রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : ২৪ এপ্রিল সেই কালো দিন : তিন বছরেও শুরু হয়নি বিচার
- প্রকাশের সময় : ০৬:৪৫:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৬
- / ৬৫৭ বার পঠিত
ঢাকা: ২৪ এপ্রিল সেই কালো দিন। সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০১৩ সালের এই দিনে দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটে। যা শুধু দেশই নয়, গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে। একটি ভবন ধসে সেদিন নিহত হয় এক হাজার ১৩৬ জন মানুষ। আহত হন অসংখ্য। নির্মম এই ট্র্যাজেডিতে যারা স্বজন হারিয়েছেন, জীবনের তরে পঙ্গু হয়েছেন, যারা শেষ পর্যন্ত স্বজনের লাশটিও বুঝে পাননি, আর ঘটনার পর যারা উদ্ধার করতে দিনের পর দিন সেখানে থেকেছেন, তারা এখনো ভুলতে পারেননি দুঃসহ সেই স্মৃতি। এদিকে ঘটনার পর তিন বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি মামলার বিচারকাজ শুরু হয়নি। এই ঘটনায় দায়েরকৃত পৃথক দু’টি মামলায় গত বছরের জুন চার্জশিট প্রদান করা হলেও বিচারকাজ শুরু না হওয়ায় ভুক্তভোগীরা অনেকেই এখন হতাশ। এ দিকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের অনেকে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে সামান্য সাহায্যের আশায়। অনেকে দিনের পর দিন কোনো কাজ না পেয়ে এখন ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। অনেকের স্বজন এখনো লাশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। স্বজনের লাশটিও তারা ফেরত পাননি এই দীর্ঘ দিনেও।
ভয়ানক সেই স্মৃতি আজো ভোলেনি মানুষ: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আট তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ঘটনার সময় সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ গগনবিদারী আর্তনাদ। যারা ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন তারা বলেছেন, ‘বিকট শব্দ। পরক্ষণেই দেখেন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে রানা প্লাজা। যেন কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে।’ মাত্র কয়েক মিনিটের ঘটনা। পুরো আটতলা ভবনটি ধসে দোতলার সমান হয়ে যায়। ভেতর থেকে বের হতে থাকে রক্তাক্ত মানুষ। এরা সবাই গার্মেন্ট শ্রমিক। মানুষের রক্তে লাল হয়ে যায় পুরো এলাকার রাস্তাঘাট।
ওই দিন ছিল তৎকালীন বিরোধী জোট আহূত হরতাল। আগের দিন ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়। তখন স্থানীয় প্রশাসন ওই ভবনটি খালি করে দিতে বলে। ভবনে মোট চারটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান ছিল। তিন তলা থেকে আট তলা পর্যন্ত ছিল গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। দোতলা পর্যন্ত ছিল প্রায় ৩০০ দোকান। আন্ডার গ্রাউন্ডে ছিল রানা প্লাজার মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানার ব্যক্তিগত কার্যালয় এবং কিছু খুপড়ি ঘর ও পার্কিং।
আগের দিন ফাটল দেখা যাওয়ার পরই ছুটি দেয়া হয় সব গার্মেন্ট কারখানা। সেখানে থাকা একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দোকান কর্মচারীদের ফাটল দেখা যাওয়ার গুজবে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্রুত ওই দিন ভবন থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু ওই দিনই সাভারের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন ওই ভবন পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণা দেন আশঙ্কার কিছু নেই। ইউএনও’র এ কথার বরাত দিয়েই রাতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মোবাইলে ফোন করে পরদিন কারখানায় উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। শ্রমিকদের অনেকে বলেছেন, সকালে গিয়েও তারা ওই ভবনে ঢুকতে চাননি। তখন তাদের লাঠিপেটা করে বাধ্য করা হয় ভবনে ঢুকতে। এর কিছু সময় পরেই সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ ধসে যায় ভবনটি। ঘটনার সময় ওই ভবনে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ ছিলেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সেখানে আটকে পড়েন। কিছু মানুষ তাৎক্ষণিক বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। টানা ২০ দিন চলে উদ্ধারকাজ। এতে অংশ নেয় সামরিক-বেসামরিক শত শত মানুষ। উদ্ধারকাজ করতে গিয়েও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মধ্যে বের হয় এক হাজার ১৩৬টি লাশ। ভবনের ধ্বংসস্তপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন। সাভার জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ নিহতের সংখ্যা এক হাজার ১৩৬ জন। লাশ হস্তান্তর হয়েছে ৮৪৫টি। ২৯১টি লাশ শনাক্ত হয়নি। সূত্র জানায়, এসব লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ডিএনএ টেস্টের পরও বেশ কিছু লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অপর দিকে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে এখনো মৃত মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার হচ্ছে।
তিন বছরেও বিচারকাজ শুরু হয়নি: রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় পৃথক দু’টি মামলা করা হয়। একটি মামলা হয় হতাহতের ব্যাপারে আর অপরটি ইমারত আইনে। দু’টি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয় গত বছরের ১ জুন। দুই মামলায় ওই ভবনের মালিকের ছেলে সোহেল রানাসহ মোট ৪২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়। ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে থাকায় দুই মামলায় মোট আসামি ৪২ জন। ইমারত আইনের মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন টঙ্গীর শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (আইআরআই) প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। তিনি অবসরে যাওয়ায় তার বিষয়ে অনুমতি চাওয়া হয়নি। বাকি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদানের বিষয়ে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। আর এ কারণেই চার্জশিট প্রদানে বিলম্ব হয় বলে একাধিক সূত্র জানায়। মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হত্যা মামলায় সরকারি চার কর্মকর্তাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এই চার কর্মকর্তা হলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দফতরের পরিদর্শক (প্রকৌশল) ইউসুফ আলী, উপপ্রধান পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিভাগীয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান দফতরের যুগ্ম শ্রম পরিচালক জামসেদুর রহমান এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপরে (রাজউক) ইমারত পরিদর্শক আওলাদ হোসেন। এর মধ্যে ইউসুফ আলী ও শহিদুল ইসলাম নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এই মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ মোট ২৩ জন জামিনে আছেন। আর সোহেল রানা, সরকারি কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন ও জামসেদুর রহমানসহ ছয়জন কারাগারে আটক আছেন। মামলা দু’টির ১২ জন আসামি পলাতক আছেন। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও প্রজ্ঞাপন জারি করতে প্রায় ১১ মাস চলে গেছে।
আসামিদের জামিনের বিষয়ে মামলার পিপি সাংবাদিকদের জানান, দু’টি মামলায় আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। রানাকেও জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে তার জামিন আদেশ স্থগিত করা হয়। পলাতক আসামিরা হলেন সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, পৌরনগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, ঠিকাদার নান্টু, ইতার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, আবদুল মজিদ, শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মনোয়ার হোসেন, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম, আবদুল হামিদ ও নয়ন মিয়া।
এদিকে দু’টি মামলায় আসামি উপস্থিতির জন্য দিন ধার্য রয়েছে আগামী ২৮ এপ্রিল। ওই দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে বিষয়ে শুনানির জন্য নতুন দিন ঠিক করা হবে। অপরদিকে আসামিদের মধ্যে রানার বাবা আবদুল খালেক জামিন লাভের পরই ভারতে চলে গেছেন বলে একটি সূত্র জানায়।(দৈনিক নয়া দিগন্ত)