লোহিত সাগরে সৌদিকে কেন পাশে পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র
- প্রকাশের সময় : ১০:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৬২ বার পঠিত
বেশি দিন আগের কথা নয়। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো যৌথ অভিযানকে সৌদি আরব সানন্দে সমর্থন জানাত। এক দশকে রিয়াদ হুতিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন লোহিতসাগরে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে হুতিদের অবস্থান লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে তখন সৌদি আরবের অবস্থান অনেকটাই ম্রিয়মান। হুতিদের সঙ্গে সৌদির বর্তমানে অস্ত্রবিরতি চলছে। এমন কোনো পদক্ষেপ রিয়াদ নিতে আগ্রহী নয় যা দুর্বল শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে পারে। লোহিতসাগরে উত্তেজনা বাড়ছে। কিন্তু সৌদি আরব নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। দীর্ঘমেয়াদে এই কৌশল কি কাজে আসবে, প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক।
গাজায় ইসরাইলের হামলার উত্তাপ গিয়ে পৌঁছেছে লোহিতসাগরে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুতি বিদ্রোহীরা বাব আল মানদিব প্রণালী দিয়ে ইসরাইল ও পশ্চিমা জাহাজ চলাচল আটকানোর লক্ষ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া শুরু করে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এটা চলেছে তবে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক শিপিং রুট ঘুরিয়ে আফ্রিকার পশ্চিম পাশ ঘুরে কেপ অব গুড হোপ (উত্তামাশা অন্তরিপ) হয়ে পূর্বদিকে আসতে হয়। পশ্চিমা দেশগুলো নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। ১২ জানুয়ারি ও তার পরদিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতিদের ওপর দুই দফা সামরিক হামলা চালায়। পালটা জবাবে ১৫ জানুয়ারি হুতিরা লোহিতসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন কনটেনার লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়ে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি এই আক্রমণের কারণ বলে হুতিরা দাবি করে। আড়াই মাসে তারা প্রায় ৩০টি হামলা করে এতে অন্তত ৫০টি দেশের নৌযান আক্রান্ত হয়। যদিও হামলায় জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয় না। তবে যে আতঙ্ক তৈরি হয় তার ফলে শিপিং কোম্পানিগুলো রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে বাড়ছে জ্বালানি থেকে বিমা পর্যন্ত বিভিন্ন রকম খরচ। বৈশ্বিক জাহাজ চলাচলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই প্রণালী দিয়ে হয়। এই পথ বন্ধ হওয়ার অর্থ সুয়েজ খাল পূর্ব যুগে ফিরে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে যারা গাজার লড়াই আশপাশে ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের চাপে রাখার কথা বলেন। তিনি মূলত হুতিদের ইঙ্গিত করে এটা বলেন। বাস্তবতা হলো এটি করার ক্ষমতা উপসাগরীয় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের নাই। তারা এ নিয়ে বেশি আগ্রহও দেখায় নাই। হুতিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলছে সৌদি আরবের। ওয়াশিংটন রিয়াদকে ঐ আলোচনা আপাতত রেখে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নিতে বলেছে। কিন্তু রিয়াদ এতে সাড়া দেয়নি। মধ্য জানুয়ারিতে ইয়েমেনে হুতি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলার পর সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া ছিল নিছক আনুষ্ঠানিক, কেবলমাত্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান ছিল এতে।
২০১৯ সালে সৌদি আরবের আরামকো তেলক্ষেত্রে ব্যাপক হামলা হয়। হুতিরা ঐ হামলার দায় স্বীকার করেছিল। তাত্ক্ষণিকভাবে সৌদির তেল উত্পাদন অর্ধেকে নেমে যায়। কেবল তেল উত্পাদনই নয় সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপরও ছায়া পড়ে। রিয়াদ অনুধাবন করে ওয়াশিংটন যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না। সৌদি পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনে ঐ ঘটনা। এরপর থেকে আঞ্চলিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা শুরু করে।
হুতিদের নেপথ্য শক্তি ইরানকে হলেও সৌদি আরব থেকে সেই ইরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে চীনের মধ্যস্থতায় ঐ যোগাযোগ শুরুর পর তা এখনো অব্যাহত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য আক্রমণের একদিন আগেও সৌদি আরব ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে কথা হয়েছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা, লোহিতসাগরে উত্তেজনা সেটা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হতে পারে। জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক সংস্কার এই ভিশনের অন্যতম লক্ষ্য। ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্য এটা নয় যে লোহিতসাগরে উত্তেজনা তৈরি হবে না বরং এটি বৃহত্তর পরিসরে আঞ্চলিক সহযোগিতা বজায় রাখার সহায়ক হবে। এই কৌশলে কাজও হচ্ছে। আলোচনা শুরুর পর থেকেই হুতিরা সৌদি আরব লক্ষ্য করে আক্রমণ বন্ধ রেখেছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েনের দীর্ঘ ইতিহাসের কথা মাথায় রেখেই মূলত সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন হুতিবিরোধী জোটে যোগ দেয়নি। রাজতন্ত্র শাসিত দেশটির এই মুহূর্তে প্রধান লক্ষ্য নিজেকে রক্ষা করা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ভারতীয় নৌবাহিনীর টহলে কিছু জাহাজ লোহিতসাগরে চলাচল করছে। এরই মধ্যে সবশেষ একটি ব্রিটিশ তেল ট্যাংকার লক্ষ্য করে হুতিরা মিসাইল ছুঁড়েছে। যদিও এতে কোনো হতাহত হয়নি বা মারলিন লুয়ান্ডা নামের ঐ ট্যাংকারের ব্যাপক ক্ষতি হয়নি কিন্তু এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে লোহিত আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য এখনো নিরাপদ নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও স্বীকার করেছেন সামরিক অভিযান হুতিদের বন্ধ করতে পারেনি। ওয়াশিংটনে ১৮ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি একথা বলেন। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক।