বাংলাদেশ আইএফআইসি
আন্তর্জাতিক ব্যাংক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পতিত

- প্রকাশের সময় : ০৫:২৬:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৬৫ বার পঠিত
দেশে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে প্রথম বিনিয়োগ কোম্পানি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স’ বা আইএফআইসি লিমিটেড। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগ কোম্পানিটির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশী বিনিয়োগকে বৈশ্বিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া। লক্ষ্য বাস্তবায়নে শুরুর দিকে বেশ তৎপর ছিল কোম্পানিটি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত ও পতিত হয়ে পড়ে আইএফআইসি।
বিনিয়োগ কোম্পানি আইএফআইসির হাত ধরে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ব্যাংক অব মালদ্বীপ লিমিটেড’। এটি ছিল মালদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাতীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানার ৪০ শতাংশ ইকুইটির জোগান দিয়েছিল আইএফআইসি। মালদ্বীপের ওই ব্যাংকটির পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও ছিল আইএফআইসির হাতে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া আইএফআইসির কর্মকর্তারা এশিয়ার দ্বীপদেশটির মানুষকে ব্যাংকিং শিখিয়েছে। যদিও সময়ের পরিক্রমায় ব্যাংকটির মালিকানা থেকে আইএফআইসি ছিটকে পড়েছে। আর ‘ব্যাংক অব মালদ্বীপ লিমিটেড’ এখন দেশটির সেরা ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
বিনিয়োগ কোম্পানি আইএফআইসিকে ১৯৮৩ সালের ২৪ জুন পূর্ণাঙ্গ তফসিলি ব্যাংকে রূপান্তর করে সরকার। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তা জহুরুল ইসলাম। বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তরের পরও বৈশ্বিক রূপ পাওয়ার চেষ্টা ছিল আইএফআইসির। ১৯৮৫ সালে দেশের এ ব্যাংকটির হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ওমান বাংলাদেশ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’। এরপর ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের করাচি ও লাহোরে শাখা খোলে ব্যাংকটি। আর ১৯৯৪ সালে নেপালে ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড’ ও ১৯৯৯ সালে ‘নেপাল বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং কোম্পানি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা ছিল আইএফআইসি ব্যাংকের বৈশ্বিক যাত্রারই নির্দেশক।
নব্বইয়ের দশকের শেষদিক থেকেই পথ হারাতে শুরু করে আইএফআইসি ব্যাংক। ওই সময় থেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অলিগার্কদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। যখন যে দল ক্ষমতায় যাচ্ছে, তখন সে দলের সুবিধাভোগীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ দখলে নিচ্ছেন। দেশের পুঁজিবাজারে শেয়ারদরের কারসাজিতেও আইএফআইসি ব্যাংক জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। গত দেড় দশকে ব্যাংকটিতে জমাকৃত গ্রাহকদের আমানতের একটি অংশ ঋণের নমে লুণ্ঠিত হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান আইএফআইসি ব্যাংক পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই দশক ছিল আইএফআইসির স্বর্ণালি সময়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির অভিমুখ ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে। কিন্তু পরে এসে ক্রমেই অন্যান্য দেশী ব্যাংকের চরিত্র ধারণ করেছে। এক সময় ব্যাংকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করছিলেন দেশের ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা। যদিও সে সুযোগ হারিয়ে ব্যাংকটি এখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। গত দেড় দশকের অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের শিকার হয়ে আইএফআইসি ব্যাংক এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে, তার অন্যতম আইএফআইসি। ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ্য অনুযায়ী আইএফআইসি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথেই এগোচ্ছিল। কিন্তু পরে সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। ১৫ বছর ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আইএফআইসি ব্যাংকের প্রায় ৩৩ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা সরকারের। সে হিসাবে ব্যাংকটি পরিচালনায় সরকারের আধিপত্য থাকার কথা বেশি। কিন্তু আমরা সেটি দেখিনি। ব্যাংকটির পর্ষদে সরকারের নিয়োগকৃত তিন-চারজন পরিচালক থাকেন। তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখলে ব্যাংকটি পথ হারাতো না।’
মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইএফআইসির পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সবচেয়ে সহজ। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ব্যাংকের ৩-৪ শতাংশ শেয়ার কিনেই পর্ষদে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে পর্ষদে আমলাদের পাঠানো হয়। তারা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে চান না। এ কারণে চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকরা সহজেই এ ব্যাংকের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারেন। বছরের পর বছর চলতে থাকা এ অনৈতিক চর্চার ধারাবাহিকতা ভেঙে দেয়ার সময় এসেছে। এ ব্যাংকের পর্ষদ গঠনের প্রক্রিয়ায় ঢেলে সাজানো দরকার। সরকারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে ব্যাংকটি সুশাসনের রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য হবে।’
তফসিলি ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় আইএফআইসি। ব্যাংকটির মোট শেয়ার সংখ্যা এখন ১৯২ কোটি ২০ লাখ ৮৬ হাজার ৬৪৮। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ৩০ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, আইএফআইসি ব্যাংকের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল সরকারের। আর ২১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ শেয়ার ছিল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। বৃহস্পতিবার আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ৭ টাকা। যদিও ব্যাংকটির শেয়ারের অভিহিত মূল্যই ১০ টাকা। শেয়ারমূল্যের মতো ব্যাংকটির লভ্যাংশ ঘোষণার পরিস্থিতিও নাজুক। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয় আইএফআইসি। এর আগের বছর তথা ২০২২ সালে আড়াই শতাংশ নগদ ও আড়াই শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছিল।
আইএফআইসির বৈশ্বিক বিনিয়োগ কয়েক বছরে না বেড়ে উল্টো সংকুচিত হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেয় আইএফআইসি ব্যাংক। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল আইএফআইসির হাতে। বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন নেপালের কয়েকজন উদ্যোক্তা। ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই শেয়ার শারিকা চৌধুরী নামে এক নেপালির কাছে ৪৪১ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। তবে বিক্রি করা শেয়ারের পুরো অর্থ আইএফআইসি ব্যাংক এখনো বুঝে পায়নি বলে জানা গেছে।
আইএফআইসির বিদেশে বিনিয়োগের মধ্যে বর্তমানে কেবল নেপালের নাবিল ব্যাংক লিমিটেড ও পাকিস্তানের এমসিবি ব্যাংক লিমিটেডে কিছু শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে এমসিবি ব্যাংকের শেয়ার ১ শতাংশেরও কম। যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ওমান এক্সচেঞ্জ এলএলসিতে ব্যাংকটির ২৫ শতাংশ শেয়ার আছে। আর যুক্তরাজ্যে আইএফআইসির মালিকানাধীন একটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। পাকিস্তানের করাচি ও লাহোরে যে দুটি শাখা খোলা হয়েছিল, সেগুলো একীভূত করে ২০০৩ সালে এনডিএলসি-আইএফআইসি ব্যাংক গঠন করা হয়। ব্যাংকটি পরে এমসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
আইএফআইসি ব্যাংকের পাকিস্তানের করাচি ও লাহোর শাখায় কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মতিউল হাসানের। তিনি সম্প্রতি মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে দায়িত্ব নিয়েছেন। আইএফআইসিতে কাজ করার স্মৃতিচারণ করে মতিউল হাসান বলেন, ‘১৯৮৪ সালে আমি আইএফআইসি ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগদান করি। সেটি ছিল ব্যাংকটির স্বর্ণালি সময়। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে শাখা খোলা হলে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়। এরপর ব্যাংকটির লাহোর শাখায়ও কাজ করেছি। নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল আমার। আইএফআইসি যদি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেত, তাহলে বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারত।’
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিশ্বের বহু দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভারতের কিছু ব্যাংকও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমাদের আন্তর্জাতিক মানের কোনো ব্যাংক তৈরি হয়নি। এটি আমাদের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের জন্য দুঃখজনক।’
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আইএফআইসি ব্যাংকের মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকটিতে ৪৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। বিপরীতে ৪৪ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। এ ঋণের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি ১ হাজার ৩০৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে। আর চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে আইএফআইসির অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পর্ষদ পুনর্গঠনের পর আইএফআইসি ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ব্যাংক কর্তৃপক্ষও নতুন করে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নিরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেনামি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে সালমান এফ রহমান আইএফআইসি থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। এসব ঋণের বিপরীতে তেমন কোনো জামানত নেই। ঋণগুলো এখনো খেলাপি না হলেও আগামী বছরের জুনের মধ্যেই খেলাপি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বেনামি ঋণগুলো খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশে ঠেকবে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘আইএফআইসি ব্যাংকের আগের কিছু পরিচালক এখন নতুন করে ব্যাংকটির পর্ষদে যুক্ত হতে চাইছেন। তাদের কেউ কেউ গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে দাবিও জানিয়েছেন। এমনিতেই ব্যাংকটির পরিস্থিতি নাজুক। এ অবস্থায় অসৎ লোকেরা আবারো পর্ষদে ঢুকলে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হবে।’ সূত্র : বণিক বার্তা।