ড. ইউনূস: না বললেও চলতো
- প্রকাশের সময় : ১১:৩৬:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ৩৬ বার পঠিত
সামরিক শাসন জারি আর তা থেকে বেরোনোর চ্যালেঞ্জই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়- ‘বাঘের পিঠে চড়ে বসা’। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধ্বস্ত অবস্থায় ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে ওলট-পালটের মধ্যদিয়ে সৃষ্ট সরকারের হাল ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশ পরিচালনা, রাষ্ট্র-সংস্কারের বজ্র কঠিন প্রত্যয় এবং সুষ্ঠু ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর- এই তিন চ্যালেঞ্জে পড়ার পরিস্থিতি কি বাঘের পিঠে চড়ে বসে বা নিরাপদে নেমে যাওয়ার চেয়ে ভয়ঙ্কর নয়? পাঁচ মাসের পর বর্তমানে নানা কারণেই কি পরিস্থিতি অনিশ্চিত-অনির্দেশ্য হয়ে উঠছে না? এখন কি ভাবছেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস? কোন পথে এগোবেন? কেউ বলতে পারেন, আমরা খামোখা একটা মনগড়া রূপকল্প গড়ছি, আদতে ইউনূস সাহেবের কপালে কোনো দুশ্চিন্তার রেখা নেই, মোটেও ঘামছেন না তিনি। এই যে বিদেশি অতিথি বা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন। বিদেশে নানা সম্মেলনে তাকে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ত্রাতা হিসেবে। ডানপন্থি একটা নজিরবিহীন বিপ্লবের বিজয়ী রূপে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘যমুনা’ থেকে যেসব গুঞ্জন ভেসে আসে অথবা তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারীরা যখন বাইরে এসে যেসব বলেন অথবা সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাওয়ার যে কথাগুলো তিনি একান্তে উচ্চারণ করেন, তখন তো নানা চিন্তার ডাল-পালা গজায়। কোথায় তার তাবত দুশ্চিন্তার উৎপত্তি কেন্দ্র? প্রস্থান বিন্দু কি অতো দ্রুত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে? অথচ এমন সৌভাগ্য আর বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধানের হয়নি। কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, বর্তমান জাতীয় দুর্যোগ রোধে একটা শক্তিশালী জাতীয় ঐক্যের গাঁট বন্ধন তৈরিতে ড. ইউনূসের বিকল্প আছে কিনা অথবা তার নিয়তে কোনো ভেজাল আছে। তার প্রতি জাতির আস্থা প্রগাঢ়। ভারত বাদে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক সমর্থন তার ঝুলিতে। হবেই বা না কেন? আর কোনো নোবেল বিজয়ী এমন দায়িত্ব পেয়েছেন কি?। ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলা, পাচার হওয়া টাকা দ্রুত ফেরত আনার উদ্যোগ, ডলারের দরপতন ঠেকিয়ে দেয়া, রপ্তানি বাড়ানো, ফ্যাসিবাদীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, সংস্কার কমিশনগুলো গঠন ও সক্রিয়করণ- এ সব তো সাহসী কৃতিত্ব। ভারত বা আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে কোনো আর্জিই করতে পারছে না। কেননা পশ্চিমা বিশ্বে ড. ইউনূসের ইমেজ বড্ড শক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের মুল্লুকে ডনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠানের পরও ডেমোক্রেট-ঘনিষ্ঠ ড. ইউনূসের তেমন সমস্যা হয়নি। আর রোহিঙ্গা বিদ্বেষী আরাকান আর্মির উত্থানের পরবর্তী অবস্থাকে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ করার সম্ভাবনাটুকুও তার কাছে রয়েছে।
কিন্তু ড. ইউনূস এও ভাবছেন, কেন বিদেশি সাংবাদিকরা বার বার জানতে চাইছে, তার সময়ে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের আশঙ্কা আছে কিনা। এ শঙ্কা নিশ্চয়ই পশ্চিমের। কিন্তু বিদেশের জমিনে ফুরফুরে হাওয়া তো বাংলাদেশের মাটিতে এখন বইছে না। সরকারের নির্বীয়তায় তারা হতাশ হচ্ছে। জিনিসপত্রের দামে ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং জনমনে ক্ষোভ তো তিনি ঠেকাতে পারছেন না। আওয়ামী সিন্ডিকেট তো এখন বিরোধীদলীয় সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছেই। লুটপাট বা তদ্বির বাণিজ্য কি বন্ধ হয়েছে? গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা মনে হচ্ছে সরকার ফেলে দেয়ার মধ্যে আটকে আছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের আযান দিচ্ছে। কিন্তু তারা এই হাইফেন বা মধ্যবর্তী সরকারকে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা দ্রব্যমূল্য সামাল দেয়ার কাজে সহযোগিতা করছে না। বিএনপি ও জামায়াত ব্যস্ত তাদের সমর্থক আমলাদের ভালো পদায়নের তদবিরে। অবশ্য পুলিশ ছাড়া বাকিগুলোতে জামায়াত এগিয়ে। ছাত্র সমন্বয়করাই রাজপথে নানা আন্দোলনের বা চক্রান্তমূলক তৎপরতার মোকাবিলা করছেন। খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, পুলিশ সেভাবে কাজ করছে না। সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ মাঠে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সশস্ত্র বাহিনী ইউনূস সরকারের প্রতি অনুগত। কিন্তু তাদেরও আলাদা ভাবনা থাকতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানান আলোচনা আছে। তার উপর বিএনপি’র সমর্থক ভোগী রাষ্ট্রপতির নীরবতাও জল্পনা আছে। বলতে দ্বিধা নেই, ড. ইউনূস রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা সন্দেহে বিদ্ধ হয়ে পড়েছেন। অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব চাইছে ড. ইউনূস তাদের হয়ে উঠুক। তাদের রাজনৈতিক দল গঠন করা নিয়ে ড. ইউনূস সমর্থন করলেও তিনি রাজনীতি করবেন না- এটা নিশ্চিত। কিন্তু মধ্যবর্তী সরকারের রাজনীতিতে যোগ দেয়া বা সরকারের কোলে থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টার পর্ব থেকে তিনি কতখানি দূরে থাকতে পারবেন?
উপদেষ্টারা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন না। যা কিছু বলার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবই বলছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ দিয়ে বিএনপি তাকে ব্যস্ত রেখেছে। বিএনপিও চাইছে ইউনূস তাদের সম্ভাব্য ভোট বিজয়ের সারথি হোন। ছাত্র নেতৃত্ব ও বিএনপি’র মধ্যে রাজনৈতিক কাইজ্যায় জামায়াত চতুর নিরপেক্ষতার আশ্রয় নিয়েছে, যদিও তাদের মন-মগজ ছাত্রদের দিকে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা ড. ইউনূস কতগুলো দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন। একদিকে সরকারের সংস্কার সাধনের প্রতিজ্ঞা অন্যদিকে তা শ্লথ করার জন্য রাজনীতিকদের ঠোঁট টেপা হাসি। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য ছাত্র-জনতার আকুতির বিপরীতে প্রচলিত রাজনীতিকদের অদৃশ্যমান অনীহা। অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিলম্বিতকরণের পদক্ষেপ তার প্রমাণ। আরেক দ্বন্দ্বের কথা আগেই বলেছি, সামষ্টিক অর্থনীতির ‘মন্দ নয়’ যাত্রার বিপরীতে ব্যক্তি অর্থনীতির দুর্বিষহ পাগলাটে আচরণ। আওয়ামী লীগের আবার মাঠে নামার চক্রান্তও ’৭২-র সংবিধানের প্রতি বিএনপি’র এক ধরনের সমর্থন আরেকটা অশান্তির জানান দিচ্ছে। রাজনীতি সচেতন মহলে এমন কানাঘুষা আছে যে ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের মতোই সরকার পরিচালনা বা নির্বাচনী রোড ম্যাপ অথবা পরবর্তী সরকারের যারা আসীন হতে পারে- যে সব বিষয়ে ড. ইউনূসের চিন্তা-ভাবনার সম-অংশী নন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ধরনের নীতি। অন্যদিকে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার নীতিতে বিপ্লবের অন্তরালে ছাত্রশিবির ঘেঁষাদের প্রভাব লক্ষণীয়। এই দুই দৈনিকের নীতি দ্বন্দ্ব যা, উপদেষ্টা পরিষদের নেপথ্য-বিভক্তি তেমন। উপদেষ্টাদের বেশির ভাগ দ্বিতীয় মতকে সামনে রেখেই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। তাদের নেপথ্যে জামায়াতের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। সদ্য অনুষ্ঠিত ফ্রান্স অলিম্পিকের একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের আমলে বাংলাদেশের মেয়েরা উগ্রবাদীদের জন্য খেলতে পারছে না। বিষয়টি অস্বাভাবিক নয় কি? বাকি উপদেষ্টারা কেউ একক ভূমিকায় অথবা বিএনপি’র প্রতি সহানুভূতিশীল। আরও শোনা যায়, উপদেষ্টাদের কাজকর্মে কিছুটা হতাশ ড. ইউনূস তার সরকারকে গতিশীল করতে উপদেষ্টামণ্ডলীর পরিসর বাড়াতে চাইছেন। এক ধরনের জাতীয় চেহারায় তিনি সরকারকে দিতে চান। কিন্তু তাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। আর রাজনৈতিক চাপের কাছেও তিনি অসহায় হয়ে পড়ছেন। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলো কতখানি মানবে, জুলাই ঘোষণাপত্র কীভাবে প্রণীত হবে, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ পরবর্তী পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এবং আওয়ামী লীগ বা তার পেছনের ভারতের নেপথ্য ভূমিকা কী হবে-এসব নানা বিষয়ে অদূর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চেহারা সাব্যস্ত হবে। পরিস্থিতি হয়তো বা ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণের আরও বাইরে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এখনো ড. ইউনূসকে বাস্তবোচিত, সাহসী ও প্রজ্ঞামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এনজিও-প্রশাসক থেকে সরকারের নির্বাহী প্রধানের চেতনাগত দূরত্ব যতখানি, ড. ইউনূসেরও তাই। কিন্তু বিশ্ব চেতনায় সমৃদ্ধ এবং বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দরদী ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কবি নজরুলের পঙ্ক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক- ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কাণ্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।’ ড. ইউনূস আরও বেশি সুখ্যাতির জন্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দায়িত্ব নিয়েছেন, এমনটি মানুষ বিশ্বাস করে না। সুখ্যাতির জন্য সৎকর্ম করা মহান আল্লাহ্র পছন্দ নয়। একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টিই সৎকর্মের লক্ষ্য। বিশ্বের নীতি পরিচালকদের আরও প্রশংসা অর্জন নিশ্চয়ই তার লক্ষ্য নয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, অন্যের স্তুতি পেতে যারা সৎকর্ম করে, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্ তাকে বলবেন, তাহলে ওদের কাছেই যাও। সূত্র : মানবজমিন।