বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা ॥ শেখ হাসিনা ছাড়াই নির্বাচন : খালেদা জিয়া ॥ ইতিবাচক রাজনীতির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিএনপি : মির্জা ফখরুল
- প্রকাশের সময় : ০১:২৭:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০১৬
- / ৭৫৩ বার পঠিত
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই ভবিষ্যতে নির্বাচন হবে এমন মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, সেজন্য এখন থেকেই কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি জনগণের দল তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সবকিছু করবে। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাই হাসিনা মার্কা কোনো নির্বাচনে কখনও কোনো দিন অংশ নেবে না। বরং শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করা হবে। যে নির্বাচন হবে জনগণের নির্বাচন। ১৯ মার্চ শনিবার বিএনপির ষষ্ঠ দলীয় কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্যে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কাউন্সিলররা দাবি জানান, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না। প্রয়োজনে জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনে যাবেন। কাউন্সিলরদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া এ মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক হয়নি, চুরি হয়েছে। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা পত্রিকা লিখলে গুম করে ফেলা হবে। তাই তারা রাঘববোয়াল লিখছে। তিনি দাবি করেন, পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। এর আগে সকালে কাউন্সিলের উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভিশন ২০৩০ নামের পরিকল্পনা তুলে ধরেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এতে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা ও দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয় উল্লেখ করেছেন। সংলাপে বসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। শনিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
চেয়াপারসন বলেন, তাদের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে। মাথাপিছু আয় হবে ৫ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হবে দুই অংকে। তিনি বলেন, ‘আমরা সংকট নিরসন করে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নিয়ে সমৃদ্ধ দেশ এবং আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ভিশন-২০৩০ শিরোনামে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছি।’ ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকেই আগামীতে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার হবে বলে জানান চেয়ারপারসন। দলের নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর ঘটনাসহ পারিবারিক বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরার সময় খালেদা জিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি নির্বাচন বা সংলাপ চাইছি না। আমাদের উদ্দেশ্য দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, জনগণের সম্মতিতে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা। কারা দেশ পরিচালনা করবে, তা নির্ধারণের অধিকার আমরা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। দেশের মালিক জনগণ। তাদের ওপর আস্থা রেখে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো আজ সময়ের দাবি। এতে সবারই মঙ্গল হবে। দেশকে অরাজকতা ও বিশৃংখলার দিকে না ঠেলে দেয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সম্মেলনে প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বিএনপিতে নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করলেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এজন্য নতুন ধরনের সমঝোতা চুক্তির উদ্যোগ নেবে বিএনপি। তিনটি ‘গুড’ বা ‘সু’ অর্থাৎ থ্রিজি-এর সমন্বয় ঘটাতে চাই আমরা। এই থ্রিজি হল- গুড পলিসি, গুড গভর্নেন্স এবং গুড গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ সুনীতি, সুশাসন এবং সু-সরকার। তিনি বলেন, বিএনপির জন্য এটা কঠিন সময় হলেও অতীতের মতোই বিএনপি আবারও জেগে উঠেছে। গ্রিক রূপকথার সেই ফিনিক্স পাখির মতো ভস্মস্তুপ থেকেই বারবার আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে বিএনপি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি সবাইকে আশ্বাস দিতে চাই, আগামীতে বিএনপি জনগণের সমর্থন নিয়ে আল্লাহর মেহেরবানিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে কাউকেই অহেতুক হেনস্থার শিকার হতে হবে না। আমরা কারও প্রতি অবিচার করব না।’
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন চত্বরে কাউন্সিল অধিবেশনে খালেদা জিয়া দীর্ঘ এক ঘণ্টা ১২ মিনিট বক্তব্য রাখেন। দীর্ঘ বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। ছয় বছর পর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানায় নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টার আগেই জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেন খালেদা জিয়া। এরপরই দলের ৭৫টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির নেতারা নিজ নিজ জেলার পতাকা উত্তোলন করেন। পরে বেলুন ও সাদা পায়রা উড়িয়ে দেয়া হয়। মঞ্চে উঠে খালেদা জিয়া দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথি, কাউন্সিলর, ডেলিগেটসহ নেতাকর্মীদের হাত তুলে অভিবাদন জানান। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী পর্বের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অনুষ্ঠানে বিগত সময়ে নিহত-আহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ষষ্ঠ কাউন্সিলের সেøাগান- ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’ এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় পতাকা ও ধানের শীষ সমন্বিত কাউন্সিলের লোগো রয়েছে।
মূল মঞ্চে খালেদা জিয়া ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, তরিকুল ইসলাম, আসম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। অসুস্থতার কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্য এম শামসুল ইসলাম, এমকে আনোয়ার, সারোয়ারি রহমান ও কারাগারে বন্দি থাকায় মির্জা আব্বাস ছিলেন অনুপস্থিত। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিকালে শুরু হয় কাউন্সিলরদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার পর্ব।
সমাবেশের একপর্যায়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। কাউন্সিলের সাফল্য ও অভিনন্দন জানিয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন পার্টি বিজেপি। এছাড়া যুক্তরাজ্যের এমপি সাইমন ড্যানজাক, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির এমপি ফিলিফ বেনিয়ন, সিকাগো সিটির অলডারম্যান হোসেফ মুর, বারবারা মুর বিদেশী অতিথি হিসেবে কাউন্সিলে যোগ দেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরাও আমন্ত্রিত হয়ে কাউন্সিলে আসেন। ২০ দলের শীর্ষ নেতা ছাড়াও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
ভারতের বিজেপির গভর্নিং বডি আরএসএস’র সিনিয়র এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ইন্দ্রেশ কুমার তার শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘আমি বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সফলতা কামনা করছি। আশা করছি এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও খুব জনপ্রিয় দলরূপে তাদের অবস্থান আরও সংহত করবে। ভবিষ্যতে বিজেপি/আরএসএস এবং বিএনপি তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও উন্নত করবে।’ ভিডিওতে শুভেচ্ছা বক্তব্যটি বাংলায় পড়ে শোনান বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ। এছাড়া স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার, লন্ডনের মেয়র ব্রিটিশ এমপি ডেভিড ল্যামি, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী, কানাডার বিরোধীদলীয় নেতাসহ কয়েকটি দেশ কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়েছেন। বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন অনেকটা মহাসমাবেশের রূপ নেয়।
কাউন্সিল উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট ও আশপাশে নেয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কাউন্সিলের কারণে রাজধানীতে যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে।
বক্তব্যের শুরুতে খালেদা জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতসহ অন্যান্য দেশকে ধন্যবাদ জানান। তিনি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব নেতার অবদানের কথা স্মরণ করেন। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। বিএনপির দীর্ঘ সংগ্রামের পথে যারা জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করেছেন, সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের প্রতিও আন্তরিক সমবেদনা ও সম্মান জানান তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দুর্নীতি-দুঃশাসন চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়ার নষ্ট রাজনীতি করছে। নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা জেগে ? উঠুন, ঐক্যবদ্ধ হউন। আপনাদের যে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, তা ছিনিয়ে নিন। দেশবাসীর উদ্দেশে এই আহ্বান রেখে তিনি নেতা-কর্মীদের বলেন, অন্ধকারের পর্দা দুলে উঠেছে। অচিরেই আলো আসবে। ভবিষ্যৎ আমাদেরই ইনশাআল্লাহ।’
সাম্প্রতিক সময়ে হত্যা ও গুম, জুলুম-নিপীড়ন ও হামলা-মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন অবস্থা চলতে পারে না। জাতিকে পেছনে ঠেলে দেয়ার নষ্ট রাজনীতির আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ আরও ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। তাই আমরা সংকট নিরসন করে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছি। দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশা ও অঙ্গনে কর্মরত শীর্ষস্থানীয় ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। সবার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধ দেশ এবং আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিএনপি ইতিমধ্যে ‘ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির ভিশন ২০৩০-এর কর্মপরিকল্পনা এখন খসড়া পর্যায়ে। চূড়ান্ত হলে এর বিস্তৃত রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থা অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানীগুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমাদের জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় জীবনের এক চরম সংকটজনক অবস্থায় এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশে গণতন্ত্র নেই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ নেই। সত্যিকারের বৈধ সরকার নেই। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। সুশাসন নেই। সুবিচার ও ন্যায়বিচার নেই। নারীর সম্ভ্রম ও মানবাধিকার আজ বিপন্ন। শিশু পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। আছে শুধু স্বেচ্ছাচার, অনাচার, দুঃশাসন, দুর্নীতি আর চরম নৈরাজ্য। জাতি হিসেবে আমাদের বর্তমান আজ সংকটকবলিত আর ভবিষ্যৎ অন্ধকার ও অনিশ্চিত। আমাদের এ কাউন্সিল থেকে জাতীয় জীবনের সেই জমাটবাঁধা অন্ধকার দূর করে আলোর আভাস আনতে হবে।
ভিশন ’৩০ পরিকল্পনার খসড়ার নানা দিক তুলে ধরেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সেই লক্ষ্যগুলো পূরণে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আমরা সব মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন করতে চাই, যাতে বহু বর্ণের চ্ছটায় উদ্ভাসিত একটি বাংলাদেশী সমাজ গড়ে উঠবে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ‘রেইনবো নেশনে’ পরিণত হবে।
এছাড়াও এ মহাকর্মপরিকল্পনায় বিএনপি চেয়ারপারসন আগামীতে ক্ষমতায় গেলে সংবিধানে গণভোট প্রথা চালু, সব কালা-কানুন বাতিল, দলীয়করণমুক্ত দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ ও অনিয়মমুক্ত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং আটক অবস্থায় দৈহিক-মানসিক অমানবিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, নারী, শিশু এবং প্রবীণদের কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে নেয়া হবে নানা উদ্যোগ। দেশের দ্রুত বর্ধনশীল এবং নৈরাজ্যপূর্ণ নগরায়ণকে সুশৃংখল এবং ডবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বিত করতে একটি জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে সব বাধা দূর করে নানা পরিকল্পনা নেয়া হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস করবে না। বিএনপি দুর্নীতি করবে না- কাউকে করতেও দেবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ‘ন্যায়পাল’ এর পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করা হবে। সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেন তিনি।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে হামলা-মামলার চিত্র তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, দেশজুড়ে এখনও সেই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে। অসংখ্য পরিবারে স্বজন হারানো কান্নার রোল এখনও থামেনি। এ চরম দুঃখের দিন কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ এ জুলুম ও অস্থিরতা বাংলাদেশ বহন করতে অক্ষম।
খালেদা জিয়া বলেন, সারা দেশে শুধু আমার নেতাকর্মীরা নন, তাদের পাশাপাশি আমি নিজেও চরম দুঃখ-কষ্ট সয়ে, হামলা, বাড়ি ও অফিস অবরোধ, মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করে আপনাদের মাঝেই রয়েছি এবং থাকব। আমি পরিবারের সদস্যদের থেকে বিছিন্ন। আমার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো বিদেশ-বিভুঁইয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। দীর্ঘ ৭ বছর পর সে আমার কাছে লাশ হয়ে ফিরেছে। আমার বড় ছেলে তারেক রহমানকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। চরম নির্যাতনে পঙ্গ হয়ে এখনও দূরদেশে সে চিকিৎসাধীন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক এসব দুঃখ-বেদনা বুকে চেপে আমি এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের কল্যাণে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ কঠিন সংগ্রামে আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের সহযোগিতাই আমার পাথেয়।
দেশের গণতন্ত্রহীন অবস্থা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা-না থাকার মধ্যে বেহেশত ও দোজখের মতো দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকযন্ত্রণা ভোগের ভয়ে তাই অনেকে ক্ষমতা ছড়াতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে সব রকমের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, সরকার ও বিরোধী দলকে মর্যাদা ও অধিকারের দিক থেকে আমরা যাতে আরও কাছাকাছি আনতে পারি, তার জন্য আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা পথ ও প্রক্রিয়াও উদ্ভাবন করতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করা, হামলা-মামলায় বিরোধী রাজনীতিকদের হেনস্থা করা এবং আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পন্থাকে কাজে লাগিয়ে শহীদ জিয়ার স্মৃতিকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই সফল হবে না।
খালেদা জিয়া বলেন, সন্ত্রাস-দুর্নীতি-লুটপাট আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শেয়ারবাজার লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলো লুণ্ঠিত হচ্ছে। এখন বিদেশী হ্যাকাররা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছে। এ অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের আমলে ব্যাংক, এটিএম বুথ, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেও জনগণের অর্থ নিরাপদ নয়। স্বাধীন সাংবাদিকতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার আজ পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত ও বিপন্ন। দুর্নীতি, অনাচার ও অপশাসনে লিপ্ত ক্ষমতাসীন সরকার নানা অপকৌশলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করছে। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দেশ এক অকার্যকর রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা কি শুধুই ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করব? আমরা কি শুধু এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্থা ও ধ্বংস করে দিতে চাইব? রাজনীতি তো দেশের জন্য, মানুষের জন্য। সেই দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে মানুষের ওপর জবরদস্তির শাসন চালিয়ে কী লাভ? এ দূষিত রাজনীতির চক্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সারা দেশ থেকে আসা কাউন্সিলরদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের অসহায় ও হতাশ জনগণ আমাদের কাউন্সিলের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দিকনির্দেশনা ও আলোর দিশা চায়। আমাদের শক্তির উৎস তারাই। আপনারা এ কাউন্সিল শেষে দিকনির্দেশনা নিয়ে সারা দেশে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ করবেন। আগে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং সংগঠনকে সুসংবদ্ধ করবেন।
স্বাগত বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলের আগামী দিনের আন্দোলনের কর্মকৌশল হবে সংগঠন, আন্দোলন ও নির্বাচন। এ কারণে দলের মধ্যে সরকারের অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। কেননা এরাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে। বিগত আন্দোলনে আহত ও নিহতদের একটি তালিকা তুলে ধরেন তিনি।
দ্বিতীয় অধিবেশনে খালেদা জিয়ার বক্তব্য: বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক কিছু বের হয়েছে। আপনারা সেটা জানেন, পড়েছেন। আপনারা জানেন কে এর সঙ্গে জড়িত। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান হাসিনাকে অবহিত করেছেন। কিন্তু হাসিনা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন এবং তাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তিনি (আতিউর) কেঁদেছেন। কেঁদেছেন এ কারণে যে, ছেলে অপকর্ম করবে তার দায়ভার আরেকজনের ওপর দিয়ে বলির পাঁঠা বানানো হবে, চোখের পানি আসা স্বাভাবিক।’
নিজ দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেন, দলে কিছু বেঈমান ও মীরজাফর আছে যারা আন্দোলনকে সফল হতে দিচ্ছে না। কাজেই এদের দল থেকে বাদ দিতে হবে। বিএনপিতে লোকের অভাব হবে না। অনেক ভালো ভালো লোক বিএনপিতে যোগ দিতে চাচ্ছে।
তিনি বলেন, ভুল হতেই পারে। আপনারা দোষারোপ করছেন কিন্তু আপনারাও তো ঠিকমতো কাজ করতে পারেননি। আপনাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল কমিটি করার জন্য তখন আপনারও তো অমুক ভাই তোমুক ভাইয়ের অজুহাতে, টাকা বিনিময়ে কমিটি গঠন করেছেন বলে প্রমাণ রয়েছে। কাজেই একে অপরের দোষ না খুঁজে ঐক্যবদ্ধ হই তাহলেই জাতীয় ঐক্য সম্ভব হবে।