হামাস ইসরায়েলের সৃষ্টি- এই দাবি কতটা সত্যি
- প্রকাশের সময় : ০২:৩২:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৯১ বার পঠিত
যেসব সংগঠন ইসলামী আন্দোলন করছে, তাদের বিরুদ্ধে শত্রুর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখার অভিযোগ একেবারে নতুন কিছু নয়। এই অভিযোগগুলো ছড়ানোর মাধ্যমে সাধারণত তাদের বিরোধীরা কিছু সুবিধা পায়। এমনকি তাদের জনপ্রিয়তা বা তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করতেও এসব অভিযোগ কাজে আসে। অনেক সশস্ত্র আন্দোলনের গোপন ইতিহাসও এ ধরনের অভিযোগের পক্ষে আগ্রহ তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসলামিক রেসিসট্যান্স মুভমেন্ট বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন শুরুতে একটি ইসরায়েলি প্রকল্প ছিল।
এই দাবিটি বিভিন্ন সময়ে মানুষের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ইসরায়েলে হামলা এবং পরবর্তীতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল ও বিমান হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর এই দাবিটি আবার সামনে এসেছে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের সদস্যরা দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ইসরায়েলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা, এই অভিযোগকে অসঙ্গত বলে দাবি করেছেন।
এবারে প্রশ্ন উঠেছে – হামাসের উৎপত্তি এবং ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কথিত সংযোগ থাকার বাস্তবতা সম্পর্কে। এই প্রশ্নে অনেকেই অবাক হতে পারেন, তবে কঠিন হলেও সত্য যে এই অভিযোগ অনেক পুরনো এবং দুই পক্ষের ওপরে এই অভিযোগ সমানভাবে বর্তায়। এমনকি ইসরায়েলে হামাসের হামলার এক মাস আগে বিবিসি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সাবেক ফিলিস্তিনি মন্ত্রী এই দাবিটি তুলে ধরেছিলেন।
যার পরে অনেক বিদেশি সংবাদপত্রে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে একই দাবির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কয়েক দশক আগে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক প্রকাশ্যেই এই দাবিটি তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এক রিপাবলিকান সেনেটরও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের কর্মকর্তারাও অভিযোগ তুলেছেন।
তবে শুধু হামাস সদস্যরা নয়, ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ ধরনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলেছেন। কিন্তু, এই দাবির সত্যতা কী? কিসের ভিত্তিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? হামাসের সামরিক ইতিহাসের কোন পর্যায়ে এই সন্দেহ দেখা দিয়েছে? বিবিসির অ্যারাবিক সার্ভিস থেকে নেওয়া নিবন্ধে, এই বিশাল রহস্যের অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
হামাসের দীর্ঘ প্রচেষ্টা
এটা উল্লেখ করা উচিত যে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন বা হামাস রাতারাতি আবির্ভূত হয়নি। এটি গঠনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই যাত্রাকে মোটা দাগে দুটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথম অংশ: ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে হামাস বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিল। ফিলিস্তিনের গাজা, জেরুসালেমের শেখ জাররাহ অঞ্চল এবং অন্যান্য শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বলা যায়, ওইসময় থেকেই ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এই আন্দোলনের শিকড় তৈরি হয়।
দ্বিতীয় অংশ: ১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বা ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণ সদস্যদের সাথে আরব শেখ এবং দলের নেতাদের মতানৈক্য দেখা দেয়। ছয়দিনের যুদ্ধে মিশর/সিরিয়া/জর্ডান এই তিন আরব রাষ্ট্রের জোটের সাথে ইসরায়েলের লড়াই হয়েছিল। যেখানে ইসরায়েল বিজয়ী হয়। যার ধারাবাহিকতায় তরুণ ব্রাদারহুড সদস্যদের মধ্যে সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়ার ধারণা দানা বাধে।
ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ মূল্যায়নের ভিত্তিতে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিন অঞ্চলে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে ইতিহাস, তার একটি বড় অংশ জুড়ে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। যেমন মুসলিম ব্রাদারহুডের কার্যক্রমের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ, অ্যাডভোকেসি এবং সচেতনতা বাড়ানো। সেইসাথে তারা ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ নির্মাণে গুরুত্ব দিয়েছিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের এ ধরনের তৎপরতা দেখে ধারণা করা যায়, ফিলিস্তিনে যখন তারা সংগঠিত হচ্ছিল বা কার্যক্রম চালাচ্ছিল তখন তারা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে তাদের উদ্দেশ্য সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়া ছিল না।
বরং তারা বেশি মনোযোগ দিয়েছিল ফিলিস্তিনিদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের দিকে। এই প্রসঙ্গে, হামাসের প্রাক্তন ও অন্যতম প্রধান নেতা খালেদ মেশাল, যিনি এখন ফিলিস্তিনের বাইরে থাকেন- তিনি বলেছেন,
“১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে ওই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী, নাসেরবাদী (পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, আরব জাতীয়তাবাদ মতাদর্শ) বাথিস্ট (আরব জাতির ঐক্যের মতাদর্শ) এবং কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরা ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় আসে এবং ফিলিস্তিন জুড়ে তাদের আধিপত্য ছিল।”
কমিউনিস্ট নেতারা ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় আসায় ইসলামপন্থীদের উপর তাদের চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং তারা এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এ কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা ফিলিস্তিন থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে থাকতে বাধ্য হয়। কারণ তারা ওইসব মতাদর্শের অংশ ছিল না। ওইসব অঞ্চলে ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিকে স্বাগত জানানো হয়নি, এমনকি তাদের জন্য চাকরির কোনো সুযোগ ছিল না, মিশালের প্রেস বিবৃতি উল্লেখ করা হয়। এই নিবন্ধের বাকি অংশে, হামাস গঠনের পথে দ্বিতীয় স্তরের সংগ্রামের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হবে, অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হামাস আন্দোলন শুরু হওয়ার বছর পর্যন্ত।
লাল মিনার: “সশস্ত্র সংগ্রামের” প্রতীক ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয়ের পরে “ইসরায়েলের সাথে সংঘাত” পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে এবং এই সংগ্রাম নতুন রূপ নিতে শুরু করে বলে মনে করা হয়। হামাস আন্দোলনের প্রথম মুখপাত্র এবং তাদের সাবেক নেতা ইব্রাহিম ঘোষেহ, তার “দ্য রেড টাওয়ার” শিরোনামের স্মৃতিকথায় এই পরাজয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিক্রিয়া এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণদের উপর এই আন্দোলনের প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন।
ঘোষেহ তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, সেই সময়ে জর্ডানে ব্রাদারহুডের সমন্বয়কারী বা জেনারেল কন্ট্রোলার, মুহাম্মদ আবদ আল-রহমান খলিফা একটি ইসলামী সম্মেলন করেছিলেন। সেই সম্মেলন যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তা নিয়ে ঘোষেহ এবং তার প্রজন্মের তরুণরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। “কারণ সেখান থেকে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের জন্য কোন সুস্পষ্ট সমাধান আসেনি, এবং ইসলামিক জিহাদি সংগঠন গঠন করার বিষয়ে কোন আহ্বান জানানো হয়নি।”
“দ্য রেড টাওয়ার” শীর্ষক স্মৃতিকথায় আরও বলা হয় যে, এই ব্যাপারটি ব্রাদারহুডের যুবকদের মধ্যে যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিল তাদের উস্কে দেয়। তারা দলের মধ্যে একটি “সংস্কার আন্দোলন” শুরু করতে চেয়েছিল এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের না জানিয়ে নিজেরাই অস্ত্র হাতে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ফলস্বরূপ, তিনি গোপনে আল-ফাতাহ মুভমেন্টের সাথে জর্ডানে মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সশস্ত্র অভিযানের জন্য প্রস্তুত করতে রাজি হন।
সেই সময়ে জর্ডানে এই প্রস্তুত করার কৌশলটি “শেখদের নিয়ম” হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭০ সালে জর্ডানের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ বা জর্ডানের গৃহযুদ্ধের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায়।
এর কারণ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড নেতারা নিজেদের মধ্যে একটি ‘সংস্কার আন্দোলন’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্দোলন চলাকালে তাদের “প্রবীণ নেতা” এবং “তরুণ প্রজন্মের” মধ্যে তীব্র মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব বেধে যায়। তরুণরা যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল, তখন নেতারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে “রাষ্ট্র গঠন”কে অগ্রাধিকার দেওয়ার উপর জোর দিচ্ছিল।
এ কারণে ওই সংগঠনের বেশ কয়েকজন তরুণ সদস্য দল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং ‘জাতীয় ও সংগ্রামী আন্দোলন’ গড়ে তোলে যা তাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এই তরুণদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। কারণ তাদের বিরোধীরা সংখ্যায় বেশি ছিল এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় আন্দোলনের আধিপত্যের তুলনায় তাদের অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল। “ইয়াসির আরাফাতকে মোকাবিলা করতে হামাসের উৎপত্তি”
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এই দুই দশকে যখন তরুণদের সশস্ত্র সংগঠনটি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই ইসরায়েল এবং ইসলামিক গোষ্ঠী যেখান থেকে হামাসের উত্থান হয়েছিল তাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এমন সন্দেহ দেখা দেয়। মূলত ইসরায়েল এবং তৎকালীন ইসলামপন্থী নেতাদের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ রয়েছে এমন সন্দেহ থেকে এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। যারা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। তিনি হামাস আন্দোলনকে ইসরায়েলি সৃষ্টি বলে অভিহিত করেছিলেন।
মিশরীয় সামরিক বাহিনীর সাথে বৈঠকে মুবারকের একটি পুরানো ভিডিও রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন: “’ইসরায়েল হামাসকে পিএলও-এর (প্যালেস্টাইন লিবারেশন মুভমেন্ট) বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তৈরি করেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। এই অভিযোগ শুধু হোসনি মোবারক একা করেননি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রাক্তন সদস্য রন পল, যিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন।
তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বলেছিলেন “আপনি যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকান, আপনি জানেন যে হয়তো ইয়াসির আরাফাতকে মোকাবেলা করার জন্য ইসরাইল হামাসকে তৈরি করতে চেয়েছিল এবং তারা (ইসরায়েল) হামাসকে তৈরি করতে সহায়তা করেছিল।” এছাড়া, হাসান আসফোর যিনি ফিলিস্তিনের সাবেক মন্ত্রী এবং ১৯৯৩ সালে গোপন অসলো আলোচনায় ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন।
তিনি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসি টেলিভিশনকে বলেছিলেন যে “হামাস মূলত একটি যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার অংশ। কিছু আরব দেশ, ইসরায়েল এবং পিএলও এর মধ্যে চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা কিনা ফিলিস্তিনে পিএলও এর সমান্তরাল বিকল্প হতে পারবে।”
এই বিষয়ে ফিলিস্তিনি গবেষক, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ জামিল আজম বলেছেন, এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজনের দাবিকে ইন্ধন দেওয়ার জন্য ইসরায়েলিরা নিজেরাই এই অভিযোগগুলিতে ভূমিকা পালন করেছে।”
কয়েক দশক আগে হোসনি মুবারকের বিবৃতি সম্পর্কে, আহমেদ জামিল আজম বিবিসিকে আরও জানান, “মিশরীয় সরকারের অবস্থান তাদের স্বার্থ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতো।” “মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি মিশরীয় সরকারের বৈরিতার কারণেই এবং হামাসের সাথে উত্তেজনার কোন মুহূর্তে সম্ভবত এসব অভিযোগ করা হয়েছে।”
“অন্যদিকে, হোসনি মোবারক এবং তার গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ওমর সুলেইমানের সাথে হামাসের সম্পর্ক কিছু সময়ের জন্য খুব ভালো ছিল। এতোটাই ভালো ছিল যে তারা গাজা উপত্যকায় অস্ত্র প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল।” এটা বলা যেতে পারে যে, হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে “নিষিদ্ধ সম্পর্কের” অভিযোগ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের প্রেক্ষাপটে আসে। যখন মুসলিম ব্রাদারহুড ফিলিস্তিনি অঞ্চলে তথাকথিত “মসজিদের যুগ” শুরু করেছিল, যা আনুমানিক ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
মসজিদের যুগ বলতে এমন এক সময়কে বোঝায় যখন তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অনেক “মসজিদ নির্মাণ” করেছিল এবং তরুণ প্রজন্মকে একীভূত ও সংগঠিত করেছিল।” “যেন জায়নবাদী স্রোত (ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি) মোকাবিলায় মুসলিম ব্রাদারহুডের মতবাদকে আরও অন্তর্ভুক্ত এবং গভীর করার যায়।” খালেদ আল-হরুব তার বই “হামাস: পলিটিক্যাল থট অ্যান্ড প্র্যাকটিস”-এ এসব কথা বলেছেন।
হারুব তার বইতে লিখেছেন যে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে ইসলামপন্থীরা সৃষ্ট সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছিল, কারণ ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের সাথে সাথে নাসেরবাদীদের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে শূন্যতা দেখা দেয়। খালেদ হারুব লিখেছেন যে পরবর্তী সাংগঠনিক পর্যায়টি ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
এই পর্যায়ে, ইসলামী ছাত্রদল, ক্লাব, দাতব্য সমিতি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছিল, যেগুলো নতুন এবং তরুণ ইসলামী দলগুলির মধ্যে বৈঠক ও আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। “আমি শিন বেটের প্রধান ছিলাম এবং আমি দেখেছি কিভাবে হামাস গঠিত হয়েছে” নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৮১ সালে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল, যেখানে সংবাদপত্রটি সেই সময়ের গাজার সামরিক গভর্নর আইজ্যাক সেগেভের সাথে কথা বলেছিল।
ইয়েটজাক সেগেভ বলেছিলেন: “ইসলামী মৌলবাদীরা ইসরায়েলিদের কাছ থেকে সাহায্য পায়। ইসরায়েল সরকার আমাকে তহবিল সরবরাহ করেছে এবং মসজিদ নির্মাণে সহায়তা করছে।” ওই নিবন্ধে একটি বিষয় উঠে আসে তা হল, এই তহবিলের উদ্দেশ্য ছিল, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন- পিএলও এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, এমন একটি গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করে তোলা।
যাইহোক, সম্প্রতি ইসরায়েলি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে প্রচারিত এক সাক্ষাত্কারে, ইয়াকভ পেরি, যিনি ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধান হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সংস্থার প্রধান ছিলাম। আমি হামাস আন্দোলনের উত্থান দেখেছি। তখন আমাদের কাছে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনের মতো মনে হয়েছে যারা জনগণের চাহিদা পূরণে কাজ করে।” “ইসরায়েলের অনেক মানুষের অভিযোগ যে, শিন বেট ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হামাসের রাজনৈতিক কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অভিযোগ সত্য নয়।” ১৯৯৯ সালে আল জাজিরা টিভির “উইটনেস টু দ্য এজ” প্রোগ্রামে হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের কাছে এই একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ভিন্ন কিছু বলেন।
শেখ আহমেদ ইয়াসিন বলেন, তিনি মনে করেন না যে ইসরায়েলের সেই সময়ে কোন বাজেট “সমস্যা” ছিল। ওই সাক্ষাত্কারে, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে ইসরায়েল সেই সময় দখলকারী শক্তি হিসাবে বেতন দিচ্ছিল। তিনি তার সাক্ষাত্কারে আরও বলেন, “ইসরায়েল তাদের কর্মচারীদের মজুরি এবং পেনশন দিতে শুরু করে যারা প্রথমে বিনা বেতনে এবং পরে বেতনসহ কাজে ফিরে যেতে সম্মত হয়েছিল।” ইয়াসিন আরো বলেন, ইসরায়েল গাজা দখলের পরে গাজায় স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এই বেতন দেয়া শুরু করে।
“আমি একজন শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য প্রতি মাসে ২৪০ ইসরায়েলি পাউন্ড পেতাম… এবং একটি মসজিদে প্রচারক হিসেবে কাজ করার জন্য ৪০ পাউন্ড পেতাম…এই পরিমাণ টাকা যাওয়া আসার গাড়ি ভাড়ায় চলে যেতো। ওই বেতন যথেষ্ট ছিল না।” তিনি বলেন।
“স্বার্থের অনিচ্ছাকৃত ছেদ”
হিব্রু ইউনিভার্সিটির ট্রুম্যান ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. রনি শাকেদ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, সামাজিক ধর্মীয় আন্দোলন নিয়ে ইসরায়েলের কোনো সমস্যা নেই, তিনি আরও বলেন, ব্রাদারহুড সেই সময়ে ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি।
শাকেদ, ১৯৭০-এর দশকে একজন প্রাক্তন শিন বেট কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে ইসরায়েল কখনই ইসলামপন্থীদের পেছনে অর্থায়ন করেনি, এবং তাদের অবদান লাইসেন্স দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ইসলামপন্থীদের অর্থ দেয়া হয়নি। “সমর্থন” এবং “বিভ্রান্ত” এই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে রনি শাকেদের বক্তব্যের সাথে আহমেদ আজমের কথা মিলে যায়। উভয় গবেষকই বিশ্বাস করেন যে, “ইসলামী আন্দোলন ইসরায়েলকে মোকাবিলা করতে যে পথ বেছে নিয়েছিল সেখানে কোন অস্ত্রের ব্যবহার ছিল না। যা তাদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ইসরায়েল তার নিজস্ব স্বার্থে ইসলামপন্থীদের থেকে নিজেদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়… এবং তাই উভয় গবেষকই একে ব্রাদারহুডের প্রতি ইসরায়েলি “সমর্থন” হিসাবে বিবেচনা করতে আপত্তি জানিয়েছেন।
ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাথে ইসরায়েলের যোগাযোগের প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষাপটে এবং “ইসরায়েলের অর্থায়ন বা ইসলামিক মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া” বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত “ফিলিস্তিনে ইসলামিক বন্দোবস্তের জন্য ইসরায়েলি নীতি” শিরোনামের একটি বই খুঁজে পাই। ব্রিটিশ লেখক মাইকেল ডেম্পার সেখানে বলেছেন যে, সামরিক গভর্নর হিসেবে তিনি প্রথম যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল ১৯৬৭ সালে, তিনি এক ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে গাজা উপত্যকায় ধর্মীয় বিষয় দেখভালের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং তার কাজ ছিল সামরিক সরকারকে ইসলামী এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে সংযুক্ত করা।
যদিও ব্রিটিশ লেখক এটাও লিখেছেন যে ইসরায়েল, ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সামনে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল, তিনি এই মসজিদগুলোর নির্মাণ নিয়ে এবং ইসরায়েলের অর্থায়ন নিয়ে মসজিদগুলোর পরিচালকদের মধ্যে বিরোধের কথা উল্লেখ করেননি। “এটি ছিল অবহেলা… এবং আমরা কখনই হামাসকে অর্থায়ন করিনি” ইসরায়েলি কর্মকর্তারা গাজা উপত্যকার ভেতরে হামাসের বিস্তৃতির সময় আন্দোলনকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে একেক ধরণের ব্যাখ্যা দিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের প্রাক্তন কর্মকর্তারা ‘হামাসকে সমর্থন ও সৃষ্টি’ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন”, ২০০৯ সালের নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে শালোম হারারিকে উদ্ধৃত করা হয়। যিনি হামাস গঠনের সময় গাজায় একজন ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন।
তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “আমরা কোনোভাবেই হামাসকে সমর্থন করি না । ইসরায়েল কখনই হামাসকে অর্থায়ন করেনি, এবং ইসরায়েল কখনই হামাসকে অস্ত্র সহায়তা দেয়নি” “ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে যেসব সতর্কতা ছিল সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে, এর পিছনে কারণ ছিল অবহেলা, ইসলামপন্থীদের শক্তিশালী করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না।” এই প্রসঙ্গে, শেখ আহমেদ ইয়াসিন বলেছেন যে “ইসরাইল অন্য সব সংস্থার মতো ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকেও নজরদারি করছিল… এবং এই অঞ্চলে সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করেছিল।” “প্রত্যেককে তাদের মতো বিকাশ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং যখন সময় আসে তখন তাদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয় নাহলে হত্যা করা হয়।”
“ফলাফল তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে”
যারা হামাস তৈরির জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে তারা বিশেষভাবে ১৯৭০-এর দশকে গাজায় ‘ইসলামিক সোসাইটি’ এবং ‘ইসলামিক একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার দিকে বিশেষভাবে নির্দেশ করে। শতাব্দীতে মুসলিম ব্রাদারহুডের বর্ণনা অনুসারে, এটি “ইসরায়েলি আইনের ছত্রছায়ায়” গঠিত হয়েছিল এবং তাদের কার্যকলাপ শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল”। তারা আইন ভঙ্গ করেনি এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি।”
হামাস আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিন সেই সময়ে “উইটনেস টু দ্য এরা”-তে বলেছেন: “আমরা দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না।” “এবং সেখান থেকেই ইসলামিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ধারণা এসেছে। ১৯৭৬ সালে ইসলামিক সোসাইটির অফিস মসজিদের একটি কক্ষের মধ্যে ছিল এবং তাদের বেশিরভাগই কার্যক্রম ছিল খেলাধুলা কেন্দ্রীক।”
ইসরায়েলি লেখক এহুদ ইয়ারি এবং জোয়েভ শেফ ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “ইন্তিফাদা” বইতে লিখেছেন যে “ইসরায়েলের বেসামরিক প্রশাসন ইসলামী আন্দোলনের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল যা প্রথম ইন্তিফাদার শুরুর সাথে সাথে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ে।” “ইসরায়েল তাদেরকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ে ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থান তৈরি করার সুযোগ দিয়েছিল।” এই দুই ইসরায়েলি লেখক আরও বলেছেন, ইসরায়েল ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রভাব কমানোর জন্য হামাসের উত্থানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল” “কিন্তু ইসরায়েল তাদের ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে হামাসের প্রাক্তন নেতাদের একজন ইব্রাহিম ঘোষেহ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “এটি মুসলিম ব্রাদারহুড বা শেখ ইয়াসিনের দোষ ছিল না যে ইসরায়েল ভেবেছিল যে পিএলও এর উচিত গাজায় একটি ‘ইসলামিক সমাবেশ’ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া।” “ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করুন, এটি ভ্রাতৃত্ব বাড়াবে। জায়নবাদীরা তাদের হিসাব-নিকাশে ভুল করলে তার পরিণতি তারা নিজেরাই দেখেছে।” সেই সময়কাল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, লেখক খালেদ আবু আল-ওমরাইন “হামাস: ইটস রুটস, অরিজিনস অ্যান্ড পলিটিক্যাল থট” বইতে উল্লেখ করেছেন যে, “ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ একা ইসলামী আন্দোলনকে একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠার অনুমতি দেয়নি, বরং বিভিন্ন দলকে তারা সর্বত্র ক্লাব, সমিতি, ইউনিয়ন, এবং প্রেস অফিস স্থাপনেরও অনুমতি দিয়েছে। ”
তিনি লিখেছেন “ইসরায়েল ১৯৮০ সালে, ফাতাহ আন্দোলনকে একটি যুব আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সক্রিয় ছিল।” ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত “চ্যারিটেবল অ্যাসোসিয়েশনস ইন দ্য ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অ্যান্ড গাজা স্ট্রিপ” বইতে লেখক, আবদুল্লাহ আল-হুরানি বলেছেন যে ১৯৮৭ সালে “প্রথম ইন্তিফাদা” এর আগে গাজায় সংগঠনের সংখ্যা বেড়ে ৬২টিতে পৌঁছায়।” “যার মধ্যে ব্রাদারহুডের সংগঠন ছিল মাত্র ৪টি, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল: ইসলামিক একাডেমি এবং ইসলামিক সোসাইটি। যা জমিয়তে ইসলামী বা জামায়াতে ইসলামী নামেও পরিচিত ছিল।”
“কৌশলগত ভুল”
ফিলিস্তিনি গবেষক, কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. আহমেদ জামিল আজম বলেছেন, ইসরায়েল একটি কৌশলগত ভুল করেছে: “তাদের কখনোই কোন সুস্পষ্ট কৌশল ছিল না… ইসরায়েল সবসময়ই সামরিক আধিপত্যের উপর নির্ভর করেছে।”
“উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৭ সালে গাজা দখল করার পরে, ইসরায়েল অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে, স্থানীয় সম্প্রদায় নেতৃত্বদানকারী পরিবারগুলির সাথে যোগাযোগ করেছে এবং স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে।”
“সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে, দখলদারিত্বের মাত্রা এবং এর পরিণতি সম্পর্কে বাস্তবসম্মত উপলব্ধি থেকে নয়… ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতিগুলো সমাজ মেনে নিতে পারে না।” জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির ট্রুম্যান ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. রনি শাকেদ বিবিসিকে বলেছেন, গাজায় সামরিক শাসকদের ভয় থাকা সত্ত্বেও ওইসময় গাজার ইসরায়েলি সামরিক গভর্নর ইয়েটজাক সেগেভ গাজার পরিস্থিতি নিয়ে তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন।
কারণ “বিপ্লবের আগে তেহরানের পরিস্থিতির সাথে গাজার পরিস্থিতি মিলে গিয়েছিল বরং বিপ্লবের আগে গাজার পরিস্থিতি তেহরানের চেয়ে আরও খারাপ ছিল।” এই সাদৃশ্য উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, “ইসরায়েলি প্রশাসন ভবিষ্যত ইসলামী আন্দোলনের হুমকি সম্পর্কে সতর্কবার্তা পেয়েছিল কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের বিষয়ে ইসরায়েলের সঠিক ধারণা ছিল না এবং তাদের মোকাবেলা করতে গিয়ে ইসরায়েল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছিল।” শাকেদ আরও বলেছেন, “শেখ আহমেদ ইয়াসিন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা প্রতারণা করেছিলেন (শেখ আহমেদ ইয়াসিন ছিলেন ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ এবং হামাসের প্রতিষ্ঠাতা) “যখন তিনি একটি নার্সারি তৈরি করেছিলেন, প্রজন্ম গড়ে তুলছিলেন এবং ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করার জন্য তাদের প্রস্তুত করতে কাজ করছিলেন।” এই ইসরায়েলি গবেষকের ধারণা, ইসরায়েল এখনও বিশ্বাস করে যে হামাসকে নির্মূল করলে, ফিলিস্তিনিদের চাকরির সুযোগ দিলে এবং অর্থনৈতিক সুবিধা দিলে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ফিরবে, “কিন্তু এই ধারণা সত্যি নয়… হামাস নির্মূল হলে, এর পরিবর্তে নতুন জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠবে।”
জিরো পয়েন্ট: ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ হামাসের মুখপাত্র ইব্রাহিম ঘোষেহ’র স্মৃতিচারণ অনুসারে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডের সংগ্রামের পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৮৩ সালে। মুসলিম ব্রাদারহুড সেসময় জর্ডানে একটি সম্মেলন করেছিল, সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে “এই সংগঠনটির সদস্যদের অবশ্যই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে হবে।” এজন্য তারা পশ্চিম তীর এবং গাজায় তাদের কর্মীদের সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার অনুমতি দেয় এবং পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে তা শুরু করে। এই সম্মেলনের এক বছর পর, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল প্রথম কোন সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করে এবং শেখ ইয়াসিনের নেতৃত্বে থাকা সব সদস্যকে গ্রেফতার করে। আহমেদ ইয়াসিন ১৩ বছর তাদের নেতৃত্বে ছিল। তার বাসভবন থেকে ৮০টি অস্ত্রে উদ্ধার করা হয়, যেগুলো তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে আগে কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু ইয়াসিন শুধুমাত্র কয়েক মাস আটক ছিলেন। কারণ ১৯৮৫ সালে ইসরায়েল এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের মধ্যে একটি বড় বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়। পপুলার ফ্রন্ট – জেনারেল কমান্ডের নেতৃত্বে তিনজন ইসরায়েলি সৈন্যকে বন্দী করার পর ওই বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসাবে মুক্তি পান ইয়াসিন। সেই সময়ে, ইসলামপন্থীরা ইসরায়েলের কাছ থেকে বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছিল, এটা ভেবে যে তাদের আন্দোলনের সশস্ত্র শাখাটি একদম নতুন ছিল, অভিজ্ঞতা ছিল কম এবং সীমিত সক্ষমতা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল।
কিন্তু এসব কারণে তাদের আন্দোলন ভেঙে পড়েনি। কারণ তাদের “আদর্শ” শক্তিশালী ছিল এবং তারা নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিল।” “সামরিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার মাধ্যমে এবং ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সামরিক সংগঠন ‘ফিলিস্তিনি মুজাহিদিন’ এবং সিকিউরিটি সার্ভিস ‘মাজদ ‘গঠন করা হয়।” কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, কিন্তু ইসরায়েল তখনও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এবং বাইরে তার সংহতকরণ এবং সম্প্রসারণের পদ্ধতি পরিবর্তনের গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। এ কারণেই ইসলামপন্থীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল, যা অবশেষে তাদের সেই মুহূর্তে নিয়ে যায়, যেখানে ‘সশস্ত্র সংগ্রামের’ প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ‘ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন’ বা হামাস প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। হামাস প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর ১৯৮৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
পরিশেষে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে হামাস আন্দোলনের ইতিহাসের অনেক পর্যায়ে অস্পষ্টতা রয়েছে এবং এ সংক্রান্ত নথিপত্র বা প্রমাণাদির অভাবও রয়েছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে আন্দোলনের অনেক সদস্য ফিলিস্তিনে মুসলিম ব্রাদারহুড গঠনের শুরুতে তাদের ঘিরে থাকা নিরাপত্তা পরিস্থিতি, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করেছে। তবুও ইসরায়েল হামাসকে “সৃষ্টি” করেছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হতে পারে। তবে সেই উত্তর দেয়ার জন্য প্রশ্নটির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বিবেচনা করা প্রয়োজন।
ইসরায়েল হামাসকে “সৃষ্টি” করেনি, বরং ফিলিস্তিনে দখলদারদের উপস্থিতি এবং তাদের সাথে ফিলিস্তিনিদের সংঘাতের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা থেকেই হামাসের উৎপত্তি হয়েছে,” শাকেদ এবং আজম তাই মনে করেন। সংঘাত এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যা শেষ পর্যন্ত হামাসের ‘সৃষ্টি’র দিকে নিয়ে যায়।
সুতরাং, হামাস যখন গঠন হতে শুরু করে তখন ইসরায়েল ওই আন্দোলনের ব্যাপারে অন্ধ ভূমিকায় ছিল অথবা হামাস যখন ফিলিস্তিনি সংগ্রামের দৃশ্যপটে একটি সঙ্গতিপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন ইসরায়েল সম্ভবত হামাসের উপস্থিতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল – এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে গাজায় ইসলামী আন্দোলনের যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং এটি যে পরিস্থিতিতে বিকশিত হয়েছিল তা বিবেচনা করলে হামাসের সৃষ্টির সাথে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায় না। হামাস ইসরায়েলের কুঠুরিতে সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসরায়েলি ‘প্রকল্প’ হিসাবে হামাসকে অর্থায়নের তত্ত্বও সঠিক বলে ধরা যায় না। তথ্যসূত্র: বিবিসি