ইসরাইল-হামাস: একটা শান্তির সুযোগ কি আছে?
- প্রকাশের সময় : ১১:৪৭:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৩
- / ৬৭ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির ইহুদি সম্প্রদায়ের শীর্ষ প্রতিনিধিদের সঙ্গে দিন কয়েক আগে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমার। মোটাদাগে আমাদের পরিকল্পনা ছিল তিনটি। এক. গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরাইলি সেনাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করা। দুই. ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কীভাবে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার পরিকল্পনা ও প্রচার। তিন. চলমান যুদ্ধ বন্ধে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের রূপরেখা তুলে ধরা।
বলা বাহুল্য, আমার বন্ধু ও সহকর্মীরা চলমান সংকট অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য সফরে না যেতে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ‘শান্তির বাণী’ প্রচারের সময় এটা নয়; বরং এটা এমন এক সময়, যখন এ ধরনের উদ্যোগের আলোর মুখ দেখাটা কেবল কঠিনই নয়, অসম্ভবও। আমি অবশ্য তাদের কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছি।
চলমান সংঘাতময় অবস্থার মধ্যেও কেন আমি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে যেতে চেয়েছিলাম, তার পেছনে কাহিনি আছে। সম্প্রতি জর্ডান সফরে গিয়েছিলাম। বাদশাহ আবদুল্লাহ ও যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাত্কালে চলমান পরিস্থিতির উত্তরণে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। তারপর যাই কাতারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন জসিম আল-থানির সঙ্গে দেখা করার পর আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসি।
জানিয়ে রাখার বিষয়, ইসরাইল ভূখণ্ডে হামাসের অকস্ম্যাত্ হামলা করে বসা, গাজায় ইসরাইলি সেনাদের জিম্মি দশার মতো নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে ঐ সব নেতার সঙ্গে। সর্বোপরি সব পক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয় ছিল আলোচনার প্রায় সবটা জুড়ে। বস্তুত, আমরা একটি জুতসই সমাধান খুঁজে বের করার চিন্তা থেকে আলোচনায় বসেছিলাম। এই মহত্ উদ্যোগে বিশেষ করে কাতারের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দোহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেই নয়।
কঠিনতম সময়ে এমন এক ইস্যুর সমাধানের প্রশ্নে আমরা এক জায়গায় জড়ো হই, যার চূড়ান্ত মীমাংসা প্রায় অসম্ভবই! তবে আনন্দের কথা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে খোলামেলা ও সুন্দর আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় আমাদের মধ্যে। আসলেই, আমরা সবাই একটিমাত্র জিনিস নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম—তা হলো ‘শান্তি’। সবাই একটি জিনিস নিয়েই ভেবেছি; আর তা হলো সুন্দর ভবিষ্যত্, যেখানে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে, নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারবে।
আলোচনার টেবিলে ঘুরেফিরে আসে ইরানের নাম। এ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি মার্শাল প্ল্যানের আলোকপাতও ছিল আলোচনায়। মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যে সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার নতুন রূপরেখা অঙ্কনের প্রচেষ্টা থেকেই একসঙ্গে বসেছিলাম সবাই। সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে শান্তিতে কীভাবে বসবাস করা যায়—সবার মাথায় ছিল কেবল এই একটি চিন্তাই। না বোঝার কিছু নেই, বর্তমান পরিবেশে শান্তির কথা শুনতে চাইবে না কোনো পক্ষই। গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর পরিস্থিতি এতটাই ঘোলা হয়ে গেছে যে, শান্তির পতাকা হাতে এগিয়ে আসার আহ্বান শুনে হাসবেন যে কেউ। তবে আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস আমাকে ফিরিয়ে দেবে না!
আজ থেকে ৫০ বছর আগে কী ঘটেছিল, মনে আছে? ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে কী ঘটনার অবতারণা হয়েছিল, তার কথা কি স্মরণে আছে? ঐ সংঘাতের পর মনে হচ্ছিল, মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে; কিন্তু মিশরের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই একে অন্যের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন এবং তা-ও জেরুজালেমের মাটিতেই। প্রেসিডেন্ট সাদাতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ডানপন্থি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী সিনাই উপত্যকা মিশরের হাতে ফিরিয়ে দেন বিনা দ্বিধায়। সেই শান্তি উদ্যোগ টিকে আছে আজ অবধি তথা প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল।
দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনার কথা বলতে চাই। শান্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে হোয়াইট হাউজের লনে যখন ইসরাইলের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের সঙ্গে প্রয়াত চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের হাত মেলানোর ঘটনা ঘটে, তখন সত্যিকার অর্থেই মনে হয়েছিল, এই অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ কতটা তাত্পর্য বহন করে। আমন্ত্রিতদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
সুখ, শান্তি ও আশাকে মাথা থেকে বের করে দেওয়ার চিন্তা আমার ভেতরে আসে না। ওপরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম, যারা মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে কোনো দিন শান্তি আসবে না বলে ধরে নিয়েছিল, তারাও আপ্লুত হয় এই দৃশ্য দেখে! করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় ঐ উদ্যোগকে। বাস্তবিক অর্থেই সেদিন বন্ধু হয়ে উঠেছিল পক্ষগুলো!
সেই সময়ের পর থেকে একটি নাম আমি মনের মধ্যে লালন করে আসছি—প্রয়াত ডক্টর সায়েব এরেকাত। আমার বিবেচনায়, ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাবান। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। দুর্ভাগ্যবশত ২০২০ সালের নভেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন সায়েব। সায়েবের মৃত্যু বিশ্বের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি নিঃসন্দেহে। মূলত যারা এই অঞ্চলে শান্তির অনুসন্ধান করে আসছেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সেতু নির্মাতা’।
সায়েব ও আমি অধিকাংশ বিষয়ে বরাবরই দ্বিমত পোষণ করতাম। তবে একটি বিষয়ে আমরা সব সময়ই একমত ছিলাম—ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন জীবনযাপনের গ্যারান্টি দেবে, যার মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যত্ নির্মিত হবে—এ বিষয়ে আমরা বরাবরই কথা বলতাম। বলতেই হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সায়েবের মতো কণ্ঠ বড্ড মিস করছি। তার প্রজ্ঞা, ক্ষমতা—সবকিছু ছাপিয়ে চরমপন্থার বিরুদ্ধে তার দরাজ আওয়াজ আজকের দিনে বড় বেশি জরুরি।
৭ অক্টোবর হামাস যেভাবে হঠাত্ আক্রমণ চালিয়ে বসে ইসরাইলের ভূখণ্ডে, তাতে করে তাদের উদ্দেশ্য তথা মিশন নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। এক্ষেত্রে পেছনে বসে কেউ কলকাঠি নাড়ছে কি না, তাও তলিয়ে দেখা দরকার। আমার বিশ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যের মাটিকে উত্তপ্ত করে তোলার পেছনে ভেতরের বা বাইরের কারো না কারো হাত অবশ্যই আছে!
আমরা শুনতে পাই, ইরান এই অঞ্চলে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে বা উঠছে। এটা অনেকাংশে সত্য কথা। অভিযোগ আছে, হামাস যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস। যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রও দিয়েছে তেহরান। এই অঞ্চলের অন্যান্য মিলিশিয়া তথা হুথি, হিজবুল্লাহ ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের মতো করে হামাস যোদ্ধাদের সুনিপুণ প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলেও জোর গুঞ্জন রয়েছে। এসব অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এই অঞ্চল তো বটেই, তীব্র অস্থিরতার মুখে পড়ে গোটা বিশ্বই শান্তির রাস্তা থেকে ছিটকে পড়বে বহু দূরে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে তেহরানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাক বা না যাক, একটা কথা সবার মাথায় রাখা জরুরি, উদাসীনতার সময় এটা নয়। নেতা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মালিক-শ্রমিক, সাংবাদিক, ছাত্র—সবার উদ্দেশেই আমি এ কথাটা বারবার বলতে চাই। যারা শান্তিতে বাস করতে চান, যারা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন, তাদের অনেক কিছু করার আছে এ নিয়ে। অন্যদের অন্তত উগ্রবাদের কণ্ঠে কণ্ঠ না মেলানোর আহ্বান জানাই। কঠিন সময়ে মানুষ ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে ভুলবশত। সুতরাং সাবধান!
আমি সব সময় শান্তির পক্ষের মানুষ—ছিলাম, আছি এবং থাকব। সম্ভবত আমার মতো করে চিন্তা করার মানুষ জগতে আরো অনেকেই আছেন। বাস্তবিক অর্থেই, আমরা আমাদের সন্তানসন্ততি ও নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যেক অন্ধকার কানাগলিতে আটকে রাখতে পারি না। বিশ্ব নেতৃত্ব এই মর্মকথা বুঝবেন বলেই বিশ্বাস করি। শান্তি শপথের আওয়াজে হানহানি-সংঘাতের ইতি ঘটবে, এ-ও শক্ত বিশ্বাস। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক

























