নিউইয়র্ক ১১:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আমার দেখা জগলুল আহমেদ চৌধুরী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৪৫:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪
  • / ৭৩১ বার পঠিত

নিনি ওয়াহেদ: বাস থেকে পড়ে শেষ বিদায় নিলেন খ্যাতনামা সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী, কী ভয়ংকর এক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হল তাঁকে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। চলমান পৃথিবীও বোধ হয় এমন ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় দুঃসহ বেদনার ভারে। অবাক বিস্ময়ে বলতে হয় যখন দেখি গণমানুষের ব্যবহৃত বাহন বাসে চলাচল করতেন তিনি। ব্যক্তিগত গাড়ি তার ছিল; গাড়ির চালকও। তদুপরি এই মানুষটি বাহন হিসেবে বাস ব্যবহারে কোন কুন্ঠা বোধ করেননি। আভিজাত্যবোধের দোহাই তোলেননি। বাসে চড়তে তার কোন দীনতা-হীনতা ছিল না। যা তাঁর শ্রেণীভুক্ত সমাজের মানুষের মাঝে সদা বিরাজমান। তাঁর অবস্থানে দাঁড়িয়ে কেউ বাস ব্যবহার বা বাসের যাত্রী হতে পারেন তা অকল্পনীয়, অবাস্তব ও অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন জগলুল আহমেদ চৌধুরী। আমাদের সবার প্রিয় জগলুল ভাই।
এক কথায় তিনি পরিপূর্ণ একজন ভদ্রলোক। সজ্জন ও শোভন শব্দগুলো তাঁর জন্য সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিক জগতের সকলের কাছেই ছিল তাঁর বিপুল গ্রহনযোগ্যতা।
ষাট এর দশকের শেষ দিকে জগলুল আহমেদ দি পিপল এ যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এ একজন রিপোর্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কখনই নিবিড় ছিল না। বরং বলা চলে সেই অর্থে দূরত্বই ছিল খানিকটা। কিন্তু কী আশ্চর্য যে, কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা বহু দূরে অবস্থান করলেও কখনও কখনও হয়ে উঠেন খুব কাছের মানুষ। আমার ক্ষেত্রে জগলুল আহমেদ ছিলেন তেমনটি।
আপদমস্তক একজন পেশাজীবি সাংবাদিক। সাংবাদিকদের কোন ফোরামভুক্ত ছিলেন না তিনি। একটি জীবন দর্শনে গভীরভাবে বিশ্বাসী হয়েও সংবাদ পরিবেশনে তাঁর কোন প্রতিফলন ছিল না। এব্যাপারে তিনি ছিলেন সতর্ক ও সচেতন।
বাসস’র জুনিয়র রিপোর্টার থেকে নিজের মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি এক সময় বাসস’র প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে আসীন হন।
juglul-ahmedজগলুল আহমেদের রয়েছে এক বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবন। বাসস থেকে তিনি দিল্লী প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। অচিরেই তিনি দিল্লীর সাংবাদিকদের বন্ধুতে পরিণত হন। শুধু সাংবাদিক জগতই নয়, দিল্লীর কুটনৈতিক মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন দক্ষ কুটনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিক হিসেবে। তারই এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অনুজপ্রতিম সাংবাদিক শফিকুল করিম সাবু বলেন, দীর্ঘ বছর পর দিল্লীতে বাসস’র প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে গিয়ে জগলুল আহমেদ সম্পর্কে দিল্লীর সাংবাদিকদের উচ্চ ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গী ও আগ্রহ তাকে বিস্মিত করেছে।
ইংরেজী ও বাংলা দু’ভাষাতেই সমান পারদর্শী জগলুল আহমেদ লিখেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ে অসংখ্য কলাম। একজন সুদক্ষ ও সুনিপুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল সর্বমহলে। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গেও জগলুল আহমেদ ছিলেন সমানতালে যুক্ত। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’, ‘টাইম’ ম্যাগাজিন, আমেরিকার ‘এবিসি নিউজ’, কাতার নিউজ এজেন্সি, জাপানের নিউজ এজেন্সিসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন।
খ্যাতিমান এই সাংবাদিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আলাপ হয় বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থানকারী আমার সহকর্মী ও প্রিয় মানুষ নাসিমুন আরা হকের সঙ্গে। তিনি জগলুল আহমেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা যেমন বলেন তেমনি তাঁর জীবনাচারণের সহজ ও সরল দিকটিও তুলে ধরেন।
জগলুল আহমেদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী রাশেদা আমিন চৌধুরী তার কষ্টের অংশীদার করতে টরন্টো থেকে জানান যে, বছর তিন চার আগে তিনি একদিন দেখেন জগলুল আহমেদ বাস থেকে নেমে রাস্তা পাড় হয়ে ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করছেন। রাশেদা আমিনের মন্তব্য তিনি ঢাকার বেশ কয়েকটি অভিজাত ক্লাবের সদস্য ছিলেন, কিন্তু সেসব জায়গায় গাড়ী ছাড়া যাওয়া যায় না এমন মনোভাব তাঁকে কখনও পেয়ে বসেনি। পেশার প্রতি দায়িত্ববোধ, অঙ্গীকার ও সত্যনিষ্ঠার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তাঁর দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী রাশেদা আমিন।
রাশেদা আমিনের সাথে আলাপকালে স্মরণে স্মৃতিবিধুরতা এসে ভর করে। আসে টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা। মনে পড়ে যায় ‘ইত্তেফাক’ এর এক সময়ের অর্থনৈতিক রিপোর্টার জাহিদুজ্জামান ফারুকের কথা।
একদিন প্রেসক্লাবের পুরোনো ভবনের ক্যান্টিনের টেবিলে বসা দৈনিক বাংলার হিরু ভাই, জগলুল আহমেদ, আমি ও আর কেউ একজন ছিলেন নাম মনে করতে পারছি না। এমনি সময় সেখানে হাজির জাহিদুজ্জামান ফারুক। তাঁকে কখনই সুদর্শন পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে ভুল হল না তাঁর। জগলুল আহমেদ মুচকি হেসে বললেন, ফারুক তাহলে আমার তো কোন আশাই নেই। সবাই মিলে এক পশলা হাসিতে মেতে ওঠা।
১৯৭৭ সালে পূর্ব জার্মানী থেকে ফিরেছি একটি কোর্স শেষে। প্রেস ক্লাবে ঢুকেই আমার টেবিলে এসে কোর্স সম্পর্কে খুঁটিনাটি কত কিছু জেনে নিলেন যেমন, প্রশংসাও করলেন মনখুলে। এই কোর্সে আমার সঙ্গেঁ ছিলেন জগলুল আহমেদের সহকর্মী রাশেদা আমিন চৌধুরী।
নব্বই দশকের কোন এক সময়ে জগলুল আহমেদ নিউ ইয়র্কের তৎকালীন ‘প্রবাসী’ অফিসে আসেন ইকবাল বাহার চৌধুরীর সঙ্গেঁ (সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই)। আমাকে দেখে তাঁর ছোট মন্তব্য ছিল এখানে কেন আছেন? দেশে ফিরে চলেন। ছোট্ট মন্তব্যের গভীর অনুভূতি আজও স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে।
উদার মনের এই মানুষটির ভাবের জগত জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের বসবাস। প্রায়শই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর গুনগুনিয়ে উঠতো তাঁর কন্ঠে। তাঁর স্ত্রী একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
পোলাও, রোষ্ট, বিরিয়ানী, খাসির রেজালা, ডালপুরীর মতো খাবারগুলো ছিল তাঁর পছন্দের তালিকার শীর্ষে। মুখরোচক খাবারের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা জানার পর থেকে তিনি সব সময় বলতেন, দু’টি বিষয়ে নিনির সঙ্গে মিল আছে, একটি খাবার অন্যটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।
যে ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই তা হল কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল ছিলেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী। কন্যা সেমন্তীর অনুষ্ঠান ছাড়াও দু’তিনবার যাওয়া হয়েছে সেখানে। দেখাও হয়েছে সাব্বির আহমেদের সঙ্গে, তবে পরিচয় ঘটেনি সেই অর্থে। হওয়ার অবশ্য কথাও নয়। কিছুদিন পর সাব্বির আহমেদের একটি ফোন পেলাম। তিনি দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন এবং তাঁর এক আত্মীয় আমার সঙ্গে পরিচিত হতে বলেছেন তাঁকে। বিস্ময়ভরা কন্ঠে জানতে চাইলাম, তাঁর আত্মীয়র পরিচয়। জানলাম, তিনি আর কেউ নন, জগলুল আহমেদ চৌধুরী। বললাম, জগলুল আহমেদ চৌধুরী একজন সুন্দর মনের মানুষ এবং আমার খুব প্রিয়জন। একই অভিমত তাঁর আপনার সম্পর্কেও, জানালেন সাব্বির আহমেদ।
লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে, অনেক সময় দূরের মানুষও খুব কাছের মানুষ হয়ে যায় কখনও কখনও। পরিণত হয় আত্মার আত্মীয়তে। জগলুল ভাই আমার কাছে ঠিক তেমন একজন মানুষ। জগলুল ভাই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

আমার দেখা জগলুল আহমেদ চৌধুরী

প্রকাশের সময় : ০৭:৪৫:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

নিনি ওয়াহেদ: বাস থেকে পড়ে শেষ বিদায় নিলেন খ্যাতনামা সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী, কী ভয়ংকর এক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হল তাঁকে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। চলমান পৃথিবীও বোধ হয় এমন ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় দুঃসহ বেদনার ভারে। অবাক বিস্ময়ে বলতে হয় যখন দেখি গণমানুষের ব্যবহৃত বাহন বাসে চলাচল করতেন তিনি। ব্যক্তিগত গাড়ি তার ছিল; গাড়ির চালকও। তদুপরি এই মানুষটি বাহন হিসেবে বাস ব্যবহারে কোন কুন্ঠা বোধ করেননি। আভিজাত্যবোধের দোহাই তোলেননি। বাসে চড়তে তার কোন দীনতা-হীনতা ছিল না। যা তাঁর শ্রেণীভুক্ত সমাজের মানুষের মাঝে সদা বিরাজমান। তাঁর অবস্থানে দাঁড়িয়ে কেউ বাস ব্যবহার বা বাসের যাত্রী হতে পারেন তা অকল্পনীয়, অবাস্তব ও অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন জগলুল আহমেদ চৌধুরী। আমাদের সবার প্রিয় জগলুল ভাই।
এক কথায় তিনি পরিপূর্ণ একজন ভদ্রলোক। সজ্জন ও শোভন শব্দগুলো তাঁর জন্য সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিক জগতের সকলের কাছেই ছিল তাঁর বিপুল গ্রহনযোগ্যতা।
ষাট এর দশকের শেষ দিকে জগলুল আহমেদ দি পিপল এ যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এ একজন রিপোর্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কখনই নিবিড় ছিল না। বরং বলা চলে সেই অর্থে দূরত্বই ছিল খানিকটা। কিন্তু কী আশ্চর্য যে, কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা বহু দূরে অবস্থান করলেও কখনও কখনও হয়ে উঠেন খুব কাছের মানুষ। আমার ক্ষেত্রে জগলুল আহমেদ ছিলেন তেমনটি।
আপদমস্তক একজন পেশাজীবি সাংবাদিক। সাংবাদিকদের কোন ফোরামভুক্ত ছিলেন না তিনি। একটি জীবন দর্শনে গভীরভাবে বিশ্বাসী হয়েও সংবাদ পরিবেশনে তাঁর কোন প্রতিফলন ছিল না। এব্যাপারে তিনি ছিলেন সতর্ক ও সচেতন।
বাসস’র জুনিয়র রিপোর্টার থেকে নিজের মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি এক সময় বাসস’র প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে আসীন হন।
juglul-ahmedজগলুল আহমেদের রয়েছে এক বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবন। বাসস থেকে তিনি দিল্লী প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। অচিরেই তিনি দিল্লীর সাংবাদিকদের বন্ধুতে পরিণত হন। শুধু সাংবাদিক জগতই নয়, দিল্লীর কুটনৈতিক মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন দক্ষ কুটনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিক হিসেবে। তারই এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অনুজপ্রতিম সাংবাদিক শফিকুল করিম সাবু বলেন, দীর্ঘ বছর পর দিল্লীতে বাসস’র প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে গিয়ে জগলুল আহমেদ সম্পর্কে দিল্লীর সাংবাদিকদের উচ্চ ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গী ও আগ্রহ তাকে বিস্মিত করেছে।
ইংরেজী ও বাংলা দু’ভাষাতেই সমান পারদর্শী জগলুল আহমেদ লিখেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ে অসংখ্য কলাম। একজন সুদক্ষ ও সুনিপুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল সর্বমহলে। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গেও জগলুল আহমেদ ছিলেন সমানতালে যুক্ত। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’, ‘টাইম’ ম্যাগাজিন, আমেরিকার ‘এবিসি নিউজ’, কাতার নিউজ এজেন্সি, জাপানের নিউজ এজেন্সিসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন।
খ্যাতিমান এই সাংবাদিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আলাপ হয় বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থানকারী আমার সহকর্মী ও প্রিয় মানুষ নাসিমুন আরা হকের সঙ্গে। তিনি জগলুল আহমেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা যেমন বলেন তেমনি তাঁর জীবনাচারণের সহজ ও সরল দিকটিও তুলে ধরেন।
জগলুল আহমেদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী রাশেদা আমিন চৌধুরী তার কষ্টের অংশীদার করতে টরন্টো থেকে জানান যে, বছর তিন চার আগে তিনি একদিন দেখেন জগলুল আহমেদ বাস থেকে নেমে রাস্তা পাড় হয়ে ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করছেন। রাশেদা আমিনের মন্তব্য তিনি ঢাকার বেশ কয়েকটি অভিজাত ক্লাবের সদস্য ছিলেন, কিন্তু সেসব জায়গায় গাড়ী ছাড়া যাওয়া যায় না এমন মনোভাব তাঁকে কখনও পেয়ে বসেনি। পেশার প্রতি দায়িত্ববোধ, অঙ্গীকার ও সত্যনিষ্ঠার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তাঁর দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী রাশেদা আমিন।
রাশেদা আমিনের সাথে আলাপকালে স্মরণে স্মৃতিবিধুরতা এসে ভর করে। আসে টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা। মনে পড়ে যায় ‘ইত্তেফাক’ এর এক সময়ের অর্থনৈতিক রিপোর্টার জাহিদুজ্জামান ফারুকের কথা।
একদিন প্রেসক্লাবের পুরোনো ভবনের ক্যান্টিনের টেবিলে বসা দৈনিক বাংলার হিরু ভাই, জগলুল আহমেদ, আমি ও আর কেউ একজন ছিলেন নাম মনে করতে পারছি না। এমনি সময় সেখানে হাজির জাহিদুজ্জামান ফারুক। তাঁকে কখনই সুদর্শন পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে ভুল হল না তাঁর। জগলুল আহমেদ মুচকি হেসে বললেন, ফারুক তাহলে আমার তো কোন আশাই নেই। সবাই মিলে এক পশলা হাসিতে মেতে ওঠা।
১৯৭৭ সালে পূর্ব জার্মানী থেকে ফিরেছি একটি কোর্স শেষে। প্রেস ক্লাবে ঢুকেই আমার টেবিলে এসে কোর্স সম্পর্কে খুঁটিনাটি কত কিছু জেনে নিলেন যেমন, প্রশংসাও করলেন মনখুলে। এই কোর্সে আমার সঙ্গেঁ ছিলেন জগলুল আহমেদের সহকর্মী রাশেদা আমিন চৌধুরী।
নব্বই দশকের কোন এক সময়ে জগলুল আহমেদ নিউ ইয়র্কের তৎকালীন ‘প্রবাসী’ অফিসে আসেন ইকবাল বাহার চৌধুরীর সঙ্গেঁ (সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই)। আমাকে দেখে তাঁর ছোট মন্তব্য ছিল এখানে কেন আছেন? দেশে ফিরে চলেন। ছোট্ট মন্তব্যের গভীর অনুভূতি আজও স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে।
উদার মনের এই মানুষটির ভাবের জগত জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের বসবাস। প্রায়শই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর গুনগুনিয়ে উঠতো তাঁর কন্ঠে। তাঁর স্ত্রী একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
পোলাও, রোষ্ট, বিরিয়ানী, খাসির রেজালা, ডালপুরীর মতো খাবারগুলো ছিল তাঁর পছন্দের তালিকার শীর্ষে। মুখরোচক খাবারের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা জানার পর থেকে তিনি সব সময় বলতেন, দু’টি বিষয়ে নিনির সঙ্গে মিল আছে, একটি খাবার অন্যটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।
যে ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই তা হল কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল ছিলেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী। কন্যা সেমন্তীর অনুষ্ঠান ছাড়াও দু’তিনবার যাওয়া হয়েছে সেখানে। দেখাও হয়েছে সাব্বির আহমেদের সঙ্গে, তবে পরিচয় ঘটেনি সেই অর্থে। হওয়ার অবশ্য কথাও নয়। কিছুদিন পর সাব্বির আহমেদের একটি ফোন পেলাম। তিনি দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন এবং তাঁর এক আত্মীয় আমার সঙ্গে পরিচিত হতে বলেছেন তাঁকে। বিস্ময়ভরা কন্ঠে জানতে চাইলাম, তাঁর আত্মীয়র পরিচয়। জানলাম, তিনি আর কেউ নন, জগলুল আহমেদ চৌধুরী। বললাম, জগলুল আহমেদ চৌধুরী একজন সুন্দর মনের মানুষ এবং আমার খুব প্রিয়জন। একই অভিমত তাঁর আপনার সম্পর্কেও, জানালেন সাব্বির আহমেদ।
লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে, অনেক সময় দূরের মানুষও খুব কাছের মানুষ হয়ে যায় কখনও কখনও। পরিণত হয় আত্মার আত্মীয়তে। জগলুল ভাই আমার কাছে ঠিক তেমন একজন মানুষ। জগলুল ভাই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)