নিউইয়র্ক ০১:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

শীতে স্থবির উত্তরের জনপদ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৪৭:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ৩৩ বার পঠিত

দেশের ২১টি জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ কাজে যেতে পারছে না শ্রমজীবীরা, কমছে উৎপাদন, বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ, তীব্র শীতে বিভিন্ন খামারে মারা যাচ্ছে মুরগি, শীতের কারণে মৃত্যুরোধে বাল্ব জ্বালিয়ে রাখার এবং পলিথিন দিয়ে খামার ঢেকে রাখার পরামর্শ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের শীতে স্থবির উত্তরের জনগদ। কয়েক দিন যাবত উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ। দেশের ২১টি জেলা ছিল শৈত্যপ্রবাহের কবলে। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্র ছিল নওগাঁ জেলায় ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের প্রভাব পড়েছে মানুষ, পশুপাখি আর ফসলের ওপর। প্রচণ্ড শীত স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দিয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে মানুষ। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া সকাল ও সন্ধ্যার পর মানুষ ঘরের বাইরে আসছে না। এতে বিভিন্ন খাতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শীতের তীব্রতায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছে উত্তরের মানুষ। হিমালয় থেকে আসা হিমেল আওয়া আর ঘন কুয়াশার কারণে ওই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। এই তীব্র শীতে শ্রমজীবীরা কাজে যেতে পারছেন না। যারা প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন তারা অনেকে কাজ পাচ্ছেন না। হিমেল হাওয়া মিশ্রিত এই কনকনে শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বাড়ছে শীতজনিত রোগ-বালাই।

এই তীব্র শীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত। শীতের কারণে আগাম জাতের ইরি-বোরো চাষ ব্যাহত হচ্ছে। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা হিমেল হাওয়ার কারণে মাঠে নামতে পারছে না কৃষকরা। কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ। এসব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আবাদকারীরা। তীব্র শীতে মারা যাচ্ছে মুরগি। রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, পনের দিনে বারো হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে শীতের কারণে মুরগি মারা যাবার তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা শীতের কারণে মৃত্যুরোধে বাল্ব জ্বালিয়ে রাখার এবং পলিথিন দিয়ে খামার ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের চাষাবাদ যেমন পড়েছে সংকটে। তেমনি কলকারখানা না থাকায় বেকার মানৃুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। কাজ নেই আয় নেই। অনাহারে-অর্ধাহারে মানুষ দিন কাটাচ্ছে। ওষুধের জন্য কাতরাচ্ছে। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। উত্তর জনপদের বিভিন্ন জেলা থেকে দৈনিক ইনকিলাবের ব্যুরো প্রধান ও সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে এর সংক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।

রাজশাহী থেকে বিশেষ সংবাদদাতা রেজাউল করিম রাজু জানান : প্রচণ্ড শীতে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ কাবু হয়ে পড়েছে। কৃষি, পোল্ট্রি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ বিপর্যয়ে পড়েছে মানুষ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে শিশু ও বয়স্করা। হাসপাতালগুলোয় নিউমোনিয়া, অ্যাজমা শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আসছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন গুণ রোগী আসছে এসব অসুখ নিয়ে। একদিনে ভর্তি হয়েছে শতাধিক শিশু রোগী। হাসপাতালগুলোয় ঠাঁই নেই অবস্থা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে একই অবস্থা। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। বাইরে থেকেই ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।

শীতের তীব্রতায় প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন পেশার কর্মজীবীদের ওপর। চাকুরীজীবী বাদ দিয়ে অন্য সব পেশার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের। তারা কাজের সন্ধানে কাকডাকা ভোরে ছুটে আসছে নগরীতে। জবুথুবু হয়ে ভিড় জমাচ্ছে শ্রমবিক্রির স্থান রেলগেট, তালাইমারী, কোর্ট এলাকায়। কিন্তু তাদের কাজে নেয়ার জন্য খুব বেশি মানুষ আসছে না। নির্মাণ কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। যারা কাজ পাচ্ছে তারা খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও যারা কাজ পাচ্ছে না তারা কর্মহীন বিরস বদনে ঘরে ফিরছে। কর্মহীন হওয়া মানে বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করা। এরপর জিনিসপত্রের দাম মানুষকে আরো কাহিল করে ফেলেছে। রোগ-বালাইয়ের ওষুধ কেনার ক্ষমতা হারিয়েছে। সব মিলিয়ে দারুণ কষ্টে আছে এসব পেশাজীবীরা। এখন চলছে বোরো আবাদের মওসুম। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা হিমেল হাওয়ার কারণে মাঠে নামতে পারছে না কৃষক। কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ। এসব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আবাদকারীরা। তীব্র শীতে মারা যাচ্ছে মুরগি। রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত পনের দিনে বারো হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, শীতের কারণে মুরগি মারা যাবার তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা শীতের কারণে মৃত্যুরোধে খামারে পর্যাপ্ত বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা ও পলিথিন দিয়ে ঘিরে বাতাস ঠেকানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের খামারি বেলাল জানান, তার খামারে প্রতি দিন পাঁচ-সাতটা করে মুরগি মারা যাচ্ছে। শীতে আক্রান্ত মুরগির টোপ আংশিক কালো হয়ে যাচ্ছে। শরীর ফুলে থাকছে, খাবার কম খাচ্ছে। খামারিরা জানান, শীতে সাধারণত রাণীক্ষেত মাইকোপাজেমিস, ফাউল টাইফয়েড ও পেটে পানি জমা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। খামারিরা পড়েছে লোকসানের মুখে।

শীতে বিপাকে পড়েছে মৎস্যজীবীরা। এমনিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া ও ফারাক্কার কারণে এ অঞ্চলের নদ- নদী, খাল-বিল পানিশূন্য। যেটুকু আছে তাতেও তারা মাছ ধরতে পারছে না। যারা নদীতে কষ্ট স্বীকার করে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ খালি হাতে ফিরছেন। বাজারে মাছের সরবরাহ কমে গেছে বলে সাহেব বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী রফিকুল জানান।

কালু নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, তাদের বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। ফলে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। মুদি-কাম-সবব্জি ব্যবসায়ী তুহিন বলেন, বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। যারা আসছেন তারাও পরিমাণে খুব কম কিনছেন। আসলে মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই। বেচাকেনা নেই বলে আমাদের ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে।

রাজশাহীতে চলাচলের অন্যতম বাহন অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এখানকার স্থানীয়রা ছাড়া এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে আসে মানুষ। তাদের বেশিরভাগ এসব বাহন ভাড়ায় চালায়। যাত্রীর অভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গ্যারেজ মালিকরা জানান, ভোরবেলায় কেউ এসব বাহন নিতে আসছে না। কারণ যাত্রী নেই। কিন্তু তাদের জমার টাকা ঠিকই দিতে হবে।

এসব রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা খালি গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন। পাঁচজন যাত্রীর স্থলে দু-তিনজনের বেশি পাচ্ছেন না। মালিকের জমা, চার্জ আর নিজের পেটের খাবার জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। পরিবার-পরিজনদের জন্য কিছু করতে পারছেন না। নগরীর পদ্মা তীরের বিনোদন স্পটগুলোতেও নেই ভিড়। এখানে ফুচকা, হালিম, বাদাম, পেয়ারা বিক্রি করে জীবন চালানোরাও পড়েছে বিপাকে। একদিকে শীতের তীব্রতা অন্যদিকে ক্ষুধার জ্বালায় শান্তিতে নেই নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষ। নগরীতে বোরখা পরিহিত সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। লোকলজ্জার ভয়ে বোরখা পরে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছেন।

বগুড়া থেকে বিশেষ সংবাদদাতা মহসিন রাজু জানান, চলতি শীত মওসুমে বগুড়ায় তাপমাত্রা কমে ৯.০১ ডিগ্রিতে নেমে আসায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে জেলা আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটা এই মওসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বলে জানানো হয়েছে।

এর আগে ১৬ জানুয়ারি জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা আরও কয়েক দিন থাকবে এবং বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বগুড়া আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষকগণ।
তাদের পক্ষে উচ্চপর্যবেক্ষক শাহ আলম জানান, সকালে জেলায় এই মওসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারি মাসজুড়েই এমন অবস্থা থাকবে বলেও জানান তিনি।

জেলা শিক্ষা অফিসার হযরত আলী জানান, জেলার সকল মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিষয়টি সকল উপজেলা শিক্ষা অফিসসমূহকে ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে জেলার সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে দুস্থ ও ছিন্নমূলদের মধ্যে গরম কাপড় বিতরণসহ সকল সহযোগিতার কার্যক্রম চলমান। এদিকে তীব্র শীত ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মানুষ নেহাত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ফলে রিকশাওয়ালারা যাত্রী পাচ্ছেন না। খুব বেলা করে দোকানপাট খুলছে বন্ধ হচ্ছে সন্ধ্যার পরপরই। কষ্টে আছে গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষ। কাজ না পেয়ে দিনমজুর ও কৃষিশ্রমিকরা অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের জেরে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে গণহারে। তার ওপর ভয়ঙ্কর শীত ও শৈত্যপ্রবাহ বেকার, অনাথ, শ্রমজীবী, ছিন্নমূল মানুষের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার হালিম আনসারি জানান, প্রচণ্ড ঘন কুয়াশা আর কনকনে হিমেল হাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের। শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে। সূর্যের দেখা মিলছে না প্রায় ১৫ দিন যাবৎ। প্রচণ্ড শীতের কারণে শীতজনিত রোগ-ব্যাধি বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে।

অব্যাহত ঘন কুয়াশার কারণে ১৫ দিন যাবৎ এ অঞ্চলে সূর্যের দেখা মেলেনি। মাঝখানে শুক্রবার সূর্য কিছুক্ষণের জন্য উঁকি দিলেও দুপুরের পর থেকে আবারও কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। ঘন কুয়াশা আর এ প্রচণ্ড হিমেল হাওয়া শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে পড়েছে পশু-পাখিসহ সব বয়সী মানুষ। ঠাণ্ডার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছে না কেউই। শিশু ও বৃদ্ধসহ মাঝ বয়সী লোকজন একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে। গভীর রাত অবধি খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। বিশেষ করে চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১৫ দিন যাবৎ সূর্যের দেখা না পাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষ কাঁথা-কম্বল শুকাতে পারছে না। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের পাশাপাশি কাঁথা-কম্বল শুকানোর চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষ। বিকেল হতে না হতেই বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরতে শুরু করে পরদিন দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকছে। বিশেষ করে রাত ১২টার পর থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির মতো কুয়াশা জরছে। দিনের বেলাতেও যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঠাণ্ডার কারণে চাষিরা ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজ করতে পারছেন না। সার্বিকভাবে জনজীবনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। পর্যাপ্ত গরম কাপড় না থাকায় ছিন্নমূল মানুষ পড়েছে মারাত্মক বিপাকে।

গাইবান্ধা থেকে স্টাফ রিপোর্টার আবেদুর রহমান স্বপন জানান, ভয়াবহ দুর্ভোগের মুখোমুখি এখন গাইবান্ধার শ্রমজীবী ও ছিন্নমূলসহ সব শ্রেণির মানুষ। ইতোমধ্যেই জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এসব বন্ধ থাকবে। এমনিতেই কল কারখানাবিহীন এই জনপদে বেকারত্বের হার অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা ও বগুড়ার কারখানাগুলোতে লোক ছাঁটাই হওয়ায় ওই সব লোকজন এসে গাইবান্ধায় বেকারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র ও অসহনীয় শীতের কারণে মুটে-মজুরের কাজও এখন মিলছে না বেকারদের বলে জানিয়েছেন ক্ষুধায় কাতর শ্রমজীবীরা ।

নাটোর থেকে মোঃ আজিজুল হক টুকু জানান : নাটোরে কয়েক দিন ধরেই প্রচণ্ড শীত পড়েছে। স্কুলের সায়েন্স ল্যাবে থাকা থার্মোমিটারে নাটোরের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখা যায়। এমন শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নাটোরের খেটে খাওয়া কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষদের জনজীবন। প্রচণ্ড শীতের কারণে জনসাধারণের ঘরের বাইরে যেমন চলাচল কমে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে রিকশা-ভ্যান-অটোভ্যান চালকদের আয়-রোজগার। আবার এই শীতের দাপটে পুকুর বা বিলের পানির ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাছ ধরার পরিমাণও কমে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে জেলেদের আয়। অপরদিকে অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে সূর্যের দেখা কম পাওয়া যায় বিধায় কৃষিজমিতে কাজের পরিমাণও কম। এই কম রোজগারে বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষদের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের পরিবারের সদস্যরাও।

নাটোরের তেবাড়িয়া ইউনিয়নের একডালা গ্রামের অটো রিকশাচালক আইয়ূব জানান, শীতে ভোরবেলায় অটোরিকশা নিয়ে বের হই। কিন্তু এত সকালে কোনো প্যাসেঞ্জার পাই না। দিন বাড়লে যা দুই-একজন পাই তাতে বেশি আয় হয় না। এই শীতে সারাদিনে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এতে করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, সকাল ও রাতে রিকশা চালানো যায় না। হাত-পা ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে আসে। ফলে শুধু দুপুরে রিকশা চালাতে হয়। আগের মতো রাস্তায় যাত্রীও তেমন নেই। এতে কমে গেছে আয়, দু’বেলা আহার তুলতে হিমশিম খাচ্ছি। গরম কাপড়ে শীত থেকে বাঁচলেও ক্ষুধার কষ্টে দিন পার করছি।

পাইকেরদোল থেকে আসা আবুল কাশেম জানান, সকালে গাড়ি নিয়া বের হইছি, পরে ঠাণ্ডায় টিকতে না পেরে ১১টা বাজে বাসায় চলে আসছি। এত শীতের ভেতরে রিকশা চালানো যায় না। জেলে সলিল দাস বলেন, ঠাণ্ডায় ডাঙ্গাতেই থাকতে কষ্ট হচ্ছে, পানিতে নামবো কেমন করে। তাই বসে আছি। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন পুকুরে জাল টেনে যে আয় হয় তাতে ৫ জনের সংসার চলে। খাওয়া-পরা ছাড়াও তার সংসারে বৃদ্ধ মাসহ অন্য সদস্যদের প্রতিদিন ওষুধ লাগে ১৭০ টাকার। প্রচণ্ড শীতে কয়েক দিন ধরে কাজ বন্ধ। অনেক কষ্টে আমাদের দিন কাটছে।

জাঠিয়ানের শ্রমজীবী মহিউদ্দিন জানান, শীতে কুয়াশার পরিমাণ বেশি থাকায় জমিতে কৃষিকাজ কমে গেছে। নওগাঁ থেকে এমদাদুল হক সুমন জানান, নওগাঁর ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলেছে। মাঘের শুরুতে ঘন কুয়াশার সঙ্গে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডায় বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী, ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে পথঘাট। কয়েক দিন ধরে দিনে কিছুক্ষণের জন্য রোদের দেখা মিললেও হিমেল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তাপ ছড়াতে পারছে না সূর্য। ভোর থেকেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে নওগাঁ। মেলেনি সূর্যের দেখা। উত্তরের হিমেল বাতাস অব্যাহত থাকায় শীতের তীব্রতা ব্যাপক হারে অনুভূত হচ্ছে। এ কারণে দিনভর শীতে জবুথবু থাকতে হচ্ছে।

নওগাঁয় ঘন কুয়াশার সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। একদিকে দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে শীতের প্রকোপে গরিবদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উষ্ণ কাপড়ের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-এর অধ্যাপক হাসানাত আলী বলেন, আমাদের মনুষত্বের জায়গায় চির ধরেছে। ৮০-৯০ দশকের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতার জন্য মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। এখন সেই সময়ের তুলনায় বিত্তশালী মানুষ ও কর্পোরেট হাউস বেড়েছে। অথচ সে তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন সাহায্যের হাত কমেছে। এটি কোনোভাবেই মানবিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য সহায়ক নয়। এমন ঋণাত্বক পরিবর্তন কেন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ প্রচণ্ড শীতে রাষ্ট্র হিসেবে দৃশ্যমান সাহায্য-সহযোগিতা চোখে পড়ছে না। কর্মহীন মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিরন্ন মানুষের পাশে সরকারকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সূত্র : ইনকিলাব

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

শীতে স্থবির উত্তরের জনপদ

প্রকাশের সময় : ০২:৪৭:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৪

দেশের ২১টি জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ কাজে যেতে পারছে না শ্রমজীবীরা, কমছে উৎপাদন, বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ, তীব্র শীতে বিভিন্ন খামারে মারা যাচ্ছে মুরগি, শীতের কারণে মৃত্যুরোধে বাল্ব জ্বালিয়ে রাখার এবং পলিথিন দিয়ে খামার ঢেকে রাখার পরামর্শ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের শীতে স্থবির উত্তরের জনগদ। কয়েক দিন যাবত উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ। দেশের ২১টি জেলা ছিল শৈত্যপ্রবাহের কবলে। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্র ছিল নওগাঁ জেলায় ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের প্রভাব পড়েছে মানুষ, পশুপাখি আর ফসলের ওপর। প্রচণ্ড শীত স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দিয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে মানুষ। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া সকাল ও সন্ধ্যার পর মানুষ ঘরের বাইরে আসছে না। এতে বিভিন্ন খাতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শীতের তীব্রতায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছে উত্তরের মানুষ। হিমালয় থেকে আসা হিমেল আওয়া আর ঘন কুয়াশার কারণে ওই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। এই তীব্র শীতে শ্রমজীবীরা কাজে যেতে পারছেন না। যারা প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন তারা অনেকে কাজ পাচ্ছেন না। হিমেল হাওয়া মিশ্রিত এই কনকনে শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বাড়ছে শীতজনিত রোগ-বালাই।

এই তীব্র শীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত। শীতের কারণে আগাম জাতের ইরি-বোরো চাষ ব্যাহত হচ্ছে। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা হিমেল হাওয়ার কারণে মাঠে নামতে পারছে না কৃষকরা। কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ। এসব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আবাদকারীরা। তীব্র শীতে মারা যাচ্ছে মুরগি। রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, পনের দিনে বারো হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে শীতের কারণে মুরগি মারা যাবার তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা শীতের কারণে মৃত্যুরোধে বাল্ব জ্বালিয়ে রাখার এবং পলিথিন দিয়ে খামার ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের চাষাবাদ যেমন পড়েছে সংকটে। তেমনি কলকারখানা না থাকায় বেকার মানৃুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। কাজ নেই আয় নেই। অনাহারে-অর্ধাহারে মানুষ দিন কাটাচ্ছে। ওষুধের জন্য কাতরাচ্ছে। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। উত্তর জনপদের বিভিন্ন জেলা থেকে দৈনিক ইনকিলাবের ব্যুরো প্রধান ও সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে এর সংক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।

রাজশাহী থেকে বিশেষ সংবাদদাতা রেজাউল করিম রাজু জানান : প্রচণ্ড শীতে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ কাবু হয়ে পড়েছে। কৃষি, পোল্ট্রি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ বিপর্যয়ে পড়েছে মানুষ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে শিশু ও বয়স্করা। হাসপাতালগুলোয় নিউমোনিয়া, অ্যাজমা শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আসছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন গুণ রোগী আসছে এসব অসুখ নিয়ে। একদিনে ভর্তি হয়েছে শতাধিক শিশু রোগী। হাসপাতালগুলোয় ঠাঁই নেই অবস্থা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে একই অবস্থা। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। বাইরে থেকেই ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।

শীতের তীব্রতায় প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন পেশার কর্মজীবীদের ওপর। চাকুরীজীবী বাদ দিয়ে অন্য সব পেশার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের। তারা কাজের সন্ধানে কাকডাকা ভোরে ছুটে আসছে নগরীতে। জবুথুবু হয়ে ভিড় জমাচ্ছে শ্রমবিক্রির স্থান রেলগেট, তালাইমারী, কোর্ট এলাকায়। কিন্তু তাদের কাজে নেয়ার জন্য খুব বেশি মানুষ আসছে না। নির্মাণ কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। যারা কাজ পাচ্ছে তারা খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও যারা কাজ পাচ্ছে না তারা কর্মহীন বিরস বদনে ঘরে ফিরছে। কর্মহীন হওয়া মানে বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করা। এরপর জিনিসপত্রের দাম মানুষকে আরো কাহিল করে ফেলেছে। রোগ-বালাইয়ের ওষুধ কেনার ক্ষমতা হারিয়েছে। সব মিলিয়ে দারুণ কষ্টে আছে এসব পেশাজীবীরা। এখন চলছে বোরো আবাদের মওসুম। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা হিমেল হাওয়ার কারণে মাঠে নামতে পারছে না কৃষক। কোল্ড ইনজুরির মুখে পড়েছে বোরোর বীজতলা, আলুর লেটব্রাইট রোগ। এসব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আবাদকারীরা। তীব্র শীতে মারা যাচ্ছে মুরগি। রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত পনের দিনে বারো হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, শীতের কারণে মুরগি মারা যাবার তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা শীতের কারণে মৃত্যুরোধে খামারে পর্যাপ্ত বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা ও পলিথিন দিয়ে ঘিরে বাতাস ঠেকানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের খামারি বেলাল জানান, তার খামারে প্রতি দিন পাঁচ-সাতটা করে মুরগি মারা যাচ্ছে। শীতে আক্রান্ত মুরগির টোপ আংশিক কালো হয়ে যাচ্ছে। শরীর ফুলে থাকছে, খাবার কম খাচ্ছে। খামারিরা জানান, শীতে সাধারণত রাণীক্ষেত মাইকোপাজেমিস, ফাউল টাইফয়েড ও পেটে পানি জমা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। খামারিরা পড়েছে লোকসানের মুখে।

শীতে বিপাকে পড়েছে মৎস্যজীবীরা। এমনিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া ও ফারাক্কার কারণে এ অঞ্চলের নদ- নদী, খাল-বিল পানিশূন্য। যেটুকু আছে তাতেও তারা মাছ ধরতে পারছে না। যারা নদীতে কষ্ট স্বীকার করে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ খালি হাতে ফিরছেন। বাজারে মাছের সরবরাহ কমে গেছে বলে সাহেব বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী রফিকুল জানান।

কালু নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, তাদের বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। ফলে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। মুদি-কাম-সবব্জি ব্যবসায়ী তুহিন বলেন, বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। যারা আসছেন তারাও পরিমাণে খুব কম কিনছেন। আসলে মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই। বেচাকেনা নেই বলে আমাদের ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে।

রাজশাহীতে চলাচলের অন্যতম বাহন অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এখানকার স্থানীয়রা ছাড়া এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে আসে মানুষ। তাদের বেশিরভাগ এসব বাহন ভাড়ায় চালায়। যাত্রীর অভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গ্যারেজ মালিকরা জানান, ভোরবেলায় কেউ এসব বাহন নিতে আসছে না। কারণ যাত্রী নেই। কিন্তু তাদের জমার টাকা ঠিকই দিতে হবে।

এসব রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা খালি গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন। পাঁচজন যাত্রীর স্থলে দু-তিনজনের বেশি পাচ্ছেন না। মালিকের জমা, চার্জ আর নিজের পেটের খাবার জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। পরিবার-পরিজনদের জন্য কিছু করতে পারছেন না। নগরীর পদ্মা তীরের বিনোদন স্পটগুলোতেও নেই ভিড়। এখানে ফুচকা, হালিম, বাদাম, পেয়ারা বিক্রি করে জীবন চালানোরাও পড়েছে বিপাকে। একদিকে শীতের তীব্রতা অন্যদিকে ক্ষুধার জ্বালায় শান্তিতে নেই নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষ। নগরীতে বোরখা পরিহিত সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। লোকলজ্জার ভয়ে বোরখা পরে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছেন।

বগুড়া থেকে বিশেষ সংবাদদাতা মহসিন রাজু জানান, চলতি শীত মওসুমে বগুড়ায় তাপমাত্রা কমে ৯.০১ ডিগ্রিতে নেমে আসায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে জেলা আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটা এই মওসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বলে জানানো হয়েছে।

এর আগে ১৬ জানুয়ারি জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা আরও কয়েক দিন থাকবে এবং বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বগুড়া আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষকগণ।
তাদের পক্ষে উচ্চপর্যবেক্ষক শাহ আলম জানান, সকালে জেলায় এই মওসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারি মাসজুড়েই এমন অবস্থা থাকবে বলেও জানান তিনি।

জেলা শিক্ষা অফিসার হযরত আলী জানান, জেলার সকল মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিষয়টি সকল উপজেলা শিক্ষা অফিসসমূহকে ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে জেলার সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে দুস্থ ও ছিন্নমূলদের মধ্যে গরম কাপড় বিতরণসহ সকল সহযোগিতার কার্যক্রম চলমান। এদিকে তীব্র শীত ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মানুষ নেহাত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ফলে রিকশাওয়ালারা যাত্রী পাচ্ছেন না। খুব বেলা করে দোকানপাট খুলছে বন্ধ হচ্ছে সন্ধ্যার পরপরই। কষ্টে আছে গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষ। কাজ না পেয়ে দিনমজুর ও কৃষিশ্রমিকরা অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের জেরে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে গণহারে। তার ওপর ভয়ঙ্কর শীত ও শৈত্যপ্রবাহ বেকার, অনাথ, শ্রমজীবী, ছিন্নমূল মানুষের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার হালিম আনসারি জানান, প্রচণ্ড ঘন কুয়াশা আর কনকনে হিমেল হাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের। শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে। সূর্যের দেখা মিলছে না প্রায় ১৫ দিন যাবৎ। প্রচণ্ড শীতের কারণে শীতজনিত রোগ-ব্যাধি বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে।

অব্যাহত ঘন কুয়াশার কারণে ১৫ দিন যাবৎ এ অঞ্চলে সূর্যের দেখা মেলেনি। মাঝখানে শুক্রবার সূর্য কিছুক্ষণের জন্য উঁকি দিলেও দুপুরের পর থেকে আবারও কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। ঘন কুয়াশা আর এ প্রচণ্ড হিমেল হাওয়া শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে পড়েছে পশু-পাখিসহ সব বয়সী মানুষ। ঠাণ্ডার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছে না কেউই। শিশু ও বৃদ্ধসহ মাঝ বয়সী লোকজন একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে। গভীর রাত অবধি খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। বিশেষ করে চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১৫ দিন যাবৎ সূর্যের দেখা না পাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষ কাঁথা-কম্বল শুকাতে পারছে না। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের পাশাপাশি কাঁথা-কম্বল শুকানোর চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষ। বিকেল হতে না হতেই বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরতে শুরু করে পরদিন দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকছে। বিশেষ করে রাত ১২টার পর থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির মতো কুয়াশা জরছে। দিনের বেলাতেও যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঠাণ্ডার কারণে চাষিরা ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজ করতে পারছেন না। সার্বিকভাবে জনজীবনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। পর্যাপ্ত গরম কাপড় না থাকায় ছিন্নমূল মানুষ পড়েছে মারাত্মক বিপাকে।

গাইবান্ধা থেকে স্টাফ রিপোর্টার আবেদুর রহমান স্বপন জানান, ভয়াবহ দুর্ভোগের মুখোমুখি এখন গাইবান্ধার শ্রমজীবী ও ছিন্নমূলসহ সব শ্রেণির মানুষ। ইতোমধ্যেই জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এসব বন্ধ থাকবে। এমনিতেই কল কারখানাবিহীন এই জনপদে বেকারত্বের হার অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা ও বগুড়ার কারখানাগুলোতে লোক ছাঁটাই হওয়ায় ওই সব লোকজন এসে গাইবান্ধায় বেকারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র ও অসহনীয় শীতের কারণে মুটে-মজুরের কাজও এখন মিলছে না বেকারদের বলে জানিয়েছেন ক্ষুধায় কাতর শ্রমজীবীরা ।

নাটোর থেকে মোঃ আজিজুল হক টুকু জানান : নাটোরে কয়েক দিন ধরেই প্রচণ্ড শীত পড়েছে। স্কুলের সায়েন্স ল্যাবে থাকা থার্মোমিটারে নাটোরের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখা যায়। এমন শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নাটোরের খেটে খাওয়া কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষদের জনজীবন। প্রচণ্ড শীতের কারণে জনসাধারণের ঘরের বাইরে যেমন চলাচল কমে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে রিকশা-ভ্যান-অটোভ্যান চালকদের আয়-রোজগার। আবার এই শীতের দাপটে পুকুর বা বিলের পানির ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাছ ধরার পরিমাণও কমে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে জেলেদের আয়। অপরদিকে অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে সূর্যের দেখা কম পাওয়া যায় বিধায় কৃষিজমিতে কাজের পরিমাণও কম। এই কম রোজগারে বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষদের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের পরিবারের সদস্যরাও।

নাটোরের তেবাড়িয়া ইউনিয়নের একডালা গ্রামের অটো রিকশাচালক আইয়ূব জানান, শীতে ভোরবেলায় অটোরিকশা নিয়ে বের হই। কিন্তু এত সকালে কোনো প্যাসেঞ্জার পাই না। দিন বাড়লে যা দুই-একজন পাই তাতে বেশি আয় হয় না। এই শীতে সারাদিনে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এতে করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, সকাল ও রাতে রিকশা চালানো যায় না। হাত-পা ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে আসে। ফলে শুধু দুপুরে রিকশা চালাতে হয়। আগের মতো রাস্তায় যাত্রীও তেমন নেই। এতে কমে গেছে আয়, দু’বেলা আহার তুলতে হিমশিম খাচ্ছি। গরম কাপড়ে শীত থেকে বাঁচলেও ক্ষুধার কষ্টে দিন পার করছি।

পাইকেরদোল থেকে আসা আবুল কাশেম জানান, সকালে গাড়ি নিয়া বের হইছি, পরে ঠাণ্ডায় টিকতে না পেরে ১১টা বাজে বাসায় চলে আসছি। এত শীতের ভেতরে রিকশা চালানো যায় না। জেলে সলিল দাস বলেন, ঠাণ্ডায় ডাঙ্গাতেই থাকতে কষ্ট হচ্ছে, পানিতে নামবো কেমন করে। তাই বসে আছি। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন পুকুরে জাল টেনে যে আয় হয় তাতে ৫ জনের সংসার চলে। খাওয়া-পরা ছাড়াও তার সংসারে বৃদ্ধ মাসহ অন্য সদস্যদের প্রতিদিন ওষুধ লাগে ১৭০ টাকার। প্রচণ্ড শীতে কয়েক দিন ধরে কাজ বন্ধ। অনেক কষ্টে আমাদের দিন কাটছে।

জাঠিয়ানের শ্রমজীবী মহিউদ্দিন জানান, শীতে কুয়াশার পরিমাণ বেশি থাকায় জমিতে কৃষিকাজ কমে গেছে। নওগাঁ থেকে এমদাদুল হক সুমন জানান, নওগাঁর ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলেছে। মাঘের শুরুতে ঘন কুয়াশার সঙ্গে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডায় বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী, ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে পথঘাট। কয়েক দিন ধরে দিনে কিছুক্ষণের জন্য রোদের দেখা মিললেও হিমেল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তাপ ছড়াতে পারছে না সূর্য। ভোর থেকেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে নওগাঁ। মেলেনি সূর্যের দেখা। উত্তরের হিমেল বাতাস অব্যাহত থাকায় শীতের তীব্রতা ব্যাপক হারে অনুভূত হচ্ছে। এ কারণে দিনভর শীতে জবুথবু থাকতে হচ্ছে।

নওগাঁয় ঘন কুয়াশার সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। একদিকে দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে শীতের প্রকোপে গরিবদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উষ্ণ কাপড়ের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-এর অধ্যাপক হাসানাত আলী বলেন, আমাদের মনুষত্বের জায়গায় চির ধরেছে। ৮০-৯০ দশকের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতার জন্য মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। এখন সেই সময়ের তুলনায় বিত্তশালী মানুষ ও কর্পোরেট হাউস বেড়েছে। অথচ সে তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন সাহায্যের হাত কমেছে। এটি কোনোভাবেই মানবিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য সহায়ক নয়। এমন ঋণাত্বক পরিবর্তন কেন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ প্রচণ্ড শীতে রাষ্ট্র হিসেবে দৃশ্যমান সাহায্য-সহযোগিতা চোখে পড়ছে না। কর্মহীন মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিরন্ন মানুষের পাশে সরকারকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সূত্র : ইনকিলাব