নিউইয়র্ক ০২:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মালালাকে অভিনন্দন ও নোবেল পিস প্রাইজ অব ম্যানিপুলেশন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৫৮:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৪
  • / ১০৯২ বার পঠিত

শিক্ষা ও শান্তি

. আমেরিকান ড্রোন হামলায় পাকিস্তানে মোট নিহত শিশুর সংখ্যা মাত্র ১৬৮ থেকে ২০০ জন , যার সমালোচনা করেছে বিশ্বব্যাপি মানবাধিকারের জন্য বিখ্যাত সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

.এই ড্রোন হামলার ৬০% হয়েছে মানুষের বসতবাড়িতে, ফলে মারা গেছে প্রায় ১০০০ এর বেশি নারী ও শিশু।

. জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গাজাতে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ১৩৮টি স্কুল, যার ৪৯টি সরকারী আর ৮৯টি জাতিসংঘের টাকায় পরিচালিত। বেসরকারী হিসেবে ২৮০ টি কিন্ডারগার্টেন ধ্বংস হয়েছে। স্কুলগুলিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে এখনও শিক্ষাদান শুরু হতে পারে নাই।

. ইরাক যুদ্ধের আগে ইরাকে শতকরা ১০০ ভাগ শিশু স্কুলে যেত। অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও আক্রমনে ধ্বংস হয়েছে সাতশ স্কুল। ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে লুট হয়েছে ২৭৫১টি। যুদ্ধের আগে ছাত্র প্রতি সরকারি ব্যয় ছিল ৬২০ডলার। এখন যা মাত্র ৪৭ ডলার। ৭০% শিশু স্কুলে যেতে পারে না।মালালা ইউসুফজাই এসব নিয়ে কখনও কথা বলেন নাই।

তিনি কথা বলেন কেনিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তান নিয়ে। তার বক্তব্যে সবসময় জোর দেয়া হয় মৌলবাদিদের কারণে কিভাবে নারী শিক্ষা বিপন্ন হচ্ছে সেটার উপরে। যেন মৌলবাদ না থাকলেই নারীরা সবাই স্কুলে যেতে পারবে। যেসব দেশে পশ্চিমা বিরোধী তালিবান বা উগ্র মৌলবাদ আছে, সেসব দেশ নিয়েই তার আগ্রহ। পৃথিবীর অন্যখানে যেখানে চক আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে স্কুলের শিক্ষা বিপন্ন করা হয়েছে, সেটা নিয়ে তার কোনও সমস্যা নেই। যেখানে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের কারণে স্কুলকে ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে সেখানে তার দৃষ্টি নিপাতিত হয় না।

আমেরিকার অবরোধে ইরাকে চক আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চক এর উপাদান দিয়ে নাকি রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করা যায়, এই অভিযোগে তেলের বিনিময়ে বার্টার করে আনা দুটি চক কারখানা স্থাপনকেও বছরের বছর আটকে রেখেছিল আমেরিকা।

মালালা কখনও এসব নিয়ে চিন্তিত নন। কারন এসব শিক্ষা বিপন্ন হওয়ার মূল কারন হয়তো নয়। এই বছর মালালা নারী শিক্ষা প্রসারে ভূমিকার জন্য নোবেল পেয়েছেন।

মালালাকে অভিনন্দন। কিন্তু তার এই বুলেটবিদ্ধ হবার পরে বুলেটের গতিতে নোবেল বিজয়, নোবেল পুরস্কার নিয়ে বহু বিতর্কের সঙ্গে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। জিপিএ পাঁচ দেওয়ার মতো আমরা কি এখন নোবেল বিজয়ীদের তৈরি করতে শুরু করেছি। মিডিয়া কি এখন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারের প্রয়োজনে আইডল তৈরি করছে?

ব্লগ থেকে টেলিভিশন, গুলিবিদ্ধ হওয়া, আবার টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার ঝাঁপিয়ে পড়া। দেড় বছরের মধ্যে প্রায় সব পুরস্কার একজন নাবালিকার দখলে। যাকে মুসলিম ও পাকিস্তানী বলে উল্লেখ করেছে নোবেল কমিটি। সাধারনত নোবেল বিজয়ীদের ধর্ম দিয়ে পরিচিত না করার রীতি। ড. ইউনুসকে বা প্রফেসর সালামকে মুসলিম, কিংবা ম্যান্ডেলাকে খ্রিস্টান, এমনকি ইয়াসির আরাফাত ও পেরেস, রাবিন বা বেগিনকে ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করে পরিচয় দেয়নি নোবেল কমিটি। এবার কৈলাশ সত্যার্থিকে হিন্দু ও মালালাকে আলাদা করে মুসলিম বলা হয়েছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবার যোগ্যতাসমূহ কী:

নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে পারেন পুরোনো নোবেল বিজয়ীরা, রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ, নোবেল কমিটির সাথে সংশ্লিষ্টজন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোর্ট ও বিদেশনীতি সংক্রান্ত ইন্সটিটউটসমূহ ইত্যাদি।

নোবেল সাহেবের উইল অনুযায়ী এই পুরস্কার পাবেন এমন কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন, যিনি বা যারা বিবাদ নিরসন বা যুদ্ধমান দল ও দেশগুলির মধ্যে শান্তি আনবেন বা এমন কাজ করবেন যা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনতে অবদান রাখবেন। এই যুক্তি ইন্টারপ্রিটেশনের উপর নির্ভরশীল। ফলে আণবিক বোমা ব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদে জাপানে শান্তি এসেছে এই যুক্তিতে আপনি প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকেও এই পদক দিয়ে দিতে পারবেন।

প্রতিবছর মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ সময় আগের বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ। অর্থাৎ মালালার কাজের হিসেব হবে ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার আসেন দেখি মালালা ইউসুফজাইয়ের বিস্ময়কর রকেটগতির উর্দ্ধযাত্রার ইতিহাস।

মালালার অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

২০০৮ ২০০৯ সালে বিবিসির পরিকল্পনায় মালালার নিবাস সোয়াত অঞ্চল থেকে একটি নারী শিশুকে দিয়ে ব্লগ লেখানোর চেষ্টা করা হয়। বিবিসি উর্দুর আমের আহমেদ খান ও মির্জা ওয়াহিদ তাদের বন্ধু মালালার বাবাকে অনুরোধ করেন একজন ছাত্রীকে রাজি করাতে। মালালার বাবার পেশা ছিল একাধিক স্কুল পরিচালনা। একজন ছাত্রী রাজি হয়েও পিছিয়ে গেলে মালালার বাবা নিজের মেয়েকে দিয়ে এই ব্লগ লেখাতে থাকেন। মালালার বয়স তখন ১১। তার ছদ্মনাম ছিল গুলমাকাই বা ভুট্টার ফুল। এই নামটি পশতুন লোককাহিনীর বীর নারী চরিত্রের নাম।

পরে বিবিসির ব্লগ শেষ হলে, এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সোয়াতে তালিবানদের আক্রমন করে হটিয়ে দিলে, নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক একটি তথ্যচিত্র নির্মানের মাধ্যমে মালালার পরিচয় উন্মুক্ত করে দেন এবং তারপর তাকে নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া মহা হুল্লোড় শুরু করে। মালালার বাবা মেয়ের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১২ সালের অক্টোবরে তালেবান সন্ত্রাসী তাকে স্কুলে যাওয়ার পথে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। যদিও গুলি হবার পরপরই সিএনএনসহ সব পশ্চিমা মিডিয়া বলেছিল তাকে রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়েছে। তার সাথে আরো দুজন ছাত্রী গুলিবিদ্ধ হয়েছিল , যেহেতু তারা ব্লগ লিখত না এবং লক্ষ্যবস্তু ছিল না, এবং তাদের আঘাত মারাত্মক ছিল না, তাই তারা আলোচনায় নেই।

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তাকে গুলি করা হয়। তাকে ইনডিউসড বা কৃত্রিম কোমায় রেখে চিকিৎসা করা হয়। অক্টোবরের ১৭ তারিখ তার জ্ঞান ফেরে ইংল্যান্ডে, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। মার্চ থেকে সে স্কুলে যেতে শুরু করে। ২০১২ পর্যন্ত তার মুল ভুমিকা ছিল ব্লগ লেখা। যেখানে তার নিজের কথা ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা থাকতো। মজার ব্যাপার হলো এসবই নাকি সে হাতে লিখত তারপর একজন রিপোর্টার সেটা টাইপ করত। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এসব লেখার সবটুকু তার নিজের লেখা ছিল না।

এই ব্লগ ছাড়া নারী শিক্ষা নিয়ে তার তেমন কোনও বড় কাজ ছিল না। ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে এমন কি কাজ করল যার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে গেল?

আসুন তার কাজগুলি দেখি:

. সে ২০০৮ থেকে ব্লগ লেখে, নিজের উৎসাহে স্বপ্রণোদিত হয়ে নয়, বাবার নির্দেশে, এবং বিবিসির পরিকল্পনায়।

. ২০১২ তে নিজের নিরাপত্তার প্রতি মনোযোগী না হয়ে, ছদ্মনাম থেকে আত্মপ্রকাশ করার ফলে এবং মিডিয়াতে প্রচারণার কারনে তার পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যায়, তাকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়। তালেবানরা তাকে গুলি করে।

. ২০১৩ থেকে ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে মালালা ফান্ড নামে একটি তহবিল খোলে। সে, তার বাবা, এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত নারী সাংবাদিক সিজা শহিদ এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা। মালালার বাবা কিন্তু বার্মিংহামে পাকিস্তান কনসুলেটের শিক্ষা অ্যাটাচি। এর সিইও হলেন ক্লিনটনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ও বোনোর ওয়ান ক্যাম্পেইনের সাথে জড়িত সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা মেহান স্টোন। যার মূল কাজ বিপনণ। আর আছেন উপদেষ্টা হিসেবে সিএনএন এর সাবেক সাংবাদিক এসন জর্ডান ও আরেক জাতিসংঘ কর্মচারী পি জে কাজিক। এই মালালা তহবিল কাজ করে কেনিয়া, জর্ডান, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়াতে।

মালালা তহবিল খোলা হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরের ১১ তারিখে, সে গুলিবিদ্ধ হবার মাত্র দু্ইদিন পরে। মেহান স্মিথ একসময় গুগলে কাজ করতেন। এসএমএস করে ১০ ডলার পাঠানোর আবেদন করে এর কাজ শুরু হয়েছিল। বলা হয়েছিল এটা নাকি মালালার শেষ ইচ্ছা। কেমন একটা রহস্যময় ব্যাপার নয় কি? যার নামে ফান্ড সে তখনও কোমায়, বাঁচে বা মরে ঠিক নাই। তার মানে মালালার নিজের এই তহবিল খোলার বিষয়ে সামান্যই অবদান। কেবল শেষ ইচ্ছা প্রকাশ ছাড়া। ইচ্ছা কিন্তু ছিল মালালা ফাউন্ডেশন করার। হয়ে গেল ফান্ড।

. সে একটা বই লিখে ফেলে আই অ্যাম মালালা নামে, যার কো রাইটার ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব নামে একজন বৃটিশ সাংবাদিক। তার সব লেখাতেই কেন জানি সাথে আরেকজন থাকে। ব্লগ লিখত হাতে। টাইপ করত বিবিসির সাংবাদিক। বইটাও সঙ্গে লিখলেন ক্রিস্টিনা। প্রকাশিত হয় ৮ অক্টোবর ২০১৩ সালে। এই বইটিতে পাকিস্তান ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য আছে বলে অভিযোগ করে পাকিস্তানের প্রাইভেট স্কুল অ্যাসোসিয়েশন তাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত স্কুলগুলিতে এটি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।

. সে বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করতে থাকে এবং জাতিসংঘে বক্তৃতা দেয় ১২ জুলাই ২০১৩।

. সে নাইজেরিয়াতে বোকো হারামের বিরুদ্ধে কথা বলে।

. সে সিরিয়া সীমান্তে গিয়ে ক্যামেরার সামনে একটি রিফিউজি শিশুকে কোলে করে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়। যদিও গাজাতে অবরুদ্ধ ও নিহত শিশুদের বিষয়ে নিরব থাকে।

. সে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানে নারী শিক্ষার বিষয়ে বক্তব্য দেয়।

. এরই মধ্যে সে সিতারা এ জুরাক, ন্যাশনাল ইয়ুথ প্রাইজ, মাদার তেরেসা পদক, রোম পুরস্কার , সিমন দ্য বুভোয়া পদক, ডোটি স্ট্রিট অ্যাডভোকেসি পদক, ফ্রেড ও অ্যানি জারভিস পদক, গ্লোবাল লিডারশিপ পদক, ক্লিন্টন পদক, ডক্টরেট, হার্ভার্ড ফাউন্ডেশন পদক, ওপেক উন্নয়ন পদক , শাখারভ পদক সহ ছোট বড় ২৮ টি পদক, ডিগ্রি ও সম্মাননা পায়। এটা কি একটু অস্বাভাবিক নয় যে পৃথিবীর প্রায় সব পদক দেওয়ার সংস্থাগুলি গত এক বছরে মালালা ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পায়নি সারা পৃথিবীতে যাদের পদকের ক্ষেত্রগুলিতে যথেষ্ট অবদান আছে? পৃথিবীর ইতিহাসে মালালা ছাড়া আর কারও এক বছরে এত পুরস্কার পাবার কৃতিত্ব নেই। এজন্য তার নাম গিনেস বুকেও যেতে পারতো।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকার দিকে এবার চোখ বুলানো যাক:

জাতিসংঘকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে আবার আলাদা আলাদা করে এর অধীনে নানা রকম সংস্থাগুলিকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এটা কেমন করে হয়? যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সদস্য দেশগুলির টাকায় মানব সেবার জন্য, যেখানে পেশাদারি কাজই হচ্ছে মানবজাতির কল্যান তাকে যদি পুরষ্কৃত করা হয় তবে পৃথিবীর বহু হাসপাতালও কিন্তু এই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। এ যেন আপনি বাংলাদেশ সরকারকে একটা পুরস্কার দিলেন আবার একই পুরস্কার তার অধীনে সব মন্ত্রণালয়গুলিকেও দিলেন।

যে সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এই পুরস্কার পেয়েছে , গ্রামীন ব্যাংক ও মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছাড়া আর কারও সদর দফতর ইউরোপ বা আমেরিকার বাইরে নয়। মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতাও একজন ইউরোপিয়ান। তাই কেবল গ্রামীন ব্যাংকই একমাত্র বিশুদ্ধ কালো চামড়া প্রতিষ্ঠান।

এবার আসা যাক রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্ষমতাবানদের প্রসঙ্গে:

মেনাহেম বেগিন যিনি সরাসরি গণহত্যা ও বোমা হামলার মতো সন্ত্রাসী তৎপরতা করেছেন, তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আমেরিকান টেলিভিশনে, প্যালেস্টাইনে হোটেল ডেভিডে বোমা হামলা করার জন্য অহংকারের সাথে সন্ত্রাস নামক বস্তটিকে পৃথিবীব্যাপি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন।

ই পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, উইলসন ও থিওডোর রুজভেল্ট। এছাড়া যেসব বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসব পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই ইউরোপ ও আমেরিকার । ম্যান্ডেলা, সুকি, কিম দায়ে জং, বা পূর্ব তিমুরের হোসে রামোসে এদের মধ্যে সামান্য ব্য্যতিক্রম। ম্যান্ডেলার সঙ্গে তারা জুড়ে দিয়েছে ডি ক্লার্কের মতো চূড়ান্ত বর্ণবাদী এক হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টকে। শিমন পেরেজ, আইজ্যাক রবিন, আগ্রাসী ইসরায়েলীদের সঙ্গে চুক্তি করার পুরস্কার হিসেবে ইয়াসির আরাফাত এর সঙ্গে এই দুজনকেও দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার ।

মহাত্মা গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং এই তালিকাতে নেই। তালিকাতে নেই পাকিস্তানের আব্দুল সাত্তার ইদির মতো ব্যক্তিত্ব। আব্দুল সাত্তার ইদি এই পুরস্কার কখনওই পাবেন না কারন তিনি সমাজের সেবা করলেও তার সামাজিক পরিচয়ের প্রধান দিক তিনি একজন ধর্মপ্রান মুসলমান।

যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর মতো সংগঠন এই ‍পুরস্কার পায় তবে সার্ক বা আসিয়ান এই পুরস্কার বহু আগেই পাওয়া উচিত ছিল। এই পুরস্কারের বিবেচনা অনেকাংশেই রাজনৈতিক। পশ্চিমের মতবাদ, পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তির সাথে মতের মিল ও তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সাথে এই বিশ্ব শান্তি ও নোবেল শান্তি পুরস্কার নামক মুলাটি বিশেষভাবে জড়িত।

আবার মালালা প্রসঙ্গ:

মালালাকে এই পুরস্কার দেয়াতে আমি ব্যক্তিগতভাবে নারাজ নই। সে এই পুরস্কার পেতেই পারে। নোবেল কমিটি যাকে ইচ্ছা তাকে এই পুরস্কার দিতে পারেন। তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অভিনন্দন জানাই। তবে পশ্চিমের কাছে তার এত মূল্যের কারণ কি সেটা বুঝে স্বপরিচয়ে, স্বশিক্ষায়, স্বযোগ্যতায় নিজে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সে পারবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে। এখনও সে আশ্রিত। তার যা কিছু সবই পশ্চিমাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীল মানুষটির যা কথা সবটুকু তার নিজের নয়। খানিকটা তার মেন্টর বা যারা তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে তাদের দ্বারা প্রভাবিত, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

একজন নোবেল বিজয়ীর স্বতঃপ্রণোদিত কাজের কথা আমরা শুনতে চাই। মালালা যা করছে সবই তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে তার বাবা, বিবিসি, সিএনএন, মালালা ফান্ডের পরিচালকেরা, তার আত্মজীবনীর লেখিকা, প্রকাশনা সংস্থাসমূহ।

মালালা ১৭ বছরের তরুনী। গত দুই বছরেরও কম সময়ে সে যে সব কাজ করেছে তার অধিকাংশই তাকে সামনে রেখে একদল পশ্চিমা সাংবাদিক, ফান্ড ম্যানেজার, সমাজসেবা বা সিএসআর কর্মীদের কাজ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত তার সিজা সাইদ, মেহান এর মতো পেশাদার সমাজসেবীরা যারা সমাজসেবার জন্য মিলিয়ন ডলার বেতন নিয়ে থাকেন।

তাকে নিয়ে ব্যস্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলি, তার বই বিক্রিতে যার লেখক তিনি নিজে কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত পশ্চিমা মিডিয়া, কারণ তারা এটা দিয়ে তালিবান দমনের নামে দেশে দেশে ড্রোন হামলা ও সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপনকে নৈতিক সমর্থন যোগাতে পারে। ইরাক, আফগানিস্তান ও প্যালেস্টাইনে লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে না পারলেও তার দায় আক্রমণকারীদের ঘাড়ে চাপে না। এসব নিয়ে কেউ কথাও বলে না। মালালাও বলে না।

অথবা সে বলতে পারে না। বললে হয়তো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে পশ্চিমা বিশ্ব। মালালা নিজে থেকে এখনও কিছুই করতে পারে না। তাকে দিয়ে করানো হয়। মালালাকে নিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদ হয়, স্কুলে তাকে নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। পশ্চিমা শিশুরা তাকে সাহসী নারীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে মনে করে। লাখ লাখ মালালাকে রক্ষার জন্য ড্রোন হামলা, ইরাকে ও আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়।

অন্যদিকে গাজায় জাতিসংঘের স্কুলে ইসরায়েল রকেট মারলে সেটা হয়ে যায় আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ইসরায়েলের ন্যায্য অধিকার যার সমর্থনে বক্তব্য দেন নোবেল শান্তি মামা, বারাক ওবামা। বোমাবর্ষণের দৃশ্যকে আতশবাজির মতো উপভোগ করে ইসরায়েলিরা , তখন মালালা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন না। তবে তিনি বোকো হারামের বিরুদ্ধে বলার জন্য কেনিয়া ও নাইজেরিয়াতে ছুটে যান। কারন বোকো হলো ইসলামী মৌলবাদ।

মৌলবাদকে একচোখে দেখার এই নীতিকে যারা সমর্থন করবে , তারাই বিশ্ব শান্তি পুরস্কার পাবে। ইসরায়েল ধর্মরাষ্ট্র কিন্তু তাদের বোমা ধর্মনিরপেক্ষ। ড্রোন এর চোখে ২০০ এর বেশি বসতবাড়িকে মনে হয় ক্যান্টনমেন্ট, সেখানে বসবাসরত সাধারন নাগরিকদের মনে হয় সৈনিক। ইরাকের ৩০০০ স্কুল হয়ে যায় রাসায়নিক অস্ত্র বা উইপনস অব ম্যাস ডেস্ট্রাকশন এর মজুদখানা।

আমেরিকা যখন ইরাকে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার চক আমদানির ওপর বাধা দিচ্ছিল, রসিকতা করে একজন সাংবাদিক বলেছিলেন চক হচ্ছে ওয়েপন অব ম্যাস ইন্সট্রাকশন। এজন্যই একে এত ভয় আমেরিকার। নোবেল শান্তি পুরস্কারের গতিবিধি দেখলে মনে হয় একেও নাম দেবার সময় এসেছে , প্রাইজ অব ম্যাস ম্যানিপুলেশন।

লেখক: চিকিৎসক, টিভি ব্যক্তিত্ব।

ইমেইল: abdun.noor@gmail.com

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

মালালাকে অভিনন্দন ও নোবেল পিস প্রাইজ অব ম্যানিপুলেশন

প্রকাশের সময় : ০১:৫৮:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৪

শিক্ষা ও শান্তি

. আমেরিকান ড্রোন হামলায় পাকিস্তানে মোট নিহত শিশুর সংখ্যা মাত্র ১৬৮ থেকে ২০০ জন , যার সমালোচনা করেছে বিশ্বব্যাপি মানবাধিকারের জন্য বিখ্যাত সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

.এই ড্রোন হামলার ৬০% হয়েছে মানুষের বসতবাড়িতে, ফলে মারা গেছে প্রায় ১০০০ এর বেশি নারী ও শিশু।

. জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গাজাতে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ১৩৮টি স্কুল, যার ৪৯টি সরকারী আর ৮৯টি জাতিসংঘের টাকায় পরিচালিত। বেসরকারী হিসেবে ২৮০ টি কিন্ডারগার্টেন ধ্বংস হয়েছে। স্কুলগুলিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে এখনও শিক্ষাদান শুরু হতে পারে নাই।

. ইরাক যুদ্ধের আগে ইরাকে শতকরা ১০০ ভাগ শিশু স্কুলে যেত। অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও আক্রমনে ধ্বংস হয়েছে সাতশ স্কুল। ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে লুট হয়েছে ২৭৫১টি। যুদ্ধের আগে ছাত্র প্রতি সরকারি ব্যয় ছিল ৬২০ডলার। এখন যা মাত্র ৪৭ ডলার। ৭০% শিশু স্কুলে যেতে পারে না।মালালা ইউসুফজাই এসব নিয়ে কখনও কথা বলেন নাই।

তিনি কথা বলেন কেনিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তান নিয়ে। তার বক্তব্যে সবসময় জোর দেয়া হয় মৌলবাদিদের কারণে কিভাবে নারী শিক্ষা বিপন্ন হচ্ছে সেটার উপরে। যেন মৌলবাদ না থাকলেই নারীরা সবাই স্কুলে যেতে পারবে। যেসব দেশে পশ্চিমা বিরোধী তালিবান বা উগ্র মৌলবাদ আছে, সেসব দেশ নিয়েই তার আগ্রহ। পৃথিবীর অন্যখানে যেখানে চক আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে স্কুলের শিক্ষা বিপন্ন করা হয়েছে, সেটা নিয়ে তার কোনও সমস্যা নেই। যেখানে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের কারণে স্কুলকে ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে সেখানে তার দৃষ্টি নিপাতিত হয় না।

আমেরিকার অবরোধে ইরাকে চক আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চক এর উপাদান দিয়ে নাকি রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করা যায়, এই অভিযোগে তেলের বিনিময়ে বার্টার করে আনা দুটি চক কারখানা স্থাপনকেও বছরের বছর আটকে রেখেছিল আমেরিকা।

মালালা কখনও এসব নিয়ে চিন্তিত নন। কারন এসব শিক্ষা বিপন্ন হওয়ার মূল কারন হয়তো নয়। এই বছর মালালা নারী শিক্ষা প্রসারে ভূমিকার জন্য নোবেল পেয়েছেন।

মালালাকে অভিনন্দন। কিন্তু তার এই বুলেটবিদ্ধ হবার পরে বুলেটের গতিতে নোবেল বিজয়, নোবেল পুরস্কার নিয়ে বহু বিতর্কের সঙ্গে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। জিপিএ পাঁচ দেওয়ার মতো আমরা কি এখন নোবেল বিজয়ীদের তৈরি করতে শুরু করেছি। মিডিয়া কি এখন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারের প্রয়োজনে আইডল তৈরি করছে?

ব্লগ থেকে টেলিভিশন, গুলিবিদ্ধ হওয়া, আবার টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার ঝাঁপিয়ে পড়া। দেড় বছরের মধ্যে প্রায় সব পুরস্কার একজন নাবালিকার দখলে। যাকে মুসলিম ও পাকিস্তানী বলে উল্লেখ করেছে নোবেল কমিটি। সাধারনত নোবেল বিজয়ীদের ধর্ম দিয়ে পরিচিত না করার রীতি। ড. ইউনুসকে বা প্রফেসর সালামকে মুসলিম, কিংবা ম্যান্ডেলাকে খ্রিস্টান, এমনকি ইয়াসির আরাফাত ও পেরেস, রাবিন বা বেগিনকে ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করে পরিচয় দেয়নি নোবেল কমিটি। এবার কৈলাশ সত্যার্থিকে হিন্দু ও মালালাকে আলাদা করে মুসলিম বলা হয়েছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবার যোগ্যতাসমূহ কী:

নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে পারেন পুরোনো নোবেল বিজয়ীরা, রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ, নোবেল কমিটির সাথে সংশ্লিষ্টজন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোর্ট ও বিদেশনীতি সংক্রান্ত ইন্সটিটউটসমূহ ইত্যাদি।

নোবেল সাহেবের উইল অনুযায়ী এই পুরস্কার পাবেন এমন কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন, যিনি বা যারা বিবাদ নিরসন বা যুদ্ধমান দল ও দেশগুলির মধ্যে শান্তি আনবেন বা এমন কাজ করবেন যা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনতে অবদান রাখবেন। এই যুক্তি ইন্টারপ্রিটেশনের উপর নির্ভরশীল। ফলে আণবিক বোমা ব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদে জাপানে শান্তি এসেছে এই যুক্তিতে আপনি প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকেও এই পদক দিয়ে দিতে পারবেন।

প্রতিবছর মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ সময় আগের বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ। অর্থাৎ মালালার কাজের হিসেব হবে ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার আসেন দেখি মালালা ইউসুফজাইয়ের বিস্ময়কর রকেটগতির উর্দ্ধযাত্রার ইতিহাস।

মালালার অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

২০০৮ ২০০৯ সালে বিবিসির পরিকল্পনায় মালালার নিবাস সোয়াত অঞ্চল থেকে একটি নারী শিশুকে দিয়ে ব্লগ লেখানোর চেষ্টা করা হয়। বিবিসি উর্দুর আমের আহমেদ খান ও মির্জা ওয়াহিদ তাদের বন্ধু মালালার বাবাকে অনুরোধ করেন একজন ছাত্রীকে রাজি করাতে। মালালার বাবার পেশা ছিল একাধিক স্কুল পরিচালনা। একজন ছাত্রী রাজি হয়েও পিছিয়ে গেলে মালালার বাবা নিজের মেয়েকে দিয়ে এই ব্লগ লেখাতে থাকেন। মালালার বয়স তখন ১১। তার ছদ্মনাম ছিল গুলমাকাই বা ভুট্টার ফুল। এই নামটি পশতুন লোককাহিনীর বীর নারী চরিত্রের নাম।

পরে বিবিসির ব্লগ শেষ হলে, এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সোয়াতে তালিবানদের আক্রমন করে হটিয়ে দিলে, নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক একটি তথ্যচিত্র নির্মানের মাধ্যমে মালালার পরিচয় উন্মুক্ত করে দেন এবং তারপর তাকে নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া মহা হুল্লোড় শুরু করে। মালালার বাবা মেয়ের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১২ সালের অক্টোবরে তালেবান সন্ত্রাসী তাকে স্কুলে যাওয়ার পথে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। যদিও গুলি হবার পরপরই সিএনএনসহ সব পশ্চিমা মিডিয়া বলেছিল তাকে রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়েছে। তার সাথে আরো দুজন ছাত্রী গুলিবিদ্ধ হয়েছিল , যেহেতু তারা ব্লগ লিখত না এবং লক্ষ্যবস্তু ছিল না, এবং তাদের আঘাত মারাত্মক ছিল না, তাই তারা আলোচনায় নেই।

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তাকে গুলি করা হয়। তাকে ইনডিউসড বা কৃত্রিম কোমায় রেখে চিকিৎসা করা হয়। অক্টোবরের ১৭ তারিখ তার জ্ঞান ফেরে ইংল্যান্ডে, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। মার্চ থেকে সে স্কুলে যেতে শুরু করে। ২০১২ পর্যন্ত তার মুল ভুমিকা ছিল ব্লগ লেখা। যেখানে তার নিজের কথা ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা থাকতো। মজার ব্যাপার হলো এসবই নাকি সে হাতে লিখত তারপর একজন রিপোর্টার সেটা টাইপ করত। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এসব লেখার সবটুকু তার নিজের লেখা ছিল না।

এই ব্লগ ছাড়া নারী শিক্ষা নিয়ে তার তেমন কোনও বড় কাজ ছিল না। ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে এমন কি কাজ করল যার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে গেল?

আসুন তার কাজগুলি দেখি:

. সে ২০০৮ থেকে ব্লগ লেখে, নিজের উৎসাহে স্বপ্রণোদিত হয়ে নয়, বাবার নির্দেশে, এবং বিবিসির পরিকল্পনায়।

. ২০১২ তে নিজের নিরাপত্তার প্রতি মনোযোগী না হয়ে, ছদ্মনাম থেকে আত্মপ্রকাশ করার ফলে এবং মিডিয়াতে প্রচারণার কারনে তার পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যায়, তাকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়। তালেবানরা তাকে গুলি করে।

. ২০১৩ থেকে ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে মালালা ফান্ড নামে একটি তহবিল খোলে। সে, তার বাবা, এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত নারী সাংবাদিক সিজা শহিদ এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা। মালালার বাবা কিন্তু বার্মিংহামে পাকিস্তান কনসুলেটের শিক্ষা অ্যাটাচি। এর সিইও হলেন ক্লিনটনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ও বোনোর ওয়ান ক্যাম্পেইনের সাথে জড়িত সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা মেহান স্টোন। যার মূল কাজ বিপনণ। আর আছেন উপদেষ্টা হিসেবে সিএনএন এর সাবেক সাংবাদিক এসন জর্ডান ও আরেক জাতিসংঘ কর্মচারী পি জে কাজিক। এই মালালা তহবিল কাজ করে কেনিয়া, জর্ডান, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়াতে।

মালালা তহবিল খোলা হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরের ১১ তারিখে, সে গুলিবিদ্ধ হবার মাত্র দু্ইদিন পরে। মেহান স্মিথ একসময় গুগলে কাজ করতেন। এসএমএস করে ১০ ডলার পাঠানোর আবেদন করে এর কাজ শুরু হয়েছিল। বলা হয়েছিল এটা নাকি মালালার শেষ ইচ্ছা। কেমন একটা রহস্যময় ব্যাপার নয় কি? যার নামে ফান্ড সে তখনও কোমায়, বাঁচে বা মরে ঠিক নাই। তার মানে মালালার নিজের এই তহবিল খোলার বিষয়ে সামান্যই অবদান। কেবল শেষ ইচ্ছা প্রকাশ ছাড়া। ইচ্ছা কিন্তু ছিল মালালা ফাউন্ডেশন করার। হয়ে গেল ফান্ড।

. সে একটা বই লিখে ফেলে আই অ্যাম মালালা নামে, যার কো রাইটার ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব নামে একজন বৃটিশ সাংবাদিক। তার সব লেখাতেই কেন জানি সাথে আরেকজন থাকে। ব্লগ লিখত হাতে। টাইপ করত বিবিসির সাংবাদিক। বইটাও সঙ্গে লিখলেন ক্রিস্টিনা। প্রকাশিত হয় ৮ অক্টোবর ২০১৩ সালে। এই বইটিতে পাকিস্তান ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য আছে বলে অভিযোগ করে পাকিস্তানের প্রাইভেট স্কুল অ্যাসোসিয়েশন তাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত স্কুলগুলিতে এটি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।

. সে বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করতে থাকে এবং জাতিসংঘে বক্তৃতা দেয় ১২ জুলাই ২০১৩।

. সে নাইজেরিয়াতে বোকো হারামের বিরুদ্ধে কথা বলে।

. সে সিরিয়া সীমান্তে গিয়ে ক্যামেরার সামনে একটি রিফিউজি শিশুকে কোলে করে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়। যদিও গাজাতে অবরুদ্ধ ও নিহত শিশুদের বিষয়ে নিরব থাকে।

. সে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানে নারী শিক্ষার বিষয়ে বক্তব্য দেয়।

. এরই মধ্যে সে সিতারা এ জুরাক, ন্যাশনাল ইয়ুথ প্রাইজ, মাদার তেরেসা পদক, রোম পুরস্কার , সিমন দ্য বুভোয়া পদক, ডোটি স্ট্রিট অ্যাডভোকেসি পদক, ফ্রেড ও অ্যানি জারভিস পদক, গ্লোবাল লিডারশিপ পদক, ক্লিন্টন পদক, ডক্টরেট, হার্ভার্ড ফাউন্ডেশন পদক, ওপেক উন্নয়ন পদক , শাখারভ পদক সহ ছোট বড় ২৮ টি পদক, ডিগ্রি ও সম্মাননা পায়। এটা কি একটু অস্বাভাবিক নয় যে পৃথিবীর প্রায় সব পদক দেওয়ার সংস্থাগুলি গত এক বছরে মালালা ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পায়নি সারা পৃথিবীতে যাদের পদকের ক্ষেত্রগুলিতে যথেষ্ট অবদান আছে? পৃথিবীর ইতিহাসে মালালা ছাড়া আর কারও এক বছরে এত পুরস্কার পাবার কৃতিত্ব নেই। এজন্য তার নাম গিনেস বুকেও যেতে পারতো।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকার দিকে এবার চোখ বুলানো যাক:

জাতিসংঘকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে আবার আলাদা আলাদা করে এর অধীনে নানা রকম সংস্থাগুলিকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এটা কেমন করে হয়? যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সদস্য দেশগুলির টাকায় মানব সেবার জন্য, যেখানে পেশাদারি কাজই হচ্ছে মানবজাতির কল্যান তাকে যদি পুরষ্কৃত করা হয় তবে পৃথিবীর বহু হাসপাতালও কিন্তু এই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। এ যেন আপনি বাংলাদেশ সরকারকে একটা পুরস্কার দিলেন আবার একই পুরস্কার তার অধীনে সব মন্ত্রণালয়গুলিকেও দিলেন।

যে সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এই পুরস্কার পেয়েছে , গ্রামীন ব্যাংক ও মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছাড়া আর কারও সদর দফতর ইউরোপ বা আমেরিকার বাইরে নয়। মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতাও একজন ইউরোপিয়ান। তাই কেবল গ্রামীন ব্যাংকই একমাত্র বিশুদ্ধ কালো চামড়া প্রতিষ্ঠান।

এবার আসা যাক রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্ষমতাবানদের প্রসঙ্গে:

মেনাহেম বেগিন যিনি সরাসরি গণহত্যা ও বোমা হামলার মতো সন্ত্রাসী তৎপরতা করেছেন, তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আমেরিকান টেলিভিশনে, প্যালেস্টাইনে হোটেল ডেভিডে বোমা হামলা করার জন্য অহংকারের সাথে সন্ত্রাস নামক বস্তটিকে পৃথিবীব্যাপি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন।

ই পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, উইলসন ও থিওডোর রুজভেল্ট। এছাড়া যেসব বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসব পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই ইউরোপ ও আমেরিকার । ম্যান্ডেলা, সুকি, কিম দায়ে জং, বা পূর্ব তিমুরের হোসে রামোসে এদের মধ্যে সামান্য ব্য্যতিক্রম। ম্যান্ডেলার সঙ্গে তারা জুড়ে দিয়েছে ডি ক্লার্কের মতো চূড়ান্ত বর্ণবাদী এক হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টকে। শিমন পেরেজ, আইজ্যাক রবিন, আগ্রাসী ইসরায়েলীদের সঙ্গে চুক্তি করার পুরস্কার হিসেবে ইয়াসির আরাফাত এর সঙ্গে এই দুজনকেও দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার ।

মহাত্মা গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং এই তালিকাতে নেই। তালিকাতে নেই পাকিস্তানের আব্দুল সাত্তার ইদির মতো ব্যক্তিত্ব। আব্দুল সাত্তার ইদি এই পুরস্কার কখনওই পাবেন না কারন তিনি সমাজের সেবা করলেও তার সামাজিক পরিচয়ের প্রধান দিক তিনি একজন ধর্মপ্রান মুসলমান।

যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর মতো সংগঠন এই ‍পুরস্কার পায় তবে সার্ক বা আসিয়ান এই পুরস্কার বহু আগেই পাওয়া উচিত ছিল। এই পুরস্কারের বিবেচনা অনেকাংশেই রাজনৈতিক। পশ্চিমের মতবাদ, পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তির সাথে মতের মিল ও তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সাথে এই বিশ্ব শান্তি ও নোবেল শান্তি পুরস্কার নামক মুলাটি বিশেষভাবে জড়িত।

আবার মালালা প্রসঙ্গ:

মালালাকে এই পুরস্কার দেয়াতে আমি ব্যক্তিগতভাবে নারাজ নই। সে এই পুরস্কার পেতেই পারে। নোবেল কমিটি যাকে ইচ্ছা তাকে এই পুরস্কার দিতে পারেন। তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অভিনন্দন জানাই। তবে পশ্চিমের কাছে তার এত মূল্যের কারণ কি সেটা বুঝে স্বপরিচয়ে, স্বশিক্ষায়, স্বযোগ্যতায় নিজে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সে পারবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে। এখনও সে আশ্রিত। তার যা কিছু সবই পশ্চিমাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীল মানুষটির যা কথা সবটুকু তার নিজের নয়। খানিকটা তার মেন্টর বা যারা তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে তাদের দ্বারা প্রভাবিত, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

একজন নোবেল বিজয়ীর স্বতঃপ্রণোদিত কাজের কথা আমরা শুনতে চাই। মালালা যা করছে সবই তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে তার বাবা, বিবিসি, সিএনএন, মালালা ফান্ডের পরিচালকেরা, তার আত্মজীবনীর লেখিকা, প্রকাশনা সংস্থাসমূহ।

মালালা ১৭ বছরের তরুনী। গত দুই বছরেরও কম সময়ে সে যে সব কাজ করেছে তার অধিকাংশই তাকে সামনে রেখে একদল পশ্চিমা সাংবাদিক, ফান্ড ম্যানেজার, সমাজসেবা বা সিএসআর কর্মীদের কাজ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত তার সিজা সাইদ, মেহান এর মতো পেশাদার সমাজসেবীরা যারা সমাজসেবার জন্য মিলিয়ন ডলার বেতন নিয়ে থাকেন।

তাকে নিয়ে ব্যস্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলি, তার বই বিক্রিতে যার লেখক তিনি নিজে কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত পশ্চিমা মিডিয়া, কারণ তারা এটা দিয়ে তালিবান দমনের নামে দেশে দেশে ড্রোন হামলা ও সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপনকে নৈতিক সমর্থন যোগাতে পারে। ইরাক, আফগানিস্তান ও প্যালেস্টাইনে লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে না পারলেও তার দায় আক্রমণকারীদের ঘাড়ে চাপে না। এসব নিয়ে কেউ কথাও বলে না। মালালাও বলে না।

অথবা সে বলতে পারে না। বললে হয়তো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে পশ্চিমা বিশ্ব। মালালা নিজে থেকে এখনও কিছুই করতে পারে না। তাকে দিয়ে করানো হয়। মালালাকে নিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদ হয়, স্কুলে তাকে নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। পশ্চিমা শিশুরা তাকে সাহসী নারীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে মনে করে। লাখ লাখ মালালাকে রক্ষার জন্য ড্রোন হামলা, ইরাকে ও আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়।

অন্যদিকে গাজায় জাতিসংঘের স্কুলে ইসরায়েল রকেট মারলে সেটা হয়ে যায় আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ইসরায়েলের ন্যায্য অধিকার যার সমর্থনে বক্তব্য দেন নোবেল শান্তি মামা, বারাক ওবামা। বোমাবর্ষণের দৃশ্যকে আতশবাজির মতো উপভোগ করে ইসরায়েলিরা , তখন মালালা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন না। তবে তিনি বোকো হারামের বিরুদ্ধে বলার জন্য কেনিয়া ও নাইজেরিয়াতে ছুটে যান। কারন বোকো হলো ইসলামী মৌলবাদ।

মৌলবাদকে একচোখে দেখার এই নীতিকে যারা সমর্থন করবে , তারাই বিশ্ব শান্তি পুরস্কার পাবে। ইসরায়েল ধর্মরাষ্ট্র কিন্তু তাদের বোমা ধর্মনিরপেক্ষ। ড্রোন এর চোখে ২০০ এর বেশি বসতবাড়িকে মনে হয় ক্যান্টনমেন্ট, সেখানে বসবাসরত সাধারন নাগরিকদের মনে হয় সৈনিক। ইরাকের ৩০০০ স্কুল হয়ে যায় রাসায়নিক অস্ত্র বা উইপনস অব ম্যাস ডেস্ট্রাকশন এর মজুদখানা।

আমেরিকা যখন ইরাকে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার চক আমদানির ওপর বাধা দিচ্ছিল, রসিকতা করে একজন সাংবাদিক বলেছিলেন চক হচ্ছে ওয়েপন অব ম্যাস ইন্সট্রাকশন। এজন্যই একে এত ভয় আমেরিকার। নোবেল শান্তি পুরস্কারের গতিবিধি দেখলে মনে হয় একেও নাম দেবার সময় এসেছে , প্রাইজ অব ম্যাস ম্যানিপুলেশন।

লেখক: চিকিৎসক, টিভি ব্যক্তিত্ব।

ইমেইল: abdun.noor@gmail.com

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন