শেখ হাসিনার পতনের যত কারণ
- প্রকাশের সময় : ১২:৪৫:৪৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪
- / ১২৫ বার পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বাংলাদেশের। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছে চরম ক্ষমতাধর শেখ হাসিনার। অনেক দিন ধরে কিছু একটা লিখবো বলে ভাবছিলাম কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না কোনোভাবেই। কখন যে আবার কার বিরাগভাজন হয়ে যাই, কে জানে? আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে আমার বেশ সরব উপস্থিতি থাকলেও বন্ধুরা প্রায়ই খোঁচায় আমি কেন চুপ এখন। যেহেতু আমি একজন শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাই তাড়াহুড়ো করে কোনো মন্তব্য করা যে সমীচীন হবে না এটা আমি বুঝি। যাই হোক শেষমেষ লিখেই ফেললাম সাত পাঁচ না ভেবেই শেখ হাসিনার পতনের চূড়ান্ত খতিয়ান।
এখন মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছে শেখ হাসিনা কেন এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন? কী কী অপরাধ তিনি করেছেন যার দরুণ তাকে এই শাস্তি পেতে হলো। এক-দুই করে তা লিখতে গেলে, প্রথম কারণ হবে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। অনেক দিন ধরেই কারও কোনো পরামর্শ তিনি শুনতেন না। তার সম্পর্কে এমনও শোনা যেতো গাছের পাতাও নাকি তার ইশারা ছাড়া নড়তো না। নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন প্রশাসনকে।
তিনিই ছিলেন নাকি সবকিছুর অধিকর্তা। রাস্তার ড্রেনেজের স্লাব মেরামত হোক কিংবা মন্ত্রণালয়ের হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের অনুমোদনই হোক তিনি ছিলেন সবার শেষ কথা।
দ্বিতীয় কারণ হলো নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে গণতন্ত্রের কফিনের শেষ পেরেক গেঁথে দেয়া। বিরোধী দল ও ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচন দিয়ে তিনি পেয়েছেন গণতন্ত্র হত্যাকারীর তকমা। যদিও প্রচার মাধ্যমে বিশ্বকে তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন তিনিই হলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি অন্ধ অনুগত আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করে রেখেছিলেন। বানিয়েছিলেন নির্লিপ্ত, অকার্যকর ও দলদাসে।
তৃতীয়, বিচার বিভাগকে নিজের ও দলের সুবিধামতো পরিচালনা করা। চতুর্থ, আইনের শাসনের অবলুপ্তি ঘটানো। পঞ্চম, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধে চরম ব্যর্থতা, যার দরুন সর্বত্র হাহাকার সৃষ্টি হওয়া। ষষ্ঠ, ছাত্রলীগের অতি সক্রিয়তা ও অবাধ্য রাজনীতি। সপ্তম, আর্থিক খাতে চরম লুটপাট। ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজারকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুণ্ঠনরাজ ও বড় বড় লুণ্ঠনকারী (আর্থিক দেউলিয়া) সৃষ্টি করা।
অষ্টম, সংখ্যালঘুর সুরক্ষার নামে তাদের জমি, বাড়ি ও ঘর দখল নেয়া। আর শারদীয় দুর্গাপূজা আসলে অনুভূতি সন্ত্রাসের নামে সংখ্যালঘুদের পাশবিক নির্যাতন করা। জনমনে বিভেদ ও রাজনৈতিক ধুম্রজাল তৈরি করে প্রকাশ করা যে, হিন্দু মানে আওয়ামী লীগের সমর্থক। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আওয়ামী লীগের শাসনকালে হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। বরং হিন্দুদের ব্যবহার করে অপকৌশলে ছিনিয়ে নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।
নবম, নেতা মন্ত্রীদের বেফাস ও আলটপ্পা মন্তব্য। সঙ্গে কুকথার রাজনীতির মিশ্রণ করে প্রচ্ছন্ন হুমকি ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব বিস্তার। এসব বে-লাগাম কুট মন্তব্যে জনগণ অত্যন্ত বিরক্ত ছিল। গুজবের মতো সস্তা রাজনৈতিক কৌশল ও নেতাদের রাশভারি শব্দ চয়ন ও ছিল পুরো দলকে খাদের কিনারায় টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
শেষ কারণ হলো দুর্নীতির বহরে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর সংযুক্তি। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো তথ্য আসবে পরিসংখ্যান ঘাটলে। রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হবে। ছোটবেলায় ‘পুকুর চুরি’-র অর্থ জেনেছিলাম, গত ১৫ বছর ধরে তা দেখেছি সযত্নে। সমাজের মাথা যারা, সেসব রাঘব বোয়াল খাল-বিল, নদী, সাগর, পাহাড়, জঙ্গল এমন কি বালি সব হাপিশ করে দিয়েছে গোগ্রাসে। গণমাধ্যমে তাদের নাম শুনলেই কেমন জানি নিঃস্ব মনে হয় নিজেকে। এক-একজনের চুরির বহর হাজার-হাজার কোটি টাকা। আজিজ, বেনজীর কিংবা আবেদ আলীর দুর্নীতির পসরা মগের মুল্লুককেও পরাস্ত করবে। চুরির টাকার বেশিটাই নাকি বিদেশে পাচার করেছে তারা। বছর দুয়েক আগে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, অর্থ পাচার কি করে রোখা যায়? কি করে বিদেশে গচ্ছিত টাকা দেশে ফেরানো যায়, তা তার জানা নেই। এসব দায়িত্ব জ্ঞানহীন বক্তব্যে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে এসব আষাঢ়ে গল্প বলে তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তারা।
সহ্যের সীমা না-পেরোলে নাকি বিপ্লব হয় না। শেখ হাসিনার উপর আপামর সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র-জনতা কতোটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে, এই বিপ্লব তার প্রমাণ। নাহলে শুধু একটা কোটা আন্দোলনে সরকার পড়ে যায়? ছাত্র-জনতার অহিংস আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগে গুলি মেরে প্রাণ কেড়ে নেয়ার বাড়াবাড়ি সহজভাবে নেয়নি জনগণ। তাই তো রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন বিজয় অর্জিত হবে তাদের একদিন। রবীন্দ্রনাথের একটি কথা এখন বেশ মনে পড়ছে আমার। তার ছোট গল্প জীবিত ও মৃতের একটি লাইন ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ আবু সাঈদ মরে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এটা সুনিশ্চিত লক্ষ কোটি বিপ্লবীদের তিনি রসদ জুগিয়েছেন তার এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের ছাত্র-জনতার তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। এই আন্দোলন শুধু এমফিল কিংবা পিএইচডি থিসিসের গবেষণার খোরাক হবে না বরং এটি রচনা করবে গণজাগরণের বীজমন্ত্র। সামনের দিনে আর কোনো শাসক ছাত্রদের উপর আঘাত করতে সাহস করবে না, ভাববে দশবার।
একটি নির্মোহ সত্যি হলো, একদা জনপ্রিয় ও দেশবাসীর ‘চোখের মণি’ শেখ হাসিনা কোনো এক গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে রাতারাতি ‘চোখের বালি’ হয়ে যাননি। তার এই বিবর্তন ঘটেছে ধীরে-ধীরে। এখন যে-বিশ্লেষণে তিনি ভূষিত, প্রবল সমালোচিত ও জনগণের একাংশের কাছে ঘৃণিত, সেই ‘স্বৈরতন্ত্রী’ তকমা পাওয়ার পিছনে ভারতের অবদান কম নয় এটা সবাই বুঝে। ভারত সরকারের প্রবল সহযোগিতায় তার ক্ষমতার চরিত্রটি তিনি পোক্ত করেছেন বেশ দানবীয়ভাবে। তবে এটা ঠিক ভারতের নরেন্দ্র মোদী যদি আগামীবার ক্ষমতায় না আসে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেয়াও একপ্রকার কঠিন হবে তা কি তিনি জানেন?
তার শাসন আমলে একের-পর-এক নির্বাচনকে তিনি প্রহসনে পরিণত করেছেন। ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারত নীরবই শুধু থাকেনি, সমর্থনের ডালি নিয়ে দৃঢ়ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানত এই কারণে গণতন্ত্রপ্রিয় বাংলাদেশের এক বিরাট অংশের কাছে ভারত অ-জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পরপর ৩টি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর ‘বন্ধু’ থেকে ‘শত্রু’-তে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। অগণতন্ত্রী হাসিনার অধঃপতনের দায় ভারত এড়াতে পারে না। এখন সময় এসেছে নতুনভাবে নিজেদের মেলে ধরার। নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করার।
এখন প্রশ্ন শেখ হাসিনা কেন পালালেন? অনেকে বলবে জনরোষে কিংবা গণভবন ঘেরাও এর আশঙ্কায়। তবে এটা ঠিক জনমত যেভাবে তৈরি হয়েছে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো বাহিনী দিয়ে এটি আর দমিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। অন্য একটি কারণ হতে পারে শেখ হাসিনা জানতেন তার বাবার চরম পরিণতির কথা। তাইতো তিনি আর ঝুঁকি নিতে চাননি। ১৫ই আগস্ট এর মতন আরেকটি ইতিহাসের তাইতো তিনি পুনরাবৃত্তি হতে দেননি। গণমাধ্যমে যে খবর এসেছে তার হাতে সময় ছিল মাত্র ৪৫ মিনিট। এত কম সময়ে আসলে তার আর অন্য কিছু করার উপায় ছিল না?
শেখ হাসিনার শাসন আমলে আসলেই কী তিনি কোনো ভালো কাজ করেননি? পদ্মা সেতু হোক, ফ্লাইওভার হোক কিংবা মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি হোক। জনগণ কি ভুলে গেছে এসব? আসলে আন্দোলন দমনের নামে তিনি যে নৈরাজ্য ও রক্তের বন্যার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তার এসব ভালো কাজের ফিরিস্তি তখন আর ধোপে টেকে না হয়ে যায় অমূলক। মানুষ তখন এসব ডিজিটাল উন্নয়নের কথা ভুলে যায় এক নিমেষে। মনে রাখে ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম ও হরিলুটের কথা। অতিরিক্ত ক্ষমতার মোহ ও দম্ভ মানুষকে যে উন্মাদ ও বীভৎস করে তোলে তার প্রমাণ তিনি স্বয়ং নিজে। তিনি চাইলে সবকিছুর একটা সুন্দর পরিসমাপ্তি করতে পারতেন। কিন্তু করলেন না তার কিছু চাটুকার, সুবিধাবাজ ও ধুরন্ধর সহযোগীদের কথায়। তিনি যে ভুল এটা তো এখন প্রমাণিত। তাকে যে অন্ধ করে রাখা হয়েছে এটাও সত্য। যে পাপ করে তাকে তো শাস্তি ভোগ করতেই হবে। প্রাকৃতিক আইন তো এটির হেরফের করে না। ইতিহাস কিন্তু কোনো পাপীকে ক্ষমা করে না। এখন দেখা যাক তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোনদিকে যায়। তিনি পালিয়ে কি রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব কিংবা প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন এটি হয়তো সময়েই বলে দেবে। সূত্র: মানবজমিন।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
vprashantcu@gmail.com