চার বছরেও আলো দেখেনি জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস

- প্রকাশের সময় : ১১:২১:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪
- / ১৪৯ বার পঠিত
চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি জেনারেল হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটিতে সাধারণ রোগের চিকিৎসা মিললেও ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে ছুটতে হয় কিডনি রোগীদের। এতে করে ভোগান্তির পাশাপাশি মাত্রারিক্ত খরচের বোঝা বইতে হচ্ছে রোগীদের। এ জন্য এই হাসপাতালে নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু জায়গা নির্ধারণ ছাড়া প্রায় চার বছরেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার একেএম মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পটি পাস হওয়ার পরেও আলাদা কোনো স্পেস (জায়গা) না থাকায় এটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আমি আসার পর একটি স্থান নির্ধারণ করে নকশা তৈরি করি। বর্তমানে প্রকল্পটি ডিপিপিতে (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) সংশোধনী প্রক্রিয়ায় রয়েছে।’
শুধু এটি নয়, দীর্ঘসময় ধরে আটকে আছে চাঁদপুরসহ ৪৪ জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন। তবে আটকে থাকার কারণ জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। যেহেতু অনেক দিন হয়েছে, প্রকল্পটি এখন কোন পর্যায়ে আছে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দেশে কিডনি রোগী প্রায় দুই কোটি। যাদের ৮০ ভাগই নির্ভর ডায়ালাইসিসে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক এই রোগীর জন্য সরকারি ১৪টি প্রতিষ্ঠানে ২৬৩টি ডায়ালাইসিস শয্যা রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, ল্যাবএইড, পপুলার, ইবনে সিনা, গণস্বাস্থ্য এবং সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। তার পরও সব মিলিয়ে ডায়ালাইসিসের আওতায় সর্বোচ্চ ২০ ভাগ রোগী।
গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডির ২০১৯ সালের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি হিসেবে কিডনি রোগের স্থান সপ্তম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই রোগে প্রতিবছর মারা যায় ১ কোটির বেশি মানুষ। যেখানে সেবার সুবিধা কম, সেখানে এই হারও অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে কিডনিজনিত সমস্যার মুখে পড়ে ৪০ হাজারের মতো মানুষ। যার বড় অংশের একেবারে বিকল হয়ে পড়ে। তাদের ভরসা কেবল ডায়ালাইসিস।
এসব রোগীর উন্নত সেবা দিতে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২৫৫ কোটি ২২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে কিডনি ডায়ালাইসিস এবং নেফ্রোলজি ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২২টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট এবং ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন করার কথা।
ওই সময় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শেষ ধরা হয় ২০২২ সাল। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি এই প্রকল্প। ফলে এখনো রাজধানীর ওপর নির্ভরশীল কিডনি রোগীরা। এতে করে ভোগান্তির পাশাপাশি খরচ জোগাতে গিয়ে চরম হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগীদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীদের বেঁচে থাকার স্থায়ী সমাধান কিডনি প্রতিস্থাপনে বারবার তাগিদ দিলেও সরকারি পর্যায়ে খুব একটা অগ্রগতি নেই। উন্নত দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে ক্যাডাভেরিক পদ্ধতি প্রধান হলেও বাংলাদেশে লিভিং ডোনার (জীবিত মানুষ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন) প্রক্রিয়ায় আগ্রহ বেশি। এতে করে সর্বোচ্চ দুই শতাংশ রোগী প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে। ৯৮ শতাংশ রোগীর ভরসা ডায়ালাইসিস। যা সরকারি হাসপাতালে ৬শ টাকায় পাওয়া গেলও বেসরকারিতে লাগে ৩ হাজার টাকা। এই খরচ মেটাতে না পেরে অধিকাংশ রোগী থাকছেন চিকিৎসার বাইরে।
এমন বেহাল অবস্থা নিয়েই প্রতিবছরের মতো আগামীকাল বৃহস্পতিবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ^ কিডনি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য- বৃদ্ধি পাচ্ছে ন্যয়সঙ্গত সেবার সমান সুযোগ আর নিরাপদ ও সর্বোত্তম ওষুধের অনুশীলন’।
দেশে কিডনি চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নিকডু। গত বছর ৫৫ হাজার সেশন ডায়ালাইসিস হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে হয়েছে ২৯ হাজার। তবে, রোগীর তুলনায় এটি অপ্রতুল। প্রতিদিন বহু রোগী হাসপাতালটিতে ভিড় করলেও বিনামূল্যে না হওয়ায় অনেককেই ফেরত যেতে হচ্ছে। যাদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগী।
দুই বছর আগে কিডনি সমস্যা দেখা দেয় পটুয়াখালীর নাজমা বেগমের (৫৭)। শুরুতে ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হলেও ছয় মাস ধরে ভরসা ডায়ালাইসিস। প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে ডায়ালাইসিস নিতে হয় তাকে। এর বাইরে ওষুধও খেতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে খরচ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কিডনি ওয়ার্ডে ভর্তি নাজমা। এ সময় তার ছেলে শামীম জানান, ‘আমাদের পরিবার চলে কোনোরকম। জেলা হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই। অনেক কষ্টে বেসরকারিতে ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। কিন্তু আর কুলিয়ে উঠতে না পারায় এখানে এসেছি। সরকারিভাবে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু লোক না থাকায় হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও নিকডুর পরিচালক অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে কিডনি রোগী বাড়ছে। বছর দুই আগেও প্রতিদিন ইউরোলজি ও নেফ্রোলজি মিলে গড়ে ৫শ রোগী এ হাসপাতালে এলেও এখন আসছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে চিকিৎসা করাতে পারেন না। এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ইউনিট করা গেলে খরচ অনেক কমবে।’
স্থানীয় পর্যায়ে কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনের সাবেক এই প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০২০ সালের হলেও কাজ শুরু হয়েছে ২০২১ সাল থেকে। ইতোমধ্যে অনেক হাসপাতালে জায়গা নির্ধারণ হয়েছে। তবে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। বেড়েছে বরাদ্দও। এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জনবল। দেড় বছর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও এখনো সেটি ঝুলে আছে। তবে প্রথম দফায় সব জেলায় না হলেও অন্তত ২০ জেলায় করা গেলেও বহু রোগী উপকৃত হবে।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাম বেড়েছে ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহৃত ছাঁকন প্রক্রিয়া বা ডায়ালাইজারের (আর্টিফিসিয়াল কিডনি)। এতে করে বেড়েছে ডায়ালাইসিসের খরচ। এতে করে ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলো একটি ডায়ালাইজারে একাধিক সেশন করায় রোগীদের জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
কিডনি রোগীর চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য স্বল্পমূল্যে ডায়ালাইসিস সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় নিকডুতে ২০১৬ সালে নামমাত্র মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা চালু হয়। এই সেবা দিচ্ছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর।
স্যান্ডরের ম্যানেজার মো. নিয়াজ জানান, ‘বর্তমানে ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহৃত ফ্লুইডের ও ডায়ালাইজারের দাম বেড়েছে। কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই ৪শ টাকার ডায়ালাইজার এখন ৯শ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে রোগীদের ওপর। যেহেতু এগুলো অত্যাবশকীয়, সরকার চাইলে ভ্যাট কমানো কিংবা একেবারে উঠিয়ে নিলে ডায়ালাইসিসের খরচ কমে আসবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^দ্যিালয়ের (বিএসএমএমইউ) নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন প্রধানমন্ত্রীর প্রাইমারি প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে বহু রোগী বাঁচার সুযোগ পাবে। এত দিনেও কেন আটকে আছে সেটি দেখা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘ডায়ালাইসিসই যেহেতু রোগীর ভরসা; তাই ডায়ালাইজারের দাম কেন বাড়ে সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এটিতে ভ্যাট কমানো কিংবা মুক্ত রাখা যায় কিনা সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেখা দরকার।’ সূত্র : আমাদের সময়।