চলে গেলেন কবি রফিক আজাদ : প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারের শোক
- প্রকাশের সময় : ১০:৪৪:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ মার্চ ২০১৬
- / ১৯৭১ বার পঠিত
ঢাকা: ‘ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাবো’- জনপ্রিয় এই পঙক্তির স্রষ্টা কবি রফিক আজাদ আর নেই। দীর্ঘ দুই মাস ধরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন এই কবি ১২ মার্চ শনিবার দুপুর দুইটা ১০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…… রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। জানুয়ারীতে ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর রফিক আজাদকে বারডেম হাসপাতাল ও আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ১৫ জানুয়ারী ভর্তি করা হয় বিএসএমএমইউতে। তারপর থেকে ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে দেবব্রত বণিক ও কামরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা কবি।
শনিবার বিকাল ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেন, বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ২টা ১৩ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন। অনেক রোগে ভুগছিলেন তিনি। সর্বশেষ তার স্ট্রোক হয়।
বিএসএমএমইউর চিকিৎসক হারিসুল হক বলেন, রফিক আজাদ ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। ১১ মার্চ শুক্রবার সকাল থেকে তার রক্তচাপ পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে ক্রমান্বয়ে তার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং দুপুরে রক্ত সংক্রমণে তার মৃত্যু হয়।
কবি রফিক আজাদের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, সংস্কৃৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানসহ দেশের বিশিষ্টজনরা শোক প্রকাশ করেছেন।
কবির পরিবারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, তার দুই ছেলে অভিন্ন আজাদ ও অব্যয় আজাদ কানাডায় থাকেন। তারা বাবাকে দেখতে দেশে এসেছিলেন। ১০ মার্চ কানাডা ফিরেছেন অভিন্ন আজাদ। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে অভিন্ন ফের দেশে আসছেন। পৌঁছাবেন ১৪ মার্চ সোমবার। এরপর রফিক আজাদের দাফন সম্পন্ন হবে। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবির মরদেহ দাফন করা হতে পারে।
কবির ভাতিজী ড. নীরু শামসুন্নাহার জানান, লাশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। সোমবার সকালে কবির মরদেহ প্রথমে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নেয়া হবে। সেখানে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরদেহ নেয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তারপর বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হবে।
কবিপতœী দিলারা হাফিজ গণমাধ্যমকে বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হোক, আমরা শুধু এটাই চাই।
উল্লেখ্য, প্রতিবাদী এ কবি কবিতার লেখনীতে আবদ্ধ না রেখে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জাতির চরম ক্রান্তিকালে, ১৯৭১-এ। টাঙ্গাইলে আবদুল কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি। রফিক আজাদের মৃত্যুর সংবাদে হাসপাতালে ছুটে যান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলেন রফিক আজাদ। বহুজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তিনি যাননি, রণাঙ্গনেই ছিলেন। তিনি অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছিলেন।
জীবনী: রফিক আজাদের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামে। পিতা সলিম উদ্দিন খান একজন সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন গৃহিণী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রফিক আজাদ ভাষা শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে। ১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় একবার বাবার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন জাদুকর পিসি সরকারের কাছে ম্যাজিক শেখার উদ্দেশ্যে। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
রফিক আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা। টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার প্রভাষক পদ ছেড়ে যোগ দেন বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার-এর সম্পাদক ছিলেন। বেনামে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন রোববার পত্রিকা। পরে কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।
কবি রফিক আজাদের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- অসম্ভবের পায়ে, সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি, প্রেমের কবিতাসমগ্র, বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে, বিরিশিরি পর্ব, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠ কবিতা, রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র, হৃদয়ের কী বা দোষ, কোনো খেদ নেই, প্রিয় শাড়িগুলো, সশস্ত্র সুন্দর, একজীবনে, অঙ্গীকারের কবিতা, হাতুড়ির নিচে জীবন, পরীকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ, মৌলবীর মন ভালো নেই প্রভৃতি।
রফিক আজাদের জনপ্রিয় অনেক কবিতার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ‘ভাত দে হারামজাদা’। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে তার এই কবিতা। এই কবিতার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার বিরাগভাজন হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবির ‘স্বাধীনতা’য় হস্তক্ষেপ করেননি বলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রফিক আজাদ। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী আর আনওয়ারুল আলম শহীদ, বঙ্গবন্ধুর কাছে আমারে নিয়া গেছিলেন। উনি ব্যাখ্যা চাইলেন। আমি ব্যাখ্যা দিছি। সারা পৃথিবীর নিরন্ন মানুষের প্রধান চাওয়া হলো ভাত। আমি সারা পৃথিবীর লোকের কথা বলছি। আর আমাদের দেশে, নিরন্ন মানুষ এই ভাষাতেই কথা বলে। এটা বলার পর উনি (বঙ্গবন্ধু) বলে, তা বটে! আমার কাঁধে হাত রাইখা বললেন, ভালো লিখছিস, যা’।
কবি রফিক আজাদ ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান। এছাড়া হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯), ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১), কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬) ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭) লাভ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকায় ‘স্যাড জেনারেশন’ কাব্য-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন রফিক আজাদ। (মানবজমিন)