নিউইয়র্ক ০৪:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

চিকিৎসায় এআই : আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৩:০২:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • / ১৮১ বার পঠিত

সংগৃহীত ছবি

হককথা ডেস্ক : অন্য সব ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবদান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ওষুধ গবেষণা এবং রোগ নির্ণয়ে এআইভিত্তিক টুলসের ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে দিয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী। এআই রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা, চিকিৎসাপ্রক্রিয়া এবং চিকিৎসা গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিকিৎসার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। তবে এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে কিছু সম্ভাব্য ঝুঁকিও রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, এআইচালিত সফটওয়্যারগুলোর ভুল হতে পারে, যা রোগীদের জন্য হতে পারে ক্ষতিকারক। এ ছাড়াও এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে নৈতিক বিষয়গুলো জড়িত রয়েছে, যেমন—ডাটা গোপনীয়তা এবং বৈষম্য।

যেভাবে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে এআই

মেশিন লার্নিং মানুষের চেয়ে বহু গুণ নিখুঁতভাবে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম। রোগীর শরীরে কী হচ্ছে সেটা জানার জন্য ডাক্তাররা নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন, যেমন—এক্স-রে, এমআরআই বা নানাবিধ রক্ত পরীক্ষা।

এসব পরীক্ষার রিপোর্টে থাকা ডাটার সঙ্গে স্বাভাবিক দেহের তথ্যগুলো মিলিয়ে তাঁরা চেষ্টা করেন দেহের ঠিক কোন স্থানে কী সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা বের করার। মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে এআই এসব ডাটা শুধু যে দ্রুতই প্রসেস করতে পারে তা-ই নয়, সূক্ষ্ম সমস্যাগুলো ধরতে পারে আরো দ্রুত। যেমন—সম্ভাব্য ক্যান্সার রোগীর টিস্যু বায়োপসি করার সময় কোষ কালচারের ছবি দেখে খুব সহজেই এআই বলে দিতে পারে কোন কোষগুলো ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে, যেটা বেশির ভাগ মানুষের চোখেই ধরা পড়বে না।

সব সময় রোগ শনাক্তের জন্য ডায়াগনস্টিক টেস্টের প্রয়োজনও নেই।

রোগীর উপসর্গ, তার পারিবারিক ইতিহাস, বয়স, ওজন ও অন্যান্য ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করেই এআই সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু উপসর্গ বিশ্লেষণ করেই হৃদরোগ বা মৃগী রোগের মতো জটিল রোগও এআই মডেলগুলো ধরে ফেলতে পেরেছে। সাধারণত একজন ডাক্তারের পক্ষে তথ্যের এরূপ গভীর বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না।

ব্যবহৃত হচ্ছে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারেও

রোবটের মাধ্যমে সার্জারি নিয়ে গবেষণা চলছে বহু দশক ধরে। এর মধ্যে আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে রোবটিক হার্ট সার্জারি।

প্রতিবার নিখুঁতভাবে একই অপারেশন করতে পারে রোবট, যেখানে সবচেয়ে সেরা সার্জনেরও হতে পারে ছোট থেকে বড় ভুল। তবে এখনো সরাসরি এআই নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে সার্জারি বড় পরিসরে শুরু হয়নি। ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ঠিক কোথায় কী ধরনের সার্জারি প্রয়োজন, সেটার সিদ্ধান্ত এআই দ্রুতই নিয়ে রোবটের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারও করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে রোগীদের ভালো সার্জনের জন্য অপেক্ষাও করতে হবে না।
প্রত্যেক রোগীর মেডিক্যাল ইতিহাসও চিকিৎসার জন্য জরুরি। বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তারদের পক্ষে রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, জীবনযাপনের ধরন ও বাসস্থানের মতো প্রয়োজনীয় তথ্য আমলে বিবেচনা করে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সম্ভব হয় না। এআই খুব দ্রুতই বড়সড় ডাটাবেইস থেকে সব ধরনের তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া উচিত, সেটা বলে দিতে পারে। এ ছাড়াও রোগীর সব তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কী কী সম্ভাব্য রোগ হতে পারে সেটার রিপোর্টও তৈরি করতে সক্ষম এআই। সে অনুযায়ী আগেভাগেই রোগীদের সতর্ক করাও সম্ভব।

মানসিক সমস্যা নির্ণয় ও কাউন্সেলিং

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবটগুলো মানসিক সমস্যার কাউন্সেলিংয়ের জন্য চমৎকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এআই চ্যাটবটভিত্তিক মানসিক কাউন্সেলরদের ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে এরই মধ্যে কাজ করছে, কিছু কিছু সেবা পরীক্ষামূলকভাবে এরই মধ্যে চালুও হয়েছে। এআইয়ের নিজস্ব আবেগ না থাকায়, নিজের কোনো বায়াস ছাড়াই সমস্যাগুলো শুনে সেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। এ ছাড়াও সর্বশেষ মানসিক গবেষণার জার্নালগুলো দিয়ে এআই সব সময় আপডেট থাকায় সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে আরো নিখুঁতভাবে। রোগীরাও বলছে, মানুষের চেয়ে কৃত্রিম থেরাপিস্টদের সঙ্গে নিজেদের গোপন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে তারা আরো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা

স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চালনা অত্যন্ত জটিল কাজ। একই সঙ্গে হাজারো সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয় পরিচালকদের, ভুলেরও থাকে না সুযোগ। এই কাজটি এআই দক্ষতার সঙ্গে করতে সক্ষম, কেননা অনেক ডাটা নিয়ে কাজ করার জন্যই সিস্টেমগুলো তৈরি। এ ছাড়াও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেটার পূর্বাভাসও এআই দিতে সক্ষম। সে অনুয়ায়ী প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালগুলোর সেবার মানও ধরে রাখা যায় সহজেই।

নানাবিধ মেডিক্যাল গবেষণায় এআই

নতুন সব ওষুধ আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন বর্তমান রোগ ও সেটির চিকিৎসার তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ। সেই কাজে মেশিন লার্নিং খুবই কার্যকর। একই গবেষণার জন্য যেখানে নতুন ওষুধ তৈরির উপায় বের করা, পরিশোধন ও পরীক্ষার জন্য লেগে যেত কয়েক দশক; সেটাকে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কয়েক বছরে নামিয়ে আনা যাচ্ছে। তার বড় উদাহরণ কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক। এ ছাড়াও নানাবিধ রোগ ছড়িয়ে পড়া ও মহামারির ঐতিহাসিক তথ্য ও বর্তমান মানবসভ্যতার প্রসার এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের তথ্য নিয়ে গবেষণা করে ভবিষ্যতের মহামারির পূর্বাভাসও এআই দিতে সক্ষম। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে রোগ বিস্তারের আগেই সেটা করা যাবে প্রতিরোধ।

বহুভাবেই চিকিৎসায় এআইয়ের ব্যবহার করা গেলেও, সেটি ব্যবহারের নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়াও অনেক বিশেষজ্ঞই এআইয়ের ওপর এর ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে দিতে একেবারেই নারাজ। ফলে কাটছে না বিতর্ক।

ডাটাসেটে বৈষম্য

এআইয়ের নিজস্ব কোনো বায়াস নেই। তবে সেটা ট্রেইন করার জন্য যে ডাটাসেট ব্যবহার করা হয়, সেটা যদি গোড়া থেকেই বৈষম্যপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে এআইয়ের অ্যালগরিদমেও সৃষ্টি হবে বৈষম্যে। যথাযথ ডাটাসেট তৈরি করা এবং সেটার মধ্যে বৈষম্য আছে কি না সেটা পরীক্ষা করা অতীব জরুরি। যেমন—যদি রক্তের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সুস্থ দেহে কতটুকু থাকে, সেই ডাটাসেটে পুরুষের পাশপাশি নারীদের তথ্যও না দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এআই প্রত্যেক নারীকেই অসুস্থ বিবেচনা করবে, কেননা নারীদের স্বাভাবিকভাবেই হিমোগ্লোবিন পুরুষদের চেয়ে কম থাকে। আবার অ্যালগরিদমকে যদি দ্রুত ডাটা প্রসেস করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়, তাহলে হয়তো সেটি অ্যাকুরেসি কমিয়ে প্রসেস করবে।

স্বচ্ছতার অভাব

মেশিন লার্নিংয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—ডাটাসেট দিয়ে এআই ট্রেনিং করার পর সেটা কিভাবে কাজ করে, সেটা কেউই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবে না। এআইয়ের তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের ভেতরের যুক্তিতর্ক সরাসরি দেখার কোনো উপায়ও নেই। তাই সৃষ্ট ফলাফল অনেকবার ম্যানুয়ালভাবে পরীক্ষা করে তবেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরে নিতে হয়।

গোপনীয়তা নিয়ে সন্দেহ

রোগীদের তথ্যকে সব সময়ই ধরা হয় অতি গোপনীয়। সেগুলো ব্যবহার করে বড়সড় ডাটাসেট তৈরি করা, সেটা ব্যবহার করে এআই ট্রেইন করাকে এখনো গোপনীয়তার ওপর আঘাত মনে করছেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। মেডিক্যাল এআই এবং তার ডাটার গোপনীয়তার জন্য নতুন নীতিমালা এখনই তৈরি করা জরুরি।

চাকরির বাজারে বড় প্রভাব

যদি রোগ নির্ণয়, হাসপাতাল পরিচালনা থেকে সার্জারি ও মানসিক কাউন্সেলিংও এআইয়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ দ্রুতই চাকরিচ্যুত হবে। অন্যান্য চাকরিক্ষেত্রের মতো মেডিক্যাল ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন বহু ডাক্তার-গবেষক-কর্মচারী। যতই রোগীদের সেবাদানে এআই এগিয়ে থাকুক, এভাবে কয়েক কোটি চাকরির বাজার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।

সেবায় বৈষম্য

নতুন সব প্রযুক্তিই শুরুতে ব্যয়বহুল থাকে। এআইভিত্তিক মেডিক্যাল সেবা শুরুতে শুধু ধনবানরাই ব্যবহার করতে পারবে, সৃষ্টি হবে সামাজিক বৈষম্য। অন্তত চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন বৈষম্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। বর্তমানে অনেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানই এআইভিত্তিক সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকছে এ কারণেই।

সামগ্রিকভাবে চিকিৎসায় এআইয়ের ব্যবহার একটি উদীয়মান ক্ষেত্র, যা চিকিৎসার মান উন্নত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এই ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র : কালের কণ্ঠ

হককথা/নাছরিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

চিকিৎসায় এআই : আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?

প্রকাশের সময় : ০৩:০২:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

হককথা ডেস্ক : অন্য সব ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবদান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ওষুধ গবেষণা এবং রোগ নির্ণয়ে এআইভিত্তিক টুলসের ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে দিয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী। এআই রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা, চিকিৎসাপ্রক্রিয়া এবং চিকিৎসা গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিকিৎসার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। তবে এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে কিছু সম্ভাব্য ঝুঁকিও রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, এআইচালিত সফটওয়্যারগুলোর ভুল হতে পারে, যা রোগীদের জন্য হতে পারে ক্ষতিকারক। এ ছাড়াও এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে নৈতিক বিষয়গুলো জড়িত রয়েছে, যেমন—ডাটা গোপনীয়তা এবং বৈষম্য।

যেভাবে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে এআই

মেশিন লার্নিং মানুষের চেয়ে বহু গুণ নিখুঁতভাবে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম। রোগীর শরীরে কী হচ্ছে সেটা জানার জন্য ডাক্তাররা নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন, যেমন—এক্স-রে, এমআরআই বা নানাবিধ রক্ত পরীক্ষা।

এসব পরীক্ষার রিপোর্টে থাকা ডাটার সঙ্গে স্বাভাবিক দেহের তথ্যগুলো মিলিয়ে তাঁরা চেষ্টা করেন দেহের ঠিক কোন স্থানে কী সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা বের করার। মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে এআই এসব ডাটা শুধু যে দ্রুতই প্রসেস করতে পারে তা-ই নয়, সূক্ষ্ম সমস্যাগুলো ধরতে পারে আরো দ্রুত। যেমন—সম্ভাব্য ক্যান্সার রোগীর টিস্যু বায়োপসি করার সময় কোষ কালচারের ছবি দেখে খুব সহজেই এআই বলে দিতে পারে কোন কোষগুলো ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে, যেটা বেশির ভাগ মানুষের চোখেই ধরা পড়বে না।

সব সময় রোগ শনাক্তের জন্য ডায়াগনস্টিক টেস্টের প্রয়োজনও নেই।

রোগীর উপসর্গ, তার পারিবারিক ইতিহাস, বয়স, ওজন ও অন্যান্য ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করেই এআই সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু উপসর্গ বিশ্লেষণ করেই হৃদরোগ বা মৃগী রোগের মতো জটিল রোগও এআই মডেলগুলো ধরে ফেলতে পেরেছে। সাধারণত একজন ডাক্তারের পক্ষে তথ্যের এরূপ গভীর বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না।

ব্যবহৃত হচ্ছে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারেও

রোবটের মাধ্যমে সার্জারি নিয়ে গবেষণা চলছে বহু দশক ধরে। এর মধ্যে আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে রোবটিক হার্ট সার্জারি।

প্রতিবার নিখুঁতভাবে একই অপারেশন করতে পারে রোবট, যেখানে সবচেয়ে সেরা সার্জনেরও হতে পারে ছোট থেকে বড় ভুল। তবে এখনো সরাসরি এআই নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে সার্জারি বড় পরিসরে শুরু হয়নি। ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ঠিক কোথায় কী ধরনের সার্জারি প্রয়োজন, সেটার সিদ্ধান্ত এআই দ্রুতই নিয়ে রোবটের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারও করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে রোগীদের ভালো সার্জনের জন্য অপেক্ষাও করতে হবে না।
প্রত্যেক রোগীর মেডিক্যাল ইতিহাসও চিকিৎসার জন্য জরুরি। বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তারদের পক্ষে রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, জীবনযাপনের ধরন ও বাসস্থানের মতো প্রয়োজনীয় তথ্য আমলে বিবেচনা করে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সম্ভব হয় না। এআই খুব দ্রুতই বড়সড় ডাটাবেইস থেকে সব ধরনের তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া উচিত, সেটা বলে দিতে পারে। এ ছাড়াও রোগীর সব তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কী কী সম্ভাব্য রোগ হতে পারে সেটার রিপোর্টও তৈরি করতে সক্ষম এআই। সে অনুযায়ী আগেভাগেই রোগীদের সতর্ক করাও সম্ভব।

মানসিক সমস্যা নির্ণয় ও কাউন্সেলিং

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবটগুলো মানসিক সমস্যার কাউন্সেলিংয়ের জন্য চমৎকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এআই চ্যাটবটভিত্তিক মানসিক কাউন্সেলরদের ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে এরই মধ্যে কাজ করছে, কিছু কিছু সেবা পরীক্ষামূলকভাবে এরই মধ্যে চালুও হয়েছে। এআইয়ের নিজস্ব আবেগ না থাকায়, নিজের কোনো বায়াস ছাড়াই সমস্যাগুলো শুনে সেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। এ ছাড়াও সর্বশেষ মানসিক গবেষণার জার্নালগুলো দিয়ে এআই সব সময় আপডেট থাকায় সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে আরো নিখুঁতভাবে। রোগীরাও বলছে, মানুষের চেয়ে কৃত্রিম থেরাপিস্টদের সঙ্গে নিজেদের গোপন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে তারা আরো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা

স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চালনা অত্যন্ত জটিল কাজ। একই সঙ্গে হাজারো সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয় পরিচালকদের, ভুলেরও থাকে না সুযোগ। এই কাজটি এআই দক্ষতার সঙ্গে করতে সক্ষম, কেননা অনেক ডাটা নিয়ে কাজ করার জন্যই সিস্টেমগুলো তৈরি। এ ছাড়াও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেটার পূর্বাভাসও এআই দিতে সক্ষম। সে অনুয়ায়ী প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালগুলোর সেবার মানও ধরে রাখা যায় সহজেই।

নানাবিধ মেডিক্যাল গবেষণায় এআই

নতুন সব ওষুধ আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন বর্তমান রোগ ও সেটির চিকিৎসার তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ। সেই কাজে মেশিন লার্নিং খুবই কার্যকর। একই গবেষণার জন্য যেখানে নতুন ওষুধ তৈরির উপায় বের করা, পরিশোধন ও পরীক্ষার জন্য লেগে যেত কয়েক দশক; সেটাকে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কয়েক বছরে নামিয়ে আনা যাচ্ছে। তার বড় উদাহরণ কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক। এ ছাড়াও নানাবিধ রোগ ছড়িয়ে পড়া ও মহামারির ঐতিহাসিক তথ্য ও বর্তমান মানবসভ্যতার প্রসার এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের তথ্য নিয়ে গবেষণা করে ভবিষ্যতের মহামারির পূর্বাভাসও এআই দিতে সক্ষম। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে রোগ বিস্তারের আগেই সেটা করা যাবে প্রতিরোধ।

বহুভাবেই চিকিৎসায় এআইয়ের ব্যবহার করা গেলেও, সেটি ব্যবহারের নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়াও অনেক বিশেষজ্ঞই এআইয়ের ওপর এর ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে দিতে একেবারেই নারাজ। ফলে কাটছে না বিতর্ক।

ডাটাসেটে বৈষম্য

এআইয়ের নিজস্ব কোনো বায়াস নেই। তবে সেটা ট্রেইন করার জন্য যে ডাটাসেট ব্যবহার করা হয়, সেটা যদি গোড়া থেকেই বৈষম্যপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে এআইয়ের অ্যালগরিদমেও সৃষ্টি হবে বৈষম্যে। যথাযথ ডাটাসেট তৈরি করা এবং সেটার মধ্যে বৈষম্য আছে কি না সেটা পরীক্ষা করা অতীব জরুরি। যেমন—যদি রক্তের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সুস্থ দেহে কতটুকু থাকে, সেই ডাটাসেটে পুরুষের পাশপাশি নারীদের তথ্যও না দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এআই প্রত্যেক নারীকেই অসুস্থ বিবেচনা করবে, কেননা নারীদের স্বাভাবিকভাবেই হিমোগ্লোবিন পুরুষদের চেয়ে কম থাকে। আবার অ্যালগরিদমকে যদি দ্রুত ডাটা প্রসেস করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়, তাহলে হয়তো সেটি অ্যাকুরেসি কমিয়ে প্রসেস করবে।

স্বচ্ছতার অভাব

মেশিন লার্নিংয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—ডাটাসেট দিয়ে এআই ট্রেনিং করার পর সেটা কিভাবে কাজ করে, সেটা কেউই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবে না। এআইয়ের তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের ভেতরের যুক্তিতর্ক সরাসরি দেখার কোনো উপায়ও নেই। তাই সৃষ্ট ফলাফল অনেকবার ম্যানুয়ালভাবে পরীক্ষা করে তবেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরে নিতে হয়।

গোপনীয়তা নিয়ে সন্দেহ

রোগীদের তথ্যকে সব সময়ই ধরা হয় অতি গোপনীয়। সেগুলো ব্যবহার করে বড়সড় ডাটাসেট তৈরি করা, সেটা ব্যবহার করে এআই ট্রেইন করাকে এখনো গোপনীয়তার ওপর আঘাত মনে করছেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। মেডিক্যাল এআই এবং তার ডাটার গোপনীয়তার জন্য নতুন নীতিমালা এখনই তৈরি করা জরুরি।

চাকরির বাজারে বড় প্রভাব

যদি রোগ নির্ণয়, হাসপাতাল পরিচালনা থেকে সার্জারি ও মানসিক কাউন্সেলিংও এআইয়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ দ্রুতই চাকরিচ্যুত হবে। অন্যান্য চাকরিক্ষেত্রের মতো মেডিক্যাল ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন বহু ডাক্তার-গবেষক-কর্মচারী। যতই রোগীদের সেবাদানে এআই এগিয়ে থাকুক, এভাবে কয়েক কোটি চাকরির বাজার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।

সেবায় বৈষম্য

নতুন সব প্রযুক্তিই শুরুতে ব্যয়বহুল থাকে। এআইভিত্তিক মেডিক্যাল সেবা শুরুতে শুধু ধনবানরাই ব্যবহার করতে পারবে, সৃষ্টি হবে সামাজিক বৈষম্য। অন্তত চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন বৈষম্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। বর্তমানে অনেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানই এআইভিত্তিক সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকছে এ কারণেই।

সামগ্রিকভাবে চিকিৎসায় এআইয়ের ব্যবহার একটি উদীয়মান ক্ষেত্র, যা চিকিৎসার মান উন্নত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এআইয়ের ব্যবহারের সঙ্গে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এই ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র : কালের কণ্ঠ

হককথা/নাছরিন