মানুষ ‘ক্লিয়ার কাট’ শুনতে চায়। দেড় দশক ধরে মানুষ ভোট দিতে পারছে না। দীর্ঘ দিনের জনআকাক্সক্ষা যে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি ভালো নির্বাচন হবে। মানুষ বহু দিন পর ভোট দিতে পারবে। এমন ঐতিহাসিক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছেন এএমএম নাসিরউদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তাহলে এ কমিশন সীমাবদ্ধতার কথা বলতে পারবে না কেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি কেন বলতে পারছেন না, নির্বাচন কবে হবে? নির্বাচন কমিশন কেন নিজেকে ছোট করে কথা বলছে? মানুষ সরকারি ভাষ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত টুকরো টুকরো তথ্য জানছে। সরকারের ভাষ্যে, প্রেস সেক্রেটারির নিয়মিত ব্রিফিংয়ে একাধিকবার বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে যেসব সংস্কার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেবে তার ওপর নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে হবে, নাকি ২০০৬ সালের জুনে মধ্যে হবে। তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি বেশি সংস্কার না চায় তাহলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। বেশি সংস্কার চাইলে সময় বেশি দিতে হবে। প্রেস সেক্রেটারির এ ভাষ্য নিয়ে সরকারের ভেতরেই নানা মত আছে। মতদ্বৈততা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হচ্ছেÑ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অন্যরা যা বলছেন, সেটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকারে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক ফ্যাক্টর যারা আছেন, তারা যা বলছেন, সেটি কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নির্বিকার। পুলিশ, সেনাবাহিনী কোনো কিছুই সেই অর্থে কোনো কাজ করছে না। কেন কাজ করছেন নÑ এ প্রশ্নের উত্তর খতিয়ে দেখা দরকার। কেন হচ্ছে না, মানুষের জানা দরকার। কারণ, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের যে পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে কার্যত সেটি হলে পরিস্থিতি হবে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, ভবিষ্যতের স্বার্থে সবার ভেতরকার পরিস্থিতি এবং সরকারের পরিকল্পনা জানা দরকার। জানা দরকার নির্বাচন নিয়ে ইসির প্রস্তুতি-পরিকল্পনা। সেটির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

ছয় মাস হয়ে গেল মানুষ এখন পর্যন্ত একটি নির্বাচনের রোডম্যাপ পায়নি। বিএনপিকে রোডম্যাপের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়েছে। গতকাল শনিবার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেশ করেছে সংস্কার প্রস্তাবের লক্ষ্যে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশন। এখন একটি ন্যাশনাল কনসিসনেন্স কমিটি করার কথা রয়েছে। এটির প্রধান হবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর আলী রিয়াজ। তারা একটি ন্যাশনাল কনসিসনেন্স তৈরির চেষ্টা করবেনÑ মর্মে ঘোষণা আছে। কিন্তু কিভাবে সেটি হবে? সেটির মেথড কি? এখন পর্যন্ত তা পরিষ্কার নয়। ফরমাল ওয়েতে করবেন নাকি নন-ফরমাল ওয়েতে করবেন? প্রশ্ন আছে। আর এটির জন্যও সময়ও দিতে হবে। যে ছয়জন কিংবা সাতজন এই কমিটিতে থাকবেন তারাই কিন্তু এটি করতে পারবেন না। আরো কিছু লোক লাগবে। এমন একটি আবহ কিংবা পরিবেশ সরকারের দিক থেকে তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছে না। কার অপেক্ষায় আছে? কিসের জন্য অপেক্ষা করছে? নতুন দল নিবন্ধনের ‘গণবিজ্ঞপ্তি’ আটকে আছে অজ্ঞাত কারণে। ইসিসহ একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন অতি দ্রুত এ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে প্রস্তুত। কিন্তু ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেনÑ বলে গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে বিলম্ব হওয়ার কথা জানা যাচ্ছে। ছাত্ররা জনমত যাচাই করবে। সার্ভে করবে। সেটি সময়সাপেক্ষ। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ছাত্ররা কি রাজনৈতিক দল করছেন? বাংলাদেশে তো কোটি কোটি ছাত্র। সব ছাত্র কি রাজনৈতিক দল গঠন প্রশ্নে একমত? আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছে, রক্ত দিয়েছেÑ এমন অনেক মতের ছাত্র রয়েছেন। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট আছে। তারা কি সবাই দল গঠন প্রশ্নে একমত? জিল্লুর রহমানের মতে, যে ছাত্ররা রাজনীতি করতে চায়নি, রাজনীতি পছন্দ করেন না, রাজনীতি বিমুখ, রাজনীতি করতে চায় নি, তারা হয়তো জীবনের তাগিদে, স্বাধীন মত প্রকাশের তাগিদে, গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায়, সতীর্থের যখন জীবন যাচ্ছে তখন রাজপথে নেমেছেন। নানা হিসাব থেকে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন করেছেন। জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তারা কি রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে আরেকটি রাজনৈতিক লড়াইয়ের আকাক্সক্ষায় এখনই মাঠে নামবেন? একজন ছাত্রের ‘ছাত্রত্ব’র বয়সসীমা কত? আজ যিনি ছাত্র আছেন, কাল তিনি ছাত্র থাকছেন না। একটি রাজনৈতিক দল তো বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, যুগ যুগ কাজ করে। নির্বাচন কমিশন যে বলছে, ছাত্ররা নতুন দল করবেন বলে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন আসছেÑ যেসব ছাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায় তাদের সঙ্গে কি নির্বাচন কমিশনের যোগাযোগ আছে? ইসি কি ছাত্রদের দ্বারা প্রভাবিত? নাকি সরকার প্রভাবিত করছে ইসিকে, যে ছাত্রদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে কি কিংস পার্টি হচ্ছে? ছাত্ররা কবে রাজনৈতিক দল গঠন করবে, কবে নিবন্ধন হবেÑ তার জন্য নির্বাচন কমিশনের অপেক্ষা! বিষয়টিকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন জিল্লুর রহমান।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

কিসের অপেক্ষায় ইসি?

প্রকাশের সময় : ০৫:৩৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। একটিতে চোখ নিবদ্ধ করতেই সামনে হাজির আরেকটি। সময় যাচ্ছে অস্থিরতায়। ফ্যাসিজমের সিম্বল ছিল ৩২ নম্বর রোডে শেখ মুজিবের বাড়ি। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ক্ষমতাচ্যুত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হাসিনার দিল্লিতে বসে উসকানির প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাড়িটি ধুলায় মিশিয়ে। এটিকে ‘ইস্যু’ করে হাসিনা এবং উৎখাত হওয়া বশংবদরা এখন মেতে উঠেছেন অপতৎপরতায়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। তৎপর হয়েছে সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণহীনতা’ প্রমাণে। নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছে সারাদেশে। এতে নাগরিক মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মানুষ লক্ষ করছে, প্রতিদিনই ঘটছে কিছু না কিছু। কে কোন দিক দিয়ে ঘটাচ্ছে-ঠাহর করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘ব্যর্থতা’ আবিষ্কার করতে চাইছে। ভারত আশ্রিত হাসিনার টার্গেটও সেটি। তাই এ দিল্লিদাসী হাসিনা নিজেই অডিও ছেড়ে মাঝেমধ্যেই দিচ্ছেন নিত্য-নতুন উসকানি। ভারত পালিয়ে যাওয়া মাফিয়া সরকারের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও পদধারী ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্র। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ফাঁস হওয়া পরিকল্পনা। গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর আ ক ম মোজাম্মেল ও জাহাঙ্গীর অনুসারীদের হামলা। পরপরই ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু। এক ইস্যু নিরসন চেষ্টা থেকে কয়েক ইস্যুর সৃষ্টি। সিনেমার সিকোয়েন্সের মতো মুহূর্তে বদলাচ্ছে সিনারিও। কিন্তু এর শেষ কোথায়? ড.মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘ভদ্রতা’কে দুর্বলতা মনে করে নৈরাজ্যকে বাড়তেই বা দিচ্ছে কারা? এসবের যবনিকাপাতই বা ঘটবে কিভাবে? অনেকে মনে করছেন, ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে সব নৈরাজ্যের ইতি। নির্বাচিত সরকারই পারে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে। দ্রুত নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধুমাত্র বিএনপির একক দাবি হিসেবে দেখছেন না তারা। দিল্লির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হাসিনার আস্ফালন, তার অনুসারীদের চোরাগোপ্তা কর্মকা- তথা ক্রমঃবিস্তৃত অস্থিরতা মানুষের মনে এই প্রশ্ন উসকে দিয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে কি-না? ডিসেম্বরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কি-না? প্রশ্নগুলো এখন উঠছে এ কারণে যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিত্যনুতন চ্যালেঞ্জ আরো সামনে আসছে। যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব করা যায় তাহলে গভীর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা। ‘সংবিধান সংরক্ষণ কমিটি’র মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব দ্রুত নির্বাচনের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে, সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দেয়া উচিত। বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই অর্থে সংস্কারের হাত পড়েনি। হাসিনা নিযুক্ত এবং ফ্যাসিবাদের সমর্থক বিচারকরা এখনো সুপ্রিম কোর্টে বহাল। দুর্নীতি বিচার বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এসবের কিনারা না করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কি করে সম্ভব? এগুলো তো নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সরকারের কাজ। তাহলে নির্বাচন কমিশন কিভাবে এককভাবে নির্বাচনের ডেডলাইন ঘোষণা দেবে?

এদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসি নিজেই অনেকক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করছে। নির্বাচন কমিশন ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ছে। সরকারও নানাভাবে ম্যানিপুলেট করে থাকতে পারে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ধরা যাক, দেশে একটি গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ আছে। নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণী আইনের সংশোধনীরও একটি বিষয় রয়েছে। নির্বাচনের সমস্ত প্রস্তুতি আটকে আছে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এ দুটি আইনের সংশোধনীর ওপর। অথচ এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। এখন পর্যন্ত চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। যদিও একজন কমিশনার বলেছেন, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ বছরের শেষ দিকে কিংবা আগামী বছরের শুরুর দিকে। একজন কমিশনারের কাছ থেকে মানুষ জানল যে, কিছু সংস্কার কার্যক্রমের কারণে প্রস্তুতিতে নির্বাচন কমিশন আটকে আছে। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। দুটি আইনই সংশোধন হবে নাকি আইন সংস্কার হবে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কিছুই জানে না। এ বিষয়ে সময়ক্ষেপণ হলে প্রস্তুতিতে পিছিয়ে যাবে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচনের আয়োজন করা কঠিন হবে। আমরা পিছিয়ে যাবো।

প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন কেন কিছু জানবে না? কে ইসিকে জানিয়ে দেবে যে, কবে নির্বাচন? তার মানে ইসি কি স্বাধীন নয়? সম্পূর্ণরূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল? কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন থাকার কথা। ইসির কার্যক্রম তো সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। কেউ চাইলেই নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনারদেরও সরিয়ে দিতে পারবে না। তাহলে কে নির্বাচন কমিশনকে ‘পরাধীন’ করে রেখেছে? নির্বাচন মুক্তকণ্ঠে তাদের অন্তরায়গুলোর কথা জাতিকে জানাতে পারে। কে, কোথায় কিভাবে সঙ্কট সৃষ্টি করছে? প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে? মানুষ ‘ক্লিয়ার কাট’ শুনতে চায়। দেড় দশক ধরে মানুষ ভোট দিতে পারছে না। দীর্ঘ দিনের জনআকাক্সক্ষা যে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি ভালো নির্বাচন হবে। মানুষ বহু দিন পর ভোট দিতে পারবে। এমন ঐতিহাসিক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছেন এএমএম নাসিরউদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তাহলে এ কমিশন সীমাবদ্ধতার কথা বলতে পারবে না কেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি কেন বলতে পারছেন না, নির্বাচন কবে হবে? নির্বাচন কমিশন কেন নিজেকে ছোট করে কথা বলছে? মানুষ সরকারি ভাষ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত টুকরো টুকরো তথ্য জানছে। সরকারের ভাষ্যে, প্রেস সেক্রেটারির নিয়মিত ব্রিফিংয়ে একাধিকবার বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে যেসব সংস্কার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেবে তার ওপর নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে হবে, নাকি ২০০৬ সালের জুনে মধ্যে হবে। তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি বেশি সংস্কার না চায় তাহলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। বেশি সংস্কার চাইলে সময় বেশি দিতে হবে। প্রেস সেক্রেটারির এ ভাষ্য নিয়ে সরকারের ভেতরেই নানা মত আছে। মতদ্বৈততা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হচ্ছেÑ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অন্যরা যা বলছেন, সেটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকারে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক ফ্যাক্টর যারা আছেন, তারা যা বলছেন, সেটি কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নির্বিকার। পুলিশ, সেনাবাহিনী কোনো কিছুই সেই অর্থে কোনো কাজ করছে না। কেন কাজ করছেন নÑ এ প্রশ্নের উত্তর খতিয়ে দেখা দরকার। কেন হচ্ছে না, মানুষের জানা দরকার। কারণ, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের যে পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে কার্যত সেটি হলে পরিস্থিতি হবে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, ভবিষ্যতের স্বার্থে সবার ভেতরকার পরিস্থিতি এবং সরকারের পরিকল্পনা জানা দরকার। জানা দরকার নির্বাচন নিয়ে ইসির প্রস্তুতি-পরিকল্পনা। সেটির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

ছয় মাস হয়ে গেল মানুষ এখন পর্যন্ত একটি নির্বাচনের রোডম্যাপ পায়নি। বিএনপিকে রোডম্যাপের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়েছে। গতকাল শনিবার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেশ করেছে সংস্কার প্রস্তাবের লক্ষ্যে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশন। এখন একটি ন্যাশনাল কনসিসনেন্স কমিটি করার কথা রয়েছে। এটির প্রধান হবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর আলী রিয়াজ। তারা একটি ন্যাশনাল কনসিসনেন্স তৈরির চেষ্টা করবেনÑ মর্মে ঘোষণা আছে। কিন্তু কিভাবে সেটি হবে? সেটির মেথড কি? এখন পর্যন্ত তা পরিষ্কার নয়। ফরমাল ওয়েতে করবেন নাকি নন-ফরমাল ওয়েতে করবেন? প্রশ্ন আছে। আর এটির জন্যও সময়ও দিতে হবে। যে ছয়জন কিংবা সাতজন এই কমিটিতে থাকবেন তারাই কিন্তু এটি করতে পারবেন না। আরো কিছু লোক লাগবে। এমন একটি আবহ কিংবা পরিবেশ সরকারের দিক থেকে তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছে না। কার অপেক্ষায় আছে? কিসের জন্য অপেক্ষা করছে? নতুন দল নিবন্ধনের ‘গণবিজ্ঞপ্তি’ আটকে আছে অজ্ঞাত কারণে। ইসিসহ একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন অতি দ্রুত এ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে প্রস্তুত। কিন্তু ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেনÑ বলে গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে বিলম্ব হওয়ার কথা জানা যাচ্ছে। ছাত্ররা জনমত যাচাই করবে। সার্ভে করবে। সেটি সময়সাপেক্ষ। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ছাত্ররা কি রাজনৈতিক দল করছেন? বাংলাদেশে তো কোটি কোটি ছাত্র। সব ছাত্র কি রাজনৈতিক দল গঠন প্রশ্নে একমত? আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছে, রক্ত দিয়েছেÑ এমন অনেক মতের ছাত্র রয়েছেন। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট আছে। তারা কি সবাই দল গঠন প্রশ্নে একমত? জিল্লুর রহমানের মতে, যে ছাত্ররা রাজনীতি করতে চায়নি, রাজনীতি পছন্দ করেন না, রাজনীতি বিমুখ, রাজনীতি করতে চায় নি, তারা হয়তো জীবনের তাগিদে, স্বাধীন মত প্রকাশের তাগিদে, গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায়, সতীর্থের যখন জীবন যাচ্ছে তখন রাজপথে নেমেছেন। নানা হিসাব থেকে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন করেছেন। জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তারা কি রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে আরেকটি রাজনৈতিক লড়াইয়ের আকাক্সক্ষায় এখনই মাঠে নামবেন? একজন ছাত্রের ‘ছাত্রত্ব’র বয়সসীমা কত? আজ যিনি ছাত্র আছেন, কাল তিনি ছাত্র থাকছেন না। একটি রাজনৈতিক দল তো বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, যুগ যুগ কাজ করে। নির্বাচন কমিশন যে বলছে, ছাত্ররা নতুন দল করবেন বলে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন আসছেÑ যেসব ছাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায় তাদের সঙ্গে কি নির্বাচন কমিশনের যোগাযোগ আছে? ইসি কি ছাত্রদের দ্বারা প্রভাবিত? নাকি সরকার প্রভাবিত করছে ইসিকে, যে ছাত্রদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে কি কিংস পার্টি হচ্ছে? ছাত্ররা কবে রাজনৈতিক দল গঠন করবে, কবে নিবন্ধন হবেÑ তার জন্য নির্বাচন কমিশনের অপেক্ষা! বিষয়টিকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন জিল্লুর রহমান।