সাংবাদিকতা, সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
- প্রকাশের সময় : ০৬:১৬:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৩৫ বার পঠিত
দিনটা কখনো ভুলবো না। পশ্চিমের আকাশে লাল-হলুদ আভা। ডুবন্ত সূর্য। পাখিদের ঘরে ফেরার তাড়া। প্রকৃতিতে অস্থিরতা। যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এতদিন পরও সে বিকাল স্পষ্ট মনে করতে পারি। বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। এরপর আর কোনোদিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি।
মহৎ আনন্দ কিংবা তীব্র বেদনায় মা-বাবাকে খুঁজি। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের এমন কিছু সময় আসে যা তার জীবনের বাকি সবসময় থেকে আলাদা। বহু বহু বছর পরও মুহূর্তেই সে স্মরণ করতে পারে সেই সময়। কোনো কসরত ছাড়াই। প্রিয় পত্রিকার জন্মদিনে লিখতে বসে কেন প্রয়াত মায়ের কথা মনে পড়লো? সে কথায় একটু পরে আসছি। প্রিয় পাঠক, ২৬ বছর পূর্ণ করে আজ সাতাইশে পা দিলো আপনাদের প্রিয় মানবজমিন। এমনিতে গেল কয়েক বছরে মানবজমিনের প্রতিটা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেই কিছু না কিছু লিখি। জানি কিছু হয় না। তবুও এর প্রতিটা লেখাই আমার কাছে স্পেশাল। এবার কয়েকদিন ধরে লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই লেখা এগুচ্ছে না!
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে ‘অনাগ্রহের’ সময় অতিক্রম করছে। পত্রিকায় কী লিখছে, টিভিতে কী বলছে তা নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। যদিও এক সময় মনে করা হতো, এখনকার মানুষ নিউজ খায়, পান করে। চা দোকানে রাজনীতির আড্ডায় মশগুল থাকতো মানুষ। কাটাছেঁড়া চলতো খবরের সত্য-মিথ্যা নিয়ে। ছোটবেলায় বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার জন্য মানুষের ভিড় আজও স্মৃতিতে স্পষ্ট। একটা প্রজন্মে বহু মানুষের নাম যে সাদ্দাম হোসেন রাখা হয়েছিল এতে মিডিয়ার অবদান কি কম? এমনিতে ঢাকায় মিডিয়ার সংখ্যা বাড়-বাড়ন্ত। চল্লিশের বেশি টিভি চ্যানেল। অসংখ্য অনলাইন। শত শত পত্রিকা। পৃথিবীর আর কোনো শহর থেকে কি এত পত্রিকা বের হয়! কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন, বিপুল সংখ্যক মিডিয়া মিডিয়ার গুরুত্বই কমিয়ে দিয়েছে। যদিও সংখ্যা অনেক হলেও তাদের কণ্ঠস্বর একই। এ প্রসঙ্গে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি লেখা থেকে কিছুটা উল্লেখ করতে চাই, ‘‘অসংখ্য পত্রিকার অস্তিত্ব মানে অনেক পাঠক, সংবাদের জন্য অনেক সূত্র এবং নিজ নিজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণির প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষের তথ্যের অবাধ প্রবাহে অংশগ্রহণ। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের ভাষায়, আসলেই কি ‘হাজার ফুল’ ফুটেছিল, নাকি বিষয়টা এরকম, অনেকগুলো গাছ থেকে একই অথবা একই ধরনের ‘ফুল’ ফুটেছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে। এই রূপকের মাঝেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের আজকের গণমাধ্যমের প্রকৃত অবস্থা।’’
পুরনো একটি লেখায় ডেকার্টেকে স্মরণ করেছিলাম। তার বিখ্যাত উক্তি-‘আই থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম’। আমি চিন্তা করতে পারি সেজন্যই আমি আছি। অসংখ্য সংখ্যার অভিন্ন কণ্ঠস্বরের এই সময়ে নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতাই অন্য অনেক সংবাদমাধ্যম থেকে মানবজমিনকে আলাদা করে দিয়েছে। যে চিন্তার মূলে মানুষ ও দেশ। কোনো দল বা ব্যক্তি নয়। পাঠকের কাছে মাপ চেয়ে নিচ্ছি এ লেখায় কখনো কখনো নিজের কথা এসে যাচ্ছে বলে। ১৯ বছর ধরে এ পেশায় আছি। এর বেশির ভাগ সময়ই মানবজমিনে। মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর সঙ্গে অসংখ্য মিটিংয়ে বসেছি। মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী) যে কথাটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বলেন, মানবজমিন কোনো দলের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়। সব মানুষের, সব মতের। সাদাকে সাদা, কালোকে কালা বলাই আমাদের একমাত্র সম্পাদকীয় নীতি। মানবজমিন যে তা অনুসরণের চেষ্টা করেছে আমাদের পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন। কারও প্রতি আমাদের রাগ বা বিরাগও নেই।
কেউ কেউ বলে থাকেন এটা ‘বাতাবি লেবু’ সাংবাদিকতার যুগ। সরি পাঠক, আমি একজন কৃষকের সন্তান। বাতাবি লেবু চাষও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা মূলত উন্নয়ন প্রচারের নামে মোসাহেবি সাংবাদিকতা বুঝাতেই বলা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জীবনে একটি বিশেষ সময়ের কথা বলছিলাম। যে সময়ে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইতিহাসে পদচিহ্ন আঁকার চেষ্টা করে। সংবাদপত্রের এক একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে বলতে পারি, কয়েক বছরে মানবজমিন সে বিশেষ সময় অতিক্রম করেছে। আমাদের প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। নিজেদের কাজের প্রতি আমরা ছিলাম সৎ। মানুষ হিসেবে ত্রুটি তো ছিলই।
এই তো সেদিন কাঁঠালবাগান দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি পথরোধ করে দাঁড়ালেন। শুরুতে কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। জানালেন, মানবজমিনের নিয়মিত পাঠক। ফেসবুক, ইউটিউবেও আমাদের দেখেন। হৃদয় থেকে দোয়ার কথা জানালেন মানবজমিনের জন্য। যদিও তার দৃঢ় ধারণা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কিংবা সোন্দ্রম গ্রামের তরুণ যার সঙ্গেই কথা বলেছি তারা এটা উল্লেখ করেছেন যে, বিশেষত গেল এক বছরে মানবজমিনের সাংবাদিকতার চর্চা ইতিহাসে অবশ্যই লেখা থাকবে। তাই বলে আমাদের সমালোচনা যে নেই তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ আমাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগও তুলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক, উপস্থাপক মেহেদী হাসানের একটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। টিভি পর্দায় ঝড় তোলা এই উপস্থাপক বলেন, ‘সাংবাদিকের গণতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত থাকা উচিত।’
সাংবাদিকের কাজ কী? সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম কাদিরের বরাতে খ্যাতিমান সাংবাদিক এলান হুইটলির এ সংক্রান্ত জবাব আগের এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। ২০০৪ সালে পাঁচ দিনের জন্য বাংলাদেশে আসেন তখনকার রয়টার্সের এশিয়ার চিফ ইকোনমিক করেসপনডেন্ট এলান হুইটলি। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, স্যার ফজলে হাসান আবেদের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। এলান বলেছিলেন, ইউনূস খোলামেলা ও প্রাণবন্ত। আবেদ মিতভাষী, বিনীত। দু’জনেই মহীয়ান। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের জীবনকে তারা অর্থময় করছেন।’ কথা প্রসঙ্গে এলান উল্লেখ করেছিলেন, ‘একটি গ্লাসের অর্ধেক পূর্ণ, অর্ধেক খালি। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে খালি অর্ধেক নিয়ে কথা বলা, আঘাত করা। না হয় কাজ থেমে যাবে।’
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস কখনো সরল পথে এগোয়নি। এরশাদ জমানায় ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য’ লিখে বিপাকে পড়েছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী। বন্ধ হয়ে যায় খবরের কাগজ। তবে মুক্তি মিলে উচ্চ আদালতে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ খোলে। প্রয়াত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান থাকার সময় বাতিল করে দেন স্বাধীন সাংবাদিকতাবিরোধী কালাকানুন। ১৯৯১-২০০৬ একটি ধারা। যা অনেকটাই স্বাধীন। তারপর নতুন যুগ। সেটি এখন অনেক বিস্তৃত। গণতন্ত্র যেমন, সাংবাদিকতাও তেমন, সেটি কি অস্বীকার করার জো আছে। খালি গ্লাসের দিকে মনোযোগ দিয়েছে । চেষ্টা করেছে প্রশ্ন করার। সেটি কঠিন, কখনো কখনো অসম্ভব। আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম ছিল- ‘বাচ্চারা কেউ শব্দ কোরো না, কর্তাকে কেউ প্রশ্ন কোরো না’। পাঠকমাত্রই বুঝেন বাংলাদেশে এখন নতুন পরিস্থিতি। স্বাধীন সাংবাদিকতা আরও কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে এই সময়ে মানবজমিন কী করবে? শেষ করছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা দিয়ে, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ সূত্র : মানবজমিন।