নিউইয়র্কের সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অপরাধের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবী
- প্রকাশের সময় : ০৭:৫৭:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০১৬
- / ৬২১ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: সিটিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বাংলাদেশ অব্যহত আর্থিক দূর্ণীতি, বিভিন্ন বাংকের অর্থ অবাধে লুটপাট এবং দেশ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ বিদেশে পাচারকে বাংলাদেশের জণগনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত এই অপরাধ বন্ধ ও অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান হয়েছে।
সিটির জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে ৩০ সেটেম্বর শুক্রবার ‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস এগেইনস্ট বাংলাদেশ পিপল’ শীর্ষক এই সেমিরারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থপাচার হচ্ছে। অবাধে চলছে ব্যংকের অর্থ লুটপাট, শেয়ার বাজার কারসাজি ও উন্নয়ন প্রকল্পের অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় দেখিয়ে জনগণের সম্পদ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে, জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং-এ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অর্থনৈতিক সুচক নি¤œমুখী, কমছে ব্যবসা-বানিজ্য ও বিনিয়োগ-এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়বে।
সেমিনারে বক্তারা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এই অর্থনৈতিক অপরাধ বিষয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহনযোগ্য কমিশন গঠন, এই অপরাধের বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং অপরাধীদের বিচারে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের জন্য রাষ্ট্রপ্রতির প্রতি উদ্দাত্ত আহবান জানানো হয়।
‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস এগেইনস্ট বাংলাদেশ পিপল’ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ব্যংক ডাকাতিসহ আর্থিকখাতে যে ব্যপক অনিয়ম-দূর্ণীতি চলছে তার বন্ধ ও সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশী ও বাংলাদেশের জনগনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার বিষয়ক ওয়াচ-ডগ ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই)’-এর সহায়তায় এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়
সেমিনারে ’ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইন বাংলাদেশ : মানি লন্ডারিং এন্ড বিওন্ড’ শীর্ষক মুল প্রবন্ধ উপাস্থাপন করেন, লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকত আলী। সেমিনারে ‘ইলিসিট মানি ট্রান্সফার ফর্ম বাংলাদেশ : পলিসি রিকমেন্ডশন ফর গভার্মেন্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপাস্থাপন করেন গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনট্রিগ্রিটি (জিএফআই)-এর চীফ ইকোনোমিস্ট দেব কর, পিএইচডি।
‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইন বাংলাদেশ : হাউ উইল ইট ইমপ্যাক্ট অ্যাচিভিং সাসটেইনবল ডেভলপমেন্ট গোল’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক (সানি)-এর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান এবং ‘স্যোসিও ইকোনোমিক কন্ডিশন অব বাংলাদেশ’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহমুদ রেজা চৌধুরী ।
সাংবাদিক কাউসার মুমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ইমরান আনসারী। এছাড়াও সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশেষজ্ঞরা। সেমিনারে প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহন করেন।
সেমিনারে ড. শওকত আলী তার প্রবন্ধে সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত পরিসংখ্যান, গবেষনাপত্র ও বার্ষিক রিপোর্ট ইত্যাদি দীর্ঘ তালিকা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাকে আর স্যেপ দূনীীত বলা যায় না। এ্টা অপরাধ। দেশের সাধারণ মানূষের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ। তিনি বলেন, সকলের জন্য অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। যদি কোথাও কোনো সমাজে সরকারি বা প্রাইভেট প্রাইভেট সেক্টরে ব্যাপক হারে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অবশ্যিকভাবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হয়। স্বাধীনতার বিগত ৪৫ বছরে বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি মাধ্যমে অর্থের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সময়ে যা দেখা যাচ্ছে তা নজীরবিহীন। আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠানসমুহের কনজারভেটিভ হিসাবে এই অংক সব মিলিয়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের কোনো জবাবদিহীতা নেই। অর্থমন্ত্রী নিজেকে অসহায় হিসাবে –মনে করছে। এমনকি এই জাকাতি থেকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাদ যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ১০০ মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে -তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তিনি আরো বলেন , বাংলাদেশে প্রধানত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার নজীর হচ্ছে শেয়ার বাজারকে কুক্ষিগত করা, রাজনৈতিক নেতাদের ঋণ খেলাপি হওয়া, সংসদ সদস্য, আমলা ও ব্যবসায়িদেরদের ঋণ মওকুফ করা, মেগা-প্রজেক্টে নজীরবিহীন ব্যয়-বরাদ্দ।
সেমিনারে ড. দেব কর বলেন, অর্থপাচারের জিএফআই সম্প্রতি যে গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছে তাতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচারের ডে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা মূলত খুবই কনজারভেটিভ হিসাব। জিএফআই যেসব সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তার প্রধান সোর্স হচ্ছে ব্যাংক। কিন্তু তারা এই তথ্য দেওয়ার বিষয়ে খুবই কম উৎসাহী । তাছাড়া এসব আন্তর্জাতিক ব্যাংকের হিসাব মুলত ব্যক্তির নামে। সুতরাং সরকারী খাত থেকে যে অর্থ পাচার হচ্ছে আর বেসরকারী খাতের তৈকে পাচারকৃত অর্থেও পরিমান আলাদা কওে বের করা আদৌ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশে পাচারের যে অংক জিএফআই প্রকাশ করেছে, তা মূলত একটি অংশ মাত্র।
অর্থপাচারের সঠিক চিত্র তুলে না ধরতে পারার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী অবৈধ অর্থ পাচারের যে প্রতিবেদন তুলে ধরে তা পুরো নির্ভরশীল বিভিন্ন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্য এব সহযোগিতার উপর। কিন্তু এ তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতা নিতান্ত সীমাবদ্ধ।
দর্শক সারি থেকে আসা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে ৬টি কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থপাচার হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রধান কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা এবং গণতন্ত্রের অভাব। কোনো ব্যাক্তিই চাইবে না তার অর্থ সেখানে বিনিয়োগ হোক। যদি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ সরকার অবৈধ অর্থপাচার বন্ধ করতে চায় তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে জিএফআই এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। ড, দেব কর আরো বলেন , যদি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা অর্থপাচার বন্ধে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন তাহলে এজন্য তাদেরকে কোনো অর্থও খরচ করতে হবে না। কারণ নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো বহুদেশ রয়েছে যারা এসব কাজে গবেষনা চালাতে নিয়মিত অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সরকার এগিয়ে না এলে জিএফআইএর মতো সংগঠনের কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগনই কেবল ঐক্যবদ্ধভাবে এটি প্রতিরোধে সরকারকে বাধ্য করতে পারে।
ড দেব কর বলেন , বাংলাদেশের জনগনের মধ্য থেকে যদি কোনো গ্রুপ নতুন ধারণা নিয়ে এই অবৈধ অর্থপাচার রোধে গণসচেতনতা বাড়াতে পারে জনগনখে এই বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পাওে তাহলে তা সম্ভব। আজকে এই সেমিনার সে দিক থেকে একটি ভালো উদ্যোগ।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমাদের পুরো জাতি সংকীর্ণ মন মানুষিকতা নিয়ে রাজনৈতি স্বার্থে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আর এই কারণেই আমরা রাজনৈতি ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি।
অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স মাত্র দেশের ১ শতাংশ লোক লুটপাট করে খাচ্ছে। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে দেশের জীবন যাত্রার মান উন্নত না হয়ে শিক্ষা ও সাস্থ্য সেবার অবনতিই হচ্ছে। আর রাজনীতিবিদরা তাদের সন্তানদের দেশের টাকায় বিদেশে পড়াচ্ছেন।
স্বাগত বক্তব্যে সাংবাদিক ইমরান আনসারী বলেন, স্বাধীন দেশের জনগন এখন স্বদেশি ব্যাংক ডাকাত ও লুটেরাদের যাতাকলে পিষ্ট। প্রতিদিনই গণমাধ্যমের খবর বাংলাদেশের কোনো না কোনো ব্যাংক থেকে অর্থ লুট হচ্ছে। বিভিন্ন নামে এই অর্থ লুটপাট চলছে। লুটপাট চলছে ঋণ খেলাপির নামে, শেয়ার বাজার কেলেংকারি মাধ্যমে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে। এটা ডাকাতি। তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে ভংয়কর সংবাদ হচ্ছে এই অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়া হচ্ছে । জনগনের এই অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য জনগণকেই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানান তিনি।