রোজায় পণ্যের মূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমজনতা
- প্রকাশের সময় : ১২:৪২:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪
- / ৪৩ বার পঠিত
চাঁদ দেখাসাপেক্ষে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে পারে পবিত্র রমজান মাস। পুণ্যের মাস হলেও প্রতিবছর এ মাসে বেশি মুনাফা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বরং এবার মাস দেড়েক আগে থেকেই নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছেন তারা। সরকার এবার রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের নানা আশ্বাস দিলেও ছোলা, বেগুন, লেবু থেকে শুরু করে মাছ-মাংস প্রায় সবকিছু চড়া দামে কিনতে হচ্ছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যে যেখানে ১০০ টাকা খরচ হয়েছে, সেখানে এই ফেব্রুয়ারিতে ১০৯ টাকা ৪৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় এ খরচ আরও বাড়তে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষ। তার ওপর রমজান মাসকে ঘিরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী গতি এ চাপকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজান মাসের বাড়তি খরচ নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তায় আছেন আমজনতা।
দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে রবিবারও অভিযান চালিয়ে জেলা প্রশাসন দেখতে পায়, একটি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৪৫০ টাকার এলাচ ৩ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করছে। চিনিও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি দামে বিক্রি করছে। এসব অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছিল তিন প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ। এ রকম অসংখ্য অসাধু ব্যবসায়ী রোজাকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। থেমে নেই অবৈধ পণ্য মজুদও।
প্রতিবছর রোজাকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাকে ‘দুঃখজনক‘ উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দামে ছাড় দেওয়া হয়; ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। আর আমাদের এখানে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। আমাদের দেশে এ সময়কালে ভোক্তার পকেট কাটার প্রতিযোগিতা চলে। বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে একে একে সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারের যে চিত্র, তাতে সঙ্গত কারণেই রোজার বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সাধারণ ভোক্তা।
রাজধানীর বাজারচিত্রে দেখা যায়Ñ রোজার মাস দেড়েক আগে থেকেই ছোলা, অ্যাংকর, মুগসহ সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছে। খেজুরের দর লাগামহীনভাবে বেড়েছে। চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। সয়াবিন তেলের দাম যদিও কিছুটা কমেছে, কিন্তু তা বিশ^বাজারের তুলনায় যৎসামান্য। মাঝে কিছুটা কমে যাওয়া গরুর মাংসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে আবার আগের দামে ফিরেছে। ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামও চড়া। দাম বাড়ার তালিকা থেকে বাদ পড়েনি চিড়ামুড়িও। সবজির মধ্যে ইতোমধ্যেই বেগুন, শসা, লেবুসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে।
এক বছরের ব্যবধানে তুলনা করলে দেখা যায়, নিত্যপণ্যে খরচ অনেকখানি বেড়েছে। ছোলার দাম বেড়ে প্রতি কেজি এখন ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা হয়েছে। গত বছর যা ৮৫ থেকে ৯২ টাকার মধ্যে কেনা গেছে। অ্যাংকর ডাল এবার ৯০ টাকা ছুঁয়েছে। গত বছর এ সময়ে যা ৭০ টাকায় কেনা গেছে। গত বছর রোজার আগে মসুর ডালের দাম সেভাবে না বাড়লেও এবার ছোলার সঙ্গে মসুর ও মুগ ডালের দামও বেড়েছে। গত বছর এ সময় ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়া বড় দানার মসুর ডাল এবার ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশি পেঁয়াজের দর গত বছর যেখানে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ছিল; এবার তা ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোজায় মুখরোচক নানা খাবারে চিনি ব্যবহার হয়। চিনির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এসব খাবারের দামও বাড়তে পারে। বাজারে খোলা চিনির কেজি এখন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, গত বছর যা ১১০ টাকা ছিল। সাধারণ মানের খেজুর গত বছর ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি। এবার তা ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের কেজি গত বছর ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা ছিল। এবার ৭৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত বছর আলুর কেজি ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর কদমতলী এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাসের সীমিত বেতনের টাকায় মাসের বাজার খরচ সামলাতেই ঘাম ছুটে যায়। সেখানে রোজাকে সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। রমজানে কীভাবে বাজার খরচ সামাল দেবÑ তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। অটোরিকশাচালক মো. কাশেম মোল্লা বলেন, রোজাকে ঘিরে যে হারে দাম বেড়েছে তা আমাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের পকেটে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। হতাশার সঙ্গে তিনি বলেন, রোজায় কি হবে জানি না!
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার এবার বিভিন্ন পণ্যের আমদানি সহজ করা ও শুল্ক সুবিধা দেওয়াসহ অনেকগুলো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বাজারে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে এর প্রভাব পড়ছে না। রোজার আগে শুল্কছাড় দেওয়া হয়। এতে করে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ভোক্তারা সুফল পাচ্ছে না। শুল্ক ছাড়ের সুফল যেন ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছায়, তা তদারকি করতে হবে। এ ছাড়া পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের পণ্য ক্রয়েও আরও সচেতন হওয়ার তাগিদ দেন তিনি। তিনি আরও যোগ করেন, বেশি বেশি করে কেনার বদলে কম করে কিনতে হবে। নইলে অতিরিক্ত ক্রয়ের প্রভাবে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, রোজার মাস কিংবা যে কোনো উৎসবকে ঘিরে নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, এটা এখন নিয়মিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা কমে যাচ্ছে, বেশি মুনাফা করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। রোজায় ব্যবসায়ীদের লোভ সংবরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে ভোক্তাদেরও পণ্য ক্রয়ে সংযমী হতে হবে। অতিরিক্ত কেনাকাটা ও খাবার অপচয় থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে রোজার বাড়তি চাহিদার বিপরীতে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে হবে। অস্বাভাবিক পণ্য মজুদ যাতে না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে হবে।
রোজাকে কেন্দ্র করে বাজার তদারকিতে নিয়মিত মাঠে রয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কথা হলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা এবার সমন্বিত মনিটরিং করছি। স্থানীয় প্রস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাজার সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। রমজানের সময় আমাদের মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে, বিশেষ অভিযানও চালানো হবে। সূত্র : আমাদের সময়।